৪০০ বছরেরও পুরনো কলকাতার বনেদি পুজোর ইতিহাস
সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজোকে প্রথম ধরলে কলকাতার বনেদি পুজোর বয়স নেই নেই করে চারশো বছর। চারশো বছরে পুজোর রীতি রেওয়াজ, আনন্দের অভিমুখ অনেক বদলেছে। দুর্গা ঠাকুরদালান থেকে নেমে এসেছেন বারোয়ারি মণ্ডপে। আগে শিল্পীরা সিংহ গড়তে পারতেন না। দেবীর বাহনের অবয়ব হতো ঘোড়ার মতো। ক্রমে বদল এসেছে মূর্তিতে, আমূল পাল্টে গিয়েছে চালচিত্র আঁকার রেওয়াজ। তবু কলকাতা এবং সংলগ্ন গৃহস্থের শতাব্দীপ্রাচীন পুজোগুলিতে চোখ রাখলে আজও মনে হয়, ডিজে উদ্দাম নাচ, রাত জেগে ঠাকুর দেখার ট্রেন্ড যেমন আছে, তেমনই তিরতির করে বয়ে চলেছে সাবেক পুজোর স্রোতটাও। বাড়িভেদে আচার আলাদা, তবে কিছু জিনিস সর্বত্রই এক। খাস বাংলা রীতির দেবীমুখ থেকে যেন গর্জন তেল ঝরছে। দেবীর পদ্মপত্রাভনেত্র দেখলে শিল্পপ্রেমীর মনে হবে কিষাণগড়ের রাধাকে দেখলাম। দেবীর পিছনে চালচিত্রে আঁকা রামায়ণ বা মহাভারতের অংশবিশেষ। বাড়ির মেয়ে বউরা ছুটছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। দুর্গাদালানের প্রতিটি খিলান গম্বুজে, অজস্র ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় ঝিকমিক করছে ইতিহাসের অংশ। কলকাতার দুর্গা বলতে যারা আজ প্যান্ডেল-হপিং বোঝেন, তাঁরা কি দু'দণ্ড দাঁড়াবেন ইতিহাসের এই চোরাবাঁকে?
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো
কলকাতা শহরের প্রাচীনতম বনেদি বাড়ির পুজো বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। ১৬০৮ সালে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে জায়গির এবং খেতাব পান। ১৬৯৯ সালে রায়চৌধুরী উপাধি পান। ১৬১০ সালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী এই পুজোর প্রচলন করেন কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোর। লক্ষ্মীকান্তই প্রথম লক্ষ্মী ,সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ এবং মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গারূপকে আনলেন একচালার মধ্যে। প্রতিমার একদিকে শিব এবং অপর দিকে রামের মূর্তিও পুজো করা হয়।১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত যখন এই পুজোর প্রচলন করেন সেখানে কার্তিককে নিয়ে আসেন যুবরাজ রূপে। একমাত্র রায়চৌধুরী পরিবারে ত্রিধারা সঙ্গম অর্থাৎ শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব – তিনমতেই পুজো সম্পন্ন হয়।এই ত্রিধারার প্রচলন করেন লক্ষ্মীকান্তের নাতি বিদ্যাধর রায়চৌধুরী। ‘দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণী’ পুঁথিমতে পুজো হয়ে আসছে এই পরিবারে। কুলদেবতা রাধামাধবের পুজো না দিয়ে কোনও পুজো শুরু করা হয় না। বড়িশার ছ'টি বাড়ি ও নিমতা এবং বিরাটি বাড়ি— সব মিলিয়ে মোট আটটি পুজো হয় সাবর্ণদের পরিবারে। জন্মাষ্টমীতে কাঠামো পুজো এবং কৃষ্ণনবমীর দিন হয় দেবীর বোধন। রায়চৌধুরী পরিবারের পুজোয় অন্নভোগ নিবেদিত হয়। তবে নিমতা এবং পাঠানপুরের বাড়িতে দেবীকে সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ (বৈষ্ণব রীতি অনুসারে) নিবেদন করা হয়। কইমাছ,খেসারির ডাল, কচুর শাক,চালতার অম্বলও থাকে ভোগে। এছাড়া দশমীতে দেবীকে পান্তা ভোগ দেওয়া হয়।একসময় বলিদান প্রথা থাকলেও আজ কেবলমাত্র সন্ধিপুজোয় ল্যাটা মাছ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির পুজো
ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে ঠাকুমার সাথে কলকাতায় আসেন রামদুলাল সরকার। শোনা যায়, তাঁর ঠাকুমা হাটখোলা দত্তবাড়ির রাঁধুনি ছিলেন। হাটখোলা দত্ত পরিবারের সদস্য মদনমোহন দত্ত ছিলেন একজন জাহাজ ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে কাজ করতেন রামদুলাল। সততার পুরস্কার হিসাবে মদনমোহনের কাছ থেকে পাওয়া এক লক্ষ টাকা তাঁকে রাতারাতি ধনী ব্যবসায়ীতে পরিণত করে। রামদুলালের দুই ছেলে আশুতোষ এবং প্রমথনাথ– এই দুই ভাই 'ছাতুবাবু লাটুবাবু' নামে পরিচিত। উনিশ শতকের বাবু সংস্কৃতির অন্যতম উদাহরণ ছিলেন রামদুলাল এবং তাঁর দুই ছেলে।
১৭৮০ সালে রামদুলাল সরকার প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন।রথের দিন হয় দেবীর কাঠামো পুজো। পুজো শুরু হয় প্রতিপদ থেকে।প্রতিমাকে সিংহাসনে বসানো হয় তৃতীয়ার। বোধন হয় ষষ্ঠীতে। গৃহদেবতা শ্রীধর জিউ পুজ্জোর দিনগুলিতে থাকেন দেবী দুর্গার সাথেই।
মটচুপড়ী আর্টের তেচালায় আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যার ছবি। প্রতিমার সাথে লক্ষ্মী ,সরস্বতীর পরিবর্তে থাকেন দেবীর দুই সখী—জয়া ও বিজয়া। সিংহ অশ্বমুখী। প্রতিমার ডানদিকে হরপার্বতী এবং বামদিকে রামচন্দ্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো ও সধবা পুজোর রীতি বর্তমান। সন্ধিপুজোর সময় ১০৮ টি রূপোর প্রদীপ জ্বালানো হয়। বহু আগে শাক্ত বলি হলেও বর্তমানে বৈষ্ণবমতে বলি হয়। বাড়ির মহিলারা দশমীর পরিবর্তে সিঁদুর খেলেন অষ্টমীর দিন। প্রতিমাবরণ করেন দুই পুরোহিত এবং পরে মহিলারা মিষ্টি ও পান খাওয়ান দেবীকে।
দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখির পরিবর্তে বর্তমানে পায়রা ওড়ানো হয়। প্রতিমাকে কাঁধে ঝুলিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। আড়ম্বর কমলেও পুরনো রীতিনীতি মেনে আজও পুজো করা হয়।
বলরাম দে স্ট্রিটের দত্ত বাড়ি
হাটখোলা দত্ত পরিবারের সদস্য সলিসিটর শ্যামলধন দত্ত পারিবারিক মনোমালিন্যের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং বলরাম দে স্ট্রিটের এই বাড়ি কেনেন। ১৮৮২ সালে তিনি পুজোর প্রচলন করেন।তাঁর দুই কন্যাসন্তান ,কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর এক মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর বিয়ে হয় চালতাবাগানের ঘোষ পরিবারে। এখন তাঁরাই এই পুজোর দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
উল্টো রথের দিন নতুন বাঁশ পুজো ( কাঠামো পুজো ) করা হয়। কৃষ্ণ নবমী থেকে প্রতিদিন সকালবেলায় সাতজন ঠাকুর চণ্ডীপাঠ করেন। ষষ্টীর দিন বিকেলে হয় দেবীর বোধন। আগে নবদ্বীপ থেকে পটুয়া আসতেন ঠাকুর রঙ করতেন। এখন কুমোরটুলির শিল্পীরাই ঠাকুর তৈরি করেন এবং রং করেন। এই বাড়ির সিংহও অশ্বমুখী। প্রতিমাকে কোনো অন্নভোগ নিবেদন করা হয় না। রাধাবল্লবী,লুচি,খাস্তা কচুরী,গজা, নারকেলের নাড়ু, দরবেশ,লেডিকিনি- প্রতিমাকে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়। প্রায় প্রতিদিনই বৈষ্ণবমতে বলি হয়।
এক সময় পাঁঠাবলি হলেও আজ তা উঠে গেছে। অষ্টমীতে ধুনো পড়ানো হয়। দেবীমুখ ঢেকে যায়, আমাদের জন্মজন্মান্তরের প্রিয়মুখ ভেসে ওঠে মনের মণিকোঠায়।
ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ি
একাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেনের কাছে নিপীড়িত কিছু পরিবারে চলে আসেন বর্ধমানের কাছে কর্জনা নগরে চলে আসেন। পরে এরা কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এই পরিবারগুলির ষোলজন প্রধানের অন্যতম ছিলেন শূলাপানি দত্ত। শূলাপানি দত্তের বেশ কয়েক প্রজন্ম পরে বংশীবদন দত্তের পুত্র ছিলেন দ্বারিকানাথ দত্ত। তৎকালীন সমাজের একজন পরিশ্রমী, উদার এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন দ্বারিকানাথ। দেবাশিষ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি ‘ গ্রন্থে ‘ ঠনঠনে দত্তবাড়ি’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন – “ ঠনঠনে দত্ত বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দ্বারিকানাথ জারডিন অ্যান্ড স্কিনারের সামান্য বেতনের কেরানি থেকে কোম্পানির বেনিয়া হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল প্রখর ব্যবসাবুদ্ধি। ডি এন দত্ত অ্যান্ড নেফিউ নামে বযবসায়িক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছিনলেন, তাঁর প্রধান কাজ ছিল ম্যাঞ্চেস্টার, ল্যাঙ্কারশায়ার প্রভৃতি জায়গা থেকে নানা ধরনের কাপড় আমদানি করা।
এক রাতে তিনি স্বপ্নে শিব অঙ্কে দুর্গারূপ দর্শন করেন। আনন্দে বিহ্বল হয়ে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। ১৮৫৫ সালে পুজো শুরু করেন তিনি। রাখী পূর্ণিমায় কাঠামো পুজোর পর জন্মাষ্টমী থেকে শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে। কারণ দত্ত বংশের পূর্বপুরুষরা নিত্যানন্দের বংশোদ্ভূত গোস্বামীদের শিষ্য ছিলেন। চালচিত্রে আঁকা থাকে দশভুজা ও তাঁর দশ অবতারের মূর্তি। প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত পুজো হয় ঘটে এবং ষষ্ঠীর রাত থেকে ঠাকুরদালানে পুজো শুরু হয়। প্রতিমাকে কোনও অন্নভোগ নিবেদন করা হয় না। লুচি,তরকারি,চাল,চিনি, মিষ্টি– ভোগ হিসাবে ঠাকুরকে পরিবেশন করা হয়।মহাষ্টমীর পুজোর পর হয় ‘ধুনো পুড়ানো’। এই অনুষ্ঠান কেবলমাত্র দীক্ষিত মহিলাদের জন্য। সন্ধিপুজোর সময় কুমড়োবলি হয়। নবমীর পুজোর পর ‘দক্ষিনান্ত’। কুমারী ও সধবা পুজো হয় নবমীতে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’- এ এই পুজোকে তৎকালীন তিনটি বিখ্যাত পুজোর অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন।
কলকাতায় আজও পুজো আসে সাদা মেঘের পাল উড়িয়ে। পুজো যখন যায়, দুর্গাদালানে নিভু নিভু হয়ে যে আলো জ্বলে তাই আমাদের অপেক্ষা। তখন সকলকে বলার পালা- দেখা হবে। তার আগে, হাতে যেটুকু সময়, এ শহরের পুজোটাকে একটু তলিয়ে দেখবেন না?