বারবার হার মেনেছে ব্রিটিশরা || কেন ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল বাংলার এই রাজবংশের নাম?
পঞ্চকোট। মানভূম সভ্যতা সৃষ্টির অন্যতম কান্ডারি। মানভূম-পুরুলিয়ার ঝালদায় আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় এই রাজবংশ। ঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় এবং কাশীপুর- সর্বমোট এই সাতটি রাজধানী থেকে পঞ্চকোটের রাজারা রাজত্ব শাসন করতেন। এই রাজবংশকে 'শিখরভূম রাজবংশ'-ও বলা হয়।মানভূমের সভ্যতা সৃষ্টিতে এই রাজবংশ অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই বংশ ছিল অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও প্রজাবৎসল রাজবংশ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা দামোদর শেখর। রাজা দামোদর শেখর ঝালদায় রাজধানীর নাম গড়পঞ্চকোট রাখেন, কারণ এটির একটি অর্থ ছিল- 'গড়' অর্থাৎ 'কেল্লা', 'পঞ্চ' অর্থাৎ 'পাঁচ', 'কোট' অর্থাৎ 'গোষ্ঠী'। রাজার উত্তরসূরিরা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি মন্দির স্থাপন করেন এই এলাকায়। এই মন্দিরগুলি কোনওটি পাথরের, আবার কোনওটি পোড়ামাটির তৈরি।
পঞ্চকোট রাজবংশের একটি কিংবদন্তি আছে। রাজা জগৎদেও তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছিল। পথে পড়ল ঝালদা। এই ঝালদার তৎকালীন রাজা ছিলেন মহারাজ জগদেও সিং-এর বন্ধুপ্রবর। তিনি সস্ত্রীক ঝালদার রাজার আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। সেখানেই তাঁর একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্মাল। মহারানি ও রাজা জগৎদেও সিং তাঁদের এই শিশুসন্তানটিকে ঝালদার মহারাজের তত্ত্বাবধানে রেখে শ্রীক্ষেত্রে তীর্থ করতে চলে গেলেন। এই শিশুটিই পরবর্তীতে দিকপাল মহারাজা 'দামোদর শেখর'। সাতটি রাজধানীর মধ্যে কাশীপুরেই এই বংশ রাজত্ব করে দীর্ঘকাল। কাশীপুরে এই বংশের সাতজন রাজা রাজত্ব করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো, নীলমণি সিং দেও ও জ্যোতিপ্রকাশ সিং দেও।
কথিত আছে মধ্যপ্রদেশের 'ধার' (ধাবানগর) থেকে পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা এসেছিলেন পুরুলিয়ার মানভূমে। ধর্ম আন্দোলন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক শিক্ষা, জেলার বিভিন্ন স্থানে ২২টি জনপদ নির্মাণ, মন্দির-স্থাপত্য-শিল্পের প্রসার, দেশপ্রেমিক প্রজাদের নিষ্কর মৌজা বিতরণ এবং প্রজাদের সঙ্গে রাজপরিবারের আত্মিক সম্পর্ক রাজপরিবারটিকে এক অনন্য বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। প্রজাদের ও রাজপরিবারের সম্পর্ক এত ভালো ছিল, যা সাধারণত দেখা যায় না। ২০০০ বছরের শাসনকালে একবারও প্রজাবিদ্রোহ হয়নি এবং রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, যে কোনও বিপদে প্রজারা রাজপরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে এটাই প্রমাণ হয়, পঞ্চকোট রাজবংশ কতটা প্রজাবৎসল ছিল!
আরও পড়ুন: স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দেওয়া সতী নাকি নিখোঁজ রাজকন্যা! ভাদু আসলে কে
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ধানবাদ, রাঁচি ও বোকারোর প্রায় ২,৭৭৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এবং কটকের কিয়দংশ (ডালিজোড়া) ও বারানসিতেও রাজ্য বিস্তার করেছিল পঞ্চকোট রাজবংশ। বারাণসিতে গঙ্গাতীরে এখনও 'পঞ্চকোট ঘাট' বিদ্যমান। পঞ্চকোট রাজাদের রাজত্বকালে সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা ইত্যাদি বিভিন্ন জনজাতির প্রজারা নিঃসংকোচে এবং নির্ভয়ে তাঁদের জীবনযাপন, ধর্মপালন ও উৎসব-অনুষ্ঠান করে গেছেন, এক্ষেত্রে রাজদণ্ড কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাজপরিবার পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী হয়েছিল। কিন্তু নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দীতে এখানে জৈনধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। রঘুনাথ, মদনমোহন, টেরাকোটার মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শ্যামরঘুবর এবং এছাড়া চারচালা, আটচালা প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মন্দিরের পাশাপাশি জৈন মন্দিরও পরিলক্ষিত হয়।
১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চকোটে বৈষ্ণবভাব স্থায়ী হয় এবং এর ফলে সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম, স্থাপত্য, ভাস্কর্যে পর্যন্ত বৈষ্ণবীয় প্রভাব পড়ে। একসময় কাশীপুরের রাজসভাকে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হত। ঝুমুর সম্রাট ভবপ্রীতানন্দ ওঝা রাজসভায় সমাদৃত হয়েছিলেন। মহারাজা জ্যোতিপ্রকাশ দেওঘরে কবির জন্য ভবন নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। পঞ্চকোট রাজপরিবার শিল্পী এবং শিল্পের সমাদর করতেন। কবি মধুসূদন দত্ত একসময় এখানে সেরেস্তায় কর্মরত ছিলেন। এখানে বসে তিনি ছ'টি সনেট রচনা করেন। জীবনসায়াহ্নে কবি কাশীপুরে মহারাজা নীলমণি সিংয়ের রাজদরবারে ছিলেন। নীলমণি সিংয়ের সভাগায়ক ছিলেন 'যদুভট্ট' এবং তাঁর পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্য। মহারাজা নীলমণি সিং যদুভট্টকে 'রঙ্গনাথ' উপাধি প্রদান করেন।
এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বললে দু'জনের নাম বলতে হয়। নীলমণি সিং দেও এবং জ্যোতিপ্রকাশ সিং দেও। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে নীলমণি সিং জন্মগ্রহণ করেন কেশরগড়ে। কিন্তু নাবালক পুত্র নীলমণি সিংয়ের প্রানসংশয় দেখা দিলে, তাঁর 'মা' (তৎকালীন রাজমাতা) রাজধানী কাশীপুরে স্থানান্তরিত করেন। নীলমণি সিং ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও তিনি পিছপা হননি। ১৭৯৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘরে সময়মতো খাজনা না পৌঁছনোর ফলে পঞ্চকোট রাজ্য নিলামে ওঠে। প্রজারা ঘোষণা করে, পঞ্চকোট রাজা ছাড়া কাউকে তারা খাজনা দেবে না। শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হার মানে।১৭৯৯ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল স্বয়ং মহারাজা নীলমণি সিংয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। ইতিহাসে এই ঘটনা 'চুয়াড়' বিদ্রোহ নামে খ্যাত।
মহারাজা নীলমণি সিংয়ের তত্ত্বাবধানে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারের কাছারি লুঠ হয়েছিল এবং ৬৩ জন কয়েদিকে তিনি জেল ভেঙে মুক্ত করেছিলেন। এর ফলে মহারাজাকে বন্দি হতে হয়েছিল। তিনি কলকাতার আলিপুর জেলে বন্দি ছিলেন। মহারাজা নীলমণি সিংয়ের উত্তরাধিকার দেখা যায় তাঁর পৌত্র (পুত্রের পুত্র) জ্যোতিপ্রকাশের মধ্যে। ১৯১৬ সালে মহারাজা জ্যোতিপ্রকাশ একটি প্রাসাদ তৈরি করান।নামকরন করেন 'জ্যোতিবিলাস'। এই প্রাসাদ তৈরি করতে তিনি চিন দেশ থেকে কারিগর আনান। একটানা ১২ বছর ধরে চলেছিল এই নির্মাণকাজ। এই প্রাসাদের অভ্যন্তরে, রাজদরবারে আছে বেলজিয়াম থেকে আনানো একটি বিশালাকার ঝাড়লন্ঠন।
জনপদ সৃষ্টি, জাতি ও জনজাতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পঞ্চকোট রাজবংশের নাম শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু আমাদের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় এই তথ্য যে, কল্যাণেশ্বরী, আসানসোল, হিরাপুর, গড়পঞ্চকোট, রঘুনাথপুর, আদৃতা, পুরুলিয়া প্রভৃতি ২২টি জনপদ এই পঞ্চকোট বংশের সৃষ্টি।