জঙ্গল পরিষ্কার করে শুরু দুর্গাপ্রতিমা বানানো, যেভাবে গড়ে উঠেছে আজকের কুমোরটুলি
কুমোরটুলির যোগাযোগ সরাসরি দুর্গাপুজোর সঙ্গে হলেও সেই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকে আজকের কুমোরটুলি করে তোলার পিছনে যাঁদের অবদান, তাঁদের কথা বেশিরভাগ মানুষ জানেন না।
কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি
কলকাতার কাছেও রয়েছে তার নিজের কুমোরপাড়া, যাকে মানুষ কুমারটুলি নামেই চেনে। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি ছাড়া কলকাতার দুর্গাপুজো আজও অসম্ভব বলে মনে হয়। সরস্বতী পুজো থেকেই বিভিন্ন কাজ শুরু হলেও মহালয়া থেকে দুর্গাপুজো অবধি কুমারটুলির ব্যস্ততা এক অন্য মাত্রা পায়। কুমোরটুলির বিচিত্র ইতিহাস, সারাদিনের বিভিন্ন সময় তার বিভিন্ন রূপ, কুমোরটুলিতে বসবাসকারী মৃৎশিল্পীদের জীবনের গল্প মিলিয়ে সে যেন পরিচিত জগতের মধ্যে অন্য এক জগৎ। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে গলিতে কয়লার উনুনের ধোঁয়া, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, কোথাও রেডিওতে বেজে চলা আকাশবাণী কলকাতার সম্প্রচার, মাটির গন্ধ, অল্প একটু জায়গায় একমনে কাজ করে চলা বয়স্ক মৃৎশিল্পী, ঘিঞ্জি গলির মধ্য দিয়ে কাঁধে করে মূর্তি নিয়ে যাওয়া মজুর এক ঝটকায় মানুষকে সেই জগতে টেনে নিতে পারে।
পলাশির যুদ্ধের সময় সুতানুটি এবং তার আশপাশের এলাকায় কলকাতার বেশিরভাগ জমিদার এবং বাবুরা বসবাস শুরু করেছিলেন। সেই সময় কলকাতায় বারোইয়ারি দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল না। শুধুমাত্র বাড়িতেই দুর্গাপুজোর আয়োজন হতো। দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগে নদিয়া জেলা থেকে মৃৎশিল্পীরা আসতেন। তারা সেইসব বাড়িতে গিয়ে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতেন এবং পুজো শেষ হলে নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতেন। সেই মৃৎশিল্পীদের মধ্যে কয়েকজন কাজের সুবিধের জন্য এই এলাকার একটা ছোট অংশে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। দুর্গাপুজোর সময় ছাড়া প্রতিমা তৈরির কাজ না থাকার কারণে তারা প্রথমে মাটির তৈরি বাজি বানাতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা পুজোর প্রচলন হয়। পুজোর প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে কুমোরটুলির জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করে। মৃৎশিল্পীদের বসবাস এবং কাজের জায়গা হওয়ার কারণে এই এলাকা সাধারণ মানুষের কাছে কুমোরটুলি নামে পরিচিত হয়। কুমোরটুলির প্রথম বাসিন্দাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ নদিয়া থেকে এলেও পরবর্তীকালে শেওড়াফুলি, ঢাকা থেকেও মৃৎশিল্পীরা আসতে শুরু করেছিলেন। তাদের মধ্যে বহু মৃৎশিল্পীর বংশধররা আজও কুমোরটুলিতে মূর্তি তৈরি করেন।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের জীবনের বিভিন্ন গল্প জানা যায়। তাদের মধ্যে কারও জন্ম কুমোরটুলিতেই, অনেকে কুমোরটুলির নাম শুনে কাজের খোঁজে এসেছিলেন। বর্তমানে বহু বয়স্ক মৃৎশিল্পী বলেন যে, তাঁদের অনেকেই অল্প বয়সে লম্ফের আলোয় দীর্ঘদিন প্রতিমা তৈরির কাজ করতেন। বহু বছর কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের এলাকায় শুধুমাত্র একটাই জলের কল ছিল। সেই কারণে স্নান এবং পানীয় জলের একটা সমস্যা ছিল। ঘিঞ্জি গলি, কাজ করার জন্য ছোট জায়গা, জলের অভাব, বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবের মধ্যে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এই মাটির জগৎ।
আরও পড়ুন: ২,৫০০ টাকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক চোখ ধাঁধিয়ে দিত, সেই কলকাতা ধরা আছে প্রবাদে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু সুবিধের পাশাপাশি বহু অসুবিধেরও সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পী নানা সম্মান পেয়েছেন। তাঁদের জন্য বিভিন্ন সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জল, বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হওয়ার পর কাজের কিছুটা সুবিধে হলেও বাঁশ, খড়ের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও শিল্পীদের খরচ বাড়ছে। বাসস্থান এবং কাজের জায়গার পরিসর একই থাকার কারণে সব সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। বর্তমানে কুমোরটুলিতে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনহাজার কারিগর থাকেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেক শিল্পী দুর্গাপুজোর সময় অন্য রাজ্যে কাজ করতে চলে যাচ্ছেন। ভিনরাজ্যের বিভিন্ন পুজোর আয়োজকরা কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার থেকে শিল্পীদের নিয়ে গিয়ে নিজেদের সময় এবং পছন্দমতো মূর্তি তৈরি করা শ্রেয় মনে করছেন। তাই কিছু শিল্পী বাড়তি আয়ের চেষ্টায় পুজোর সময় ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে থিমপুজোর চাহিদা বাড়ছে। তার ফলে সাবেকি ধরনের প্রতিমা বানানোর পরিবর্তে শিল্পীরা নিজেদের কাজের ধরনের পরিবর্তন করছেন। পুরুষ মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে মহিলা মৃৎশিল্পীরা পাল্লা দিয়ে প্রতিমা তৈরি করছেন। যদিও বহু মহিলা মৃৎশিল্পী তাঁদের কাজ শুরুর দিনে সমাজের কিছু মানুষের ব্যঙ্গ শুনতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাঁদের নাম তাঁদের কাজের সঙ্গেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
কুমোরটুলির যোগাযোগ সরাসরি দুর্গাপুজোর সঙ্গে হলেও সেই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকে আজকের কুমোরটুলি করে তোলার পিছনে যাঁদের অবদান, তাঁদের কথা বেশিরভাগ মানুষ জানেন না। বহু সুবিধে, অসুবিধেকে সঙ্গী করেই তাঁদের সংসার। তাঁদের নিজেদের আনন্দ, দুঃখ, গল্প, ঝগড়া সবকিছুর খবর এই ঘিঞ্জি গলিরা রাখে।