কয়েকশো বছর আগেই লুকিয়েছিল হিংসার বীজ! মণিপুর আদৌ কোনওদিন শান্ত হবে?
Manipur Violence 2023: ইনার লাইন পারমিট সিস্টেম চালু হলে যারা মণিপুরের বাসিন্দা নন তাদের মণিপুরে আসতে গেলে এক অতিরিক্ত অনুমতিপত্র করাতে হবে।
ভারতের সমস্ত ছোট রাজ্যগুলির থেকে মণিপুর কিছুটা হলেও আলাদা। এই রাজ্য খবরের শিরোনামে আসে ভারতীয় বক্সার মেরি কমের অনবদ্য কীর্তির জন্য, খবরে আসে জাতীয় স্তরে বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভের নানা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের জন্যও। দেশের উত্তরপূর্ব প্রান্তের মানুষের প্রতি জাতীয় স্তরে এখনও কী গভীর অবজ্ঞা আর অবহেলা রয়েছে, তা মণিপুরের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে বারবার। সাম্প্রতিক মণিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সেই একই অবজ্ঞা আর অবহেলারই ফসল। মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে ভারত সরকার আর্টিকেল ৩৫৫ ব্যবহার করে মণিপুরকে পুরোপুরিই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পর্বতে ঘেরা অঞ্চল হোক বা সমতল, পুরো মণিপুর জুড়েই গণপিটুনির খবর মিলছে। স্বভাবিকভাবেই মহিলা এবং শিশুদের অবস্থা শোচনীয়। জ্বলছে বাড়িঘর, পুড়ছে কৃষিক্ষেত্র। চলছে কার্ফিউ, ইন্টারনেট পরিষেবা রয়েছে বন্ধ, জারি হয়েছে দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ। কিন্তু কেন এমন উত্তাল পরিস্থিতি?
মনিপুরের এই হিংসার কথা জানতে হলে প্রথমেই মণিপুরের উপজাতিদের কথা জানতে হবে। এই হিংসা মূলত জাতি-উপজাতির বিরোধের জন্যই। মণিপুরের ৯০% অঞ্চল মূলত পর্বতে ঘেরা এবং মাত্র ১০% অঞ্চল রয়েছে সমতলের অন্তর্ভুক্ত। এই ৯০% অঞ্চলে মণিপুরের জনজাতিদের বসবাস। এই অঞ্চলে মূলত কুকি এবং নাগা জনজাতির মানুষই থাকেন। মণিপুরের জনসংখ্যার হিসেবে এই কুকি এবং নাগা জনজাতিদের অনুপাত মাত্র ৩৫ শতাংশ এবং এই জনজাতিরা মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। আর এই জনজাতিদের মধ্যেও রয়েছে একাধিক ছোট ছোট ভাগ, তার মধ্যে কিছু 'ট্রাইব'-কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, আবার কিছু 'ট্রাইব'-কে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, সমতলে বসবাস সংখ্যাগুরু মেইতি জনগোষ্ঠীর। সমস্যার শুরু এই মেইতি জনগোষ্ঠীকে জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। তাদের মূলত পাঙ্গাল বলা হয়। এই ৬৫% মানুষ মণিপুরের ১০ শতাংশ সমতল ভূমিতে বসবাস করেন। এই দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বহুদিন যাবৎ সমস্যা বর্তমান। তবে, বর্তমান হিংসার পিছনে মূলত দু'টি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ, জঙ্গল রক্ষা। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি সিদ্ধান্ত নেন। মণিপুর সরকারের তরফ থেকে, সেই রাজ্যের বনাঞ্চল রক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর ফলে কিছু আদিবাসীদের তাদের ঘর থেকে বিতাড়িত করতে হয় সরকারকে। মণিপুরের চোরাচাঁদপুর জেলার কে সংযং গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরের অতর্কিতে বুলডোজার চালিয়ে দেয় সেই রাজ্যের সরকার। গ্রামবাসীরা অভিযোগ জানান, কোনও নির্দেশ না দিয়েই তাদের ঘর ভেঙে দিয়েছে সরকার। কুকি পিপল অ্যালায়েন্স, যে দলটি বিজেপির একটি সহযোগী দল, সেটিও বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল। এই চোরাচাঁদপুর গ্রামের যে বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তারা ছিলেন মূলত কুকি জনজাতির মানুষ। এর ফলে সেই জেলায় একটি মিছিল হয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। এই মিছিলে শামিল হয়েছিলেন কুকি এবং নাগা জনজাতির মানুষরা। কিন্তু বিজেপি সরকারকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তারা দাবি করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যে বনদপ্তরের একটি সমীক্ষা হয় যাতে কিছু বিশেষ বিষয় উঠে আসে। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতেই মণিপুরের এই অঞ্চলটিকে 'রিজার্ভ ফরেস্ট' করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। এই সমীক্ষার মধ্যেই ওই জেলাটিও পড়ে তাই সেই জেলার বাসিন্দাদের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- নগ্ন নারীর প্রতিবাদের আগুন, কান ফেস্টিভ্যাল মনে করাল মণিপুরের কথা
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, এই মিছিল সম্পূর্ণরূপে আইনবিরোধী এবং গ্রামবাসীরা জঙ্গলের জমি বেআইনিভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছেন মাদকের ব্যবসার জন্য। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, এই জনজাতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন তিনি। এর পরেই জনজাতির নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ৮ ঘণ্টার বনধ্ ঘোষণা করেন চোরাচাঁদপুর জেলায়। বীরেন সিং সেই জেলায় একটি জিমের উদ্বোধন করতে এবং একটি জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলেন। কয়েকজন বিক্ষোভকারী সেই জিমে ঢুকে ভাঙচুর করেন এবং চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করেন। জনসভায় উপস্থিত বিশেষ অতিথিরা আহত হন এবং পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের। যার ফলে ৫ দিনের জন্য বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট পরিষেবা।
এছাড়াও একটা দ্বিতীয় কারণ রয়েছে এই হিংসার। মেইতি ইস্যু। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে, মেইতি জনগোষ্ঠীকে তপশিলি জনজাতির তকমা দেওয়ার সপক্ষে রায় ঘোষণা করে মণিপুর হাইকোর্ট। ২০১৩ থেকেই মেইতি জনগোষ্ঠী তপশিলি জনজাতিভুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিকে সংরক্ষণের জন্য এবং নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য মেইতিকেও তপশিলি জনজাতিভুক্ত করা উচিত। বাংলাদেশ এবং মায়ানমার থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করে মেইতি। কিন্তু নাগা এবং কুকি জনজাতির মানুষরা এই দাবির বিরোধিতা করেন। কিছু আদিবাসী ছাত্র সংগঠন সারা রাজ্যে বিক্ষোভের ডাক দেয়। নাগা এবং কুকি জনজাতির নেতারা দাবি রাখেন, এমনিতেই মণিপুরে মেইতি জনগোষ্ঠী বেশি শক্তিশালী এবং তাদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতাও অনেক বেশি। এবার যদি তারা তপশিলি জনজাতির তকমাও পেয়ে যান তাহলে নাগা এবং কুকি জনজাতির জন্য আর কিছু বাকি থাকবে না।
মণিপুর বিধানসভার ৬০ টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসন মেইতিদের হাতে রয়েছে। মাত্র ২০টা আসন রয়েছে জনজাতিদের হাতে। মেইতিদের কাছে যখন এতখানি রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে, তাহলে তাদের আবার তপশিলি জনজাতির তকমা কেন লাগবে? উপরন্তু, মেইতিদের কয়েকটি গোষ্ঠী ওবিসি এবং তপশিলি জাতিভুক্ত। তারা ইতিমধ্যেই সংরক্ষণের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আবার কেন সংরক্ষণ দরকার? পাশাপাশি, মেইতিদের ভাষা অর্থাৎ মণিপুরী ভাষাটি ভারতীয় সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত। তাই চাকরি পেতে অন্য জনজাতিদের অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়। যদি, মেইতিরা এই তপশিলি উপজাতির তকমাও যদি পেয়ে যান তাহলে একেবারেই মাঠে মারা যাবেন নাগা ও কুকি জনজাতির মানুষরা।
ফলে, একের পর এক মিছিল চলতে শুরু করে। তার মাঝেই গুজব রটে, মিছিলে নাকি এক আদিবাসী মহিলাকে আক্রমণ করেছে মেইতি বিক্ষোভকারীরা। আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন নাগা ও কুকি জনজাতিরাও। চোরাচাঁদপুর থেকে বিক্ষোভ শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রূপ নেয় হিংসাত্মক বিক্ষোভের। নামানো হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। দোকানে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। বিস্ফোরণের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সংবাদপত্রের শিরোনামে লেখা হয়, 'জ্বলছে মণিপুর'।
তবে মণিপুরে পাহাড় এবং সমতলের এই দ্বন্দ্ব বোঝার জন্য যেতে হবে আরও কয়েকশো বছর পিছনে। বছর দশেক আগে মণিপুরের কিছু পুরনো পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয় যেগুলিকে বলা হতো পুয়াশ। এই ধরনের পাণ্ডুলিপি মূলত লেখা হয়েছিল মেইতি জনগোষ্ঠীর ভাষায়। এই পাণ্ডুলিপিতে মেইতি ঋষিরা ধর্ম, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, ইতিহাস এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই সমস্ত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেই জানা যায় মণিপুরের মূল সভ্যতা শুরু হয়েছিল মেইতিদের হাত ধরে। যদিও তারা মণিপুরের আদি বাসিন্দা নয়। মায়ানমার থেকে তারা মণিপুরে আসে এবং তারপর সেখানেই তারা বসবাস করতে শুরু করে। তাদের হাত ধরেই শুরু হয় মেইতি রাজবংশ। অন্যদিকে, মণিপুরের আদিবাসী ছিল নাগা এবং কুকি জনজাতির মানুষরা, যারা মূলত বাস করত পাহাড়ি অঞ্চলে। এই রাজবংশ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমতল এবং পাহাড়ের মানুষের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়। মেইতি রাজারা রাজবংশ বিস্তারের জন্য নাগা এবং কুকি জনজাতির উপরে চাপ দিতে শুরু করেন। তবে এই দু'টি জনজাতির আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য ছিল। তাই কখনই মেইতিদের সঙ্গে নাগা এবং কুকিদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। মেইতি রাজারা মনে করতেন, সাম্রাজ্য বড় করতে হলে পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দাদের উপরে চাপ দিতে হবে যাতে তারা বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু সব সময় সম্পর্ক যে খারাপই ছিল তাও বলা যায় না। অনেক সময় রাজারা পাহাড়ি জনজাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছিলেন। বনাঞ্চলের জিনিসপত্র আদান-প্রদানের বিনিময়ে এই জনজাতিকে সুরক্ষা প্রদান করতেন রাজারা।
তবে এই পরিস্থিতি বদলে যায়, ১৮১৯-১৮২৫ সালের মধ্যে। এই সময় বর্মার রাজা মণিপুর আক্রমণ করেন এবং মেইতি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে পুরো মণিপুরের উপরে রাজত্ব কায়েম করেন। মণিপুরের পূর্ব বাসিন্দাদের উপরে চাপ দেওয়া হয়, যাতে তারা বর্মার বশ্যতা স্বীকার করে তাদের সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেন। পাহাড়ি জনজাতিগুলির উপরেও এভাবেই চাপ দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মিলিটারি ক্যাম্পেইন চালানো হয়, যার ফলে বহু গ্রামবাসী মারা যান এবং তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়। টানা ৭ বছর এই ধ্বংসলীলা চলে, যার কারণে এই সময়কালের নাম দেওয়া হয় 7 years of destruction। তবে ১৮২৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ জিতে মণিপুর নিজের দখলে নেয় ইংরেজরা। ইংরেজদের আসার সঙ্গে সঙ্গেই মণিপুরের আর্থিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। ১৮৩৫ সালে মণিপুরে ইংরেজরা একটি রাজনৈতিক 'এজেন্সি' তৈরি করেন এবং ১৮৯১ সালে এই এজেন্সিকে আরও বড় করে মণিপুরকে পুরোপুরি প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে ঘোষণা করেন। এই পলিটিক্যাল এজেন্সি এবং প্রিন্সলি স্টেটের মধ্যে একটা তফাত রয়েছে। প্রিন্সলি স্টেটের ক্ষেত্রে, রাজাকে নির্দেশ দেওয়া হতো তিনি যাতে নিজের রাজ্য সামলান এবং তার পরিবর্তে তাঁকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে হবে। অন্যদিকে, পলিটিক্যাল এজেন্সির ক্ষেত্রে, রাজাকে নির্দেশ করার জন্য একজন এজেন্ট বা রাজনৈতিক আধিকারিক পাঠানো হতো, যিনি হতেন আদতে রাজার উপদেশক। কিন্তু রাজার হাতে কোনও ক্ষমতা থাকত না। মণিপুরে এই রাজার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল মেইতিদের। অন্যদিকে, পাহাড়ি জনজাতিদের তেমন কোনও চাপ দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন- ফসল ফলিয়েও অপুষ্টিতে ভুগছে কৃষকদের সন্তানরাই! যেভাবে লড়ছে অসমের জনজাতিরা
কিছু বছর ভালো ভাবে কাটলেও এরপর ইংরেজরা নিয়ে আসে তাদের সবথেকে বিতর্কিত পলিসি, 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'। এই নীতিতে মেইতিদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া শুরু হয় এবং পাহাড়ি উপজাতিদের দমিয়ে রাখা শুরু করে ইংরেজরা। এর ফলে এই দুই জনজাতির মধ্যে ক্ষোভ শুরু হয়। এর সঙ্গেই মণিপুরে চালু করা হয় একটি জমি নীতি, যাতে উর্বর জমি দেওয়া হয় মেইতিদের এবং অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমি দেওয়া হয় পাহাড়ি জনজাতিগুলিকে। পাহাড়ি জনজাতির জমির সীমানা বেঁধে দেওয়ার ফলে তাদের সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রেও সমস্যা শুরু হয়। কুকি এবং নাগা জনজাতিদের নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি প্রসারের চেষ্টা করতেন। যেহেতু তাদের জমি একেবারে বেঁধে দেওয়া হল, এরপরে তারা নিজেদের সংস্কৃতি প্রসারের জায়গা আর পেলেন না। ফলে সেখানে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে মণিপুরে। এই সমস্যা ভারতের স্বাধীনতার পরেও একইভাবে থেকে গিয়েছিল।
তবে, এখানেই শেষ না। বড় 'ট্যুইস্ট' লুকিয়ে ছিল তখনও। ভারতের স্বাধীনতার পরেও মণিপুরে কিন্তু রাজতন্ত্রই ছিল। মণিপুরের শেষ রাজা ছিলেন রাজা বোধচন্দ্র সিং। স্বাধীনতার সময় রাজা বোধচন্দ্র সিংকে যেকোনও একটি দিক বেছে নিতে হতো। হয় তিনি মণিপুরকে স্বাধীন রাখতে পারতেন, অথবা পাকিস্তান বা ভারতের সঙ্গে যেতে পারতেন। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার পথ বেছে নিলেন। কিন্তু সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ভারতের জন্য। মণিপুর মূলত অবস্থিত চিন এবং মায়ানমার সীমান্তে। এর ফলে মণিপুরে চিন এবং মায়ানমারের একটা আধিপত্য ছিল প্রথম থেকেই। এই যদি থেকে যায় তাহলে ভারতের পরবর্তীতে সমস্যা হবেই। অন্যদিকে, মণিপুরে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল যা ভারতের রাজনীতির উপরে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। সেই কারণেই ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মণিপুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভারত তা করেও।
১৯৪৯ সালে মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যার মাধ্যমে মণিপুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। তবে এর আগেই মণিপুরের রাজার বিরুদ্ধে অনেকে আন্দোলন করতে শুরু করেছেন যে, স্বাধীন হলেও মণিপুরে রাজতন্ত্র চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই কারণে মণিপুরের রাজার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই হাতে অস্ত্র ছিল ভারত সরকারের কাছে। শোনা যায়, মণিপুরের রাজা যখন অসমের রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সেই সময় ভারত সরকারের তরফ থেকে তাঁকে গৃহবন্দি করে দেওয়া হয় এবং চাপ দেওয়া হয় যাতে তিনি এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গেই মণিপুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং মণিপুরে চলতে থাকা কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভারত।
তবে একটা সমস্যা উঠে আসে। মণিপুরে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ রয়েছেন যারা বিভিন্ন কিছু চাইছেন। প্রথমত, মণিপুরে যারা নাগা উপজাতি ছিলেন, তারা চাইছিলেন মণিপুর, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশের যে অংশে নাগা জনজাতির বসবাস বেশি, তা যেন নাগাল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে, কুকি জনজাতির মানুষরা নিজেদের জন্য আলাদা দেশ চাইছিলেন। কুকিদের দাবি ছিল ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের যে জায়গায় কুকি জনজাতির বসবাস, সেসব মিলিয়ে একটা আলাদা দেশ তৈরি করে দেওয়া হোক। কুকিদের দরকার ছিল কুকিল্যান্ড এবং নাগাদের দাবি ছিল নাগালিম। অন্যদিকে, মেইতি কোনওটির দাবিই করেনি। তাদের দাবি ছিল, পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে কুকি এবং নাগা জনজাতির বসবাস সেটাও যেন মণিপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মেইতিরা দাবি করেছিল, মণিপুরে যেন তাদের আধিপত্য বিস্তার হয়। এজন্য ভারত সরকার এমন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যাতে কেউই তেমন খুশি হলেন না। মণিপুরের মেইতিদের হাত থেকে তপশিলি উপজাতির তকমা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অন্যদিকে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, পাহাড়ি অঞ্চলে তারা জমি কিনতে পারবে না। অন্যদিকে, উপজাতির তকমা পায় কুকি এবং নাগারা। কিন্তু তাতে সমস্ত সমস্যার সমাধান হলো না।
১৯৭২ সালে মণিপুরকে পৃথক রাজ্যের তকমা দেওয়া হয় এবং এই বছর এই রাজ্যে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরের ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসন রয়েছে মেইতি অধ্যুষিত সমতল অঞ্চলে এবং মাত্র ২০টি আসন রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। এর ফলে মেইতিদের পক্ষে নির্বাচন জেতা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। সেই কারণে মণিপুরের অনেক মুখ্যমন্ত্রীই মেইতি জনগোষ্ঠীর। অনেক সময় আবার, মেইতি নেতারা পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দাদের শরণার্থীও বলে থাকেন। মেইতিরা যে ভাষা ব্যবহার করেন অর্থাৎ মৈথিলান ভাষা, সেই ভাষাটি মূলত বাংলা হরফে লেখা। ভারতীয় সংবিধানে এই ভাষাটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত মণিপুরের প্রত্যেকটি স্কুলে এই ভাষা পড়ানো হয়। কিন্তু, সরকারের এই সিদ্ধান্তে মণিপুরের উপজাতির মানুষরা খুব একটা খুশি হননি কারণ তাদের ধারণা, তাদের নিজস্ব ভাষাকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকার বাংলা হরফে লেখা এই ভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
কিন্তু বিগত কয়েক বছরে মেইতিদের জনসংখ্যা মণিপুরে ৬০ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। বেআইনি অনুপ্রবেশের কারণে বাংলাদেশ এবং মায়ানমার থেকে বহু মানুষ মণিপুরে প্রবেশ করেন। তাদের কারণে মণিপুরে মেইতিদের থাকতেই সমস্যা হচ্ছে। মেইতিরা পাহাড়ি অঞ্চলে জমি কিনতে পারেন না, কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলের লোক সমতলে জমি কিনতে পারেন। এর ফলে মেইতি জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে সমতলে। তাই মেইতি মণিপুরে 'ইনার লাইন পারমিট সিস্টেম' চালু করতে চাইছে, যেটি অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড এবং মিজোরামের মতো রাজ্যে রয়েছে।
আরও পড়ুন- কেন আজও আদিবাসীদের ‘ভগবান’ বিরসা মুন্ডা, জেদেই ঘুম উড়িয়েছিলেন ব্রিটিশদের
এই ইনার লাইন পারমিট সিস্টেম চালু হলে যারা মণিপুরের বাসিন্দা নন তাদের মণিপুরে আসতে গেলে এক অতিরিক্ত অনুমতিপত্র করাতে হবে। এই অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদেরকেও মণিপুর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। মনে হতে পারে যে কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠী এই নীতিকে গ্রহণ করবে ভালোভাবেই। কিন্তু, তারা এই নীতি কোনওভাবেই গ্রহণ করেনি আজ অবধি। কুকি এবং নাগা উপজাতির নেতারা মনে করেন যদি এই পারমিট সিস্টেম চালু হয়ে যায় তাহলে তাকে উপজাতিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে মেইতিরা। বারংবার মণিপুরের মেইতিরা এই বিষয়টি নিয়ে একটি আইন তৈরি করতে চেয়েছে কিন্তু ভারত সরকার এবং ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিকবার এই আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন।
তাই এবার মেইতিদের দাবি, যেন তাদেরকে তপশিলি উপজাতির তকমা দেওয়া হয়, যা তাদের কাছে ১৯৪৯ সালের আগে ছিল। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না। মণিপুরে পাহাড়ি উপজাতি এবং সমতলের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। আর এই সমস্যার কারণেই মণিপুরে শুরু হয়েছে এক বেআইনি কর গ্রহণের ব্যবসা।
মণিপুরে দু'টি জাতীয় সড়ক রয়েছে, ২ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক, যার মাধ্যমে মণিপুর ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যুক্ত। যে জাতীয় সড়কের সামনে যে জনগোষ্ঠীর প্রভাব বেশি, তারা ওই রাস্তায় চলা গাড়ি থেকে অতিরিক্ত বেআইনি কর গ্রহণ করে। মণিপুরে কোনও জিনিস আনতে হলে অথবা মণিপুর থেকে কোনও জিনিস বাইরে নিয়ে যেতে হলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। আর এই টাকা সরাসরি চলে যায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরির তহবিলে। এই ধরনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী সবথেকে বেশি রয়েছে কুকি জনজাতির মধ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, কুকি ন্যাশনাল আর্মি, কুকি কমান্ডো কুকি, কুকি ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি, চিন-কুকি রিভলিউশনারি ফোর্স ও কুকি ইনডিপেনডেন্স ফোর্স। নাগারও আলাদা বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে, যেমন, NSCI (IM)। তবে নাগা এবং কুকি গোষ্ঠীর মধ্যেও কিন্তু এর আগে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। যেমন, ১৯৯০ সালে NSCI (IM) কুকিদের আক্রমণ করেছিল, যাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়।
এই সংঘর্ষের মূল অনেক গভীরে হলেও, এই দ্বন্দ্ব থামানো এত সহজ বিষয় নয়। ভারত সরকার যদি এই দু'টি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো করতে পারে তাহলে মণিপুরের এই হিংসা থামতেও পারে। হিংসা থামার একমাত্র উপায় অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা। প্রাচীনকাল থেকে যে বিভেদ গড়ে তোলা হয়েছে তাতে স্থিতাবস্থা আনবে কোন মন্ত্র, তা সম্ভবত সরকারেরও অজানা।