‘পেটচুক্তি’ খাওয়া, কলকাতার এই পাইস হোটেলগুলিতে জেগে স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প
Pice hotel: বাঙালি খানার আসল স্বাদ নিয়ে আজও বহাল কলকাতার পাইস হোটেলগুলি
ছাপোষা কোনো পুরনো বাড়ি, চুন খসা দেওয়াল, করিকাঠের ছাদ অথবা ধোপদুরস্ত আসবাব। ‘পাইস হোটেল’ শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই ছবিটাই। মোট কথা, একটা ঐতিহ্যের গন্ধ রয়েছে পাইস হোটেলের অন্দরে। হোটেলের আগে ‘পাইস’ শব্দটি কেন বসল তার কোনও প্রামাণ্য পাওয়া যায় না। এমনকী ঠিক কবে কীভাবে এমন একটা নাম জাঁকিয়ে বসলো বাঙালির অভ্যাসে সেটিও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দু বাঙালির মধ্যে এক ধরনের চাকরি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাড়ি থেকে দূরে কলকাতায় এসে চাকরির সুবাদে তখন কম পয়সায় খাবারের দোকানের চাহিদা বাড়তে থাকে। আর এই চাহিদা থেকেই একটা একটা করে গজিয়ে উঠতে থাকে হিন্দু হোটেল ওরফে পাইস হোটেল। কেউ কেউ বলেন সস্তা বা কম পয়সার হোটেল থেকে অপভ্রংশ হয়েই ‘পাইস’ কথাটা এসেছে। তবে এই মত নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ কেউ বলেন, এক পয়সার বিনিময়ে ভাত, ডাল, তরকারির ‘পেটচুক্তি’ খাওয়া থেকেই এসেছে এরূপ নামকরণ। ইংরেজ আমলে পয়সাকে বলা হতো পাইস, আজকের সঙ্গে সেই সময়ের হিসেব অবশ্য মিলবে না। সেই সময় এক পয়সার মূল্যও ছিল ঢের। তাই পাইস হোটেলে এক পয়সায় পেটচুক্তি অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না পেট ভরছে ততক্ষণ ভাত-ডাল-নিরামিষ তরকারি যতবার খুশি নিখরচায় নেওয়ার রেওয়াজ প্রচলন ছিল সেকালে। আর এতেই এক বেলার খাবার দিব্যি চুকে যেত বাঙালিদের।
আধুনিক সময়ের টানাপোড়েনে সেকেলে সেই দামের হিসেব অনেকটা বদলালেও হোটেলের চেহারা বদলাইনি। এখনও কলকাতার পাইস হোটেলগুলোতে ঢুঁ মারলেই শুরু হয়ে টাইম ট্রাভেল। নিমেষে একটা পিছুটান পা চেপে ধরে। দোকানের খাবারে মায়ের হাতের সেই স্বাদ এখনও অটুট। খোদ কলকাতাতে এত আধুনিকতার ভিড়েও আছে এরকম বেশ কয়েকটি পাইস হোটেল। যেখানে অতীতের থেকে খাবারের দাম খানিকটা বাড়লেও অতিরিক্ত ভাত, ডাল, লেবু এখনও বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - বিরিয়ানি, ইলিশ পাতুরি নয়, ২০২২-এ বিশ্বের সেরা ভারতীয় খাবারের নাম চমকে দেবেই
জগন্মাতা ভোজনালয় - খোদ উত্তর কলকাতার দেড়শ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান এটি। ঠিকানা, ৪০ নম্বর কৈলাস বোস স্ট্রিট। বিবেকানন্দ রোড ধরে এসে, বিধান সরনির মোড় হয়ে শ্রীমানি মার্কেটের দিকে একটু এগোলেই বাঁ-হাতি রাস্তা। দোকানে ঢুকতেই দেখা যাবে বড়ো একটা সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি ওড়িয়াতে লেখা রয়েছে ‘জগন্মাতা হোটেল’। কলকাতার বুকে ওড়িয়া ভাষার ব্যবহার বিরলই বটে। সরকারকে ওড়িশা থেকে এক বাঙালি কলকাতায় এসে খুলেছিলেন খাবারে ব্যবসা। মালিকের নাম ছিল বিকলচন্দ্র দাস। তার পর থেকেই বংশপম্পরায় চলছে এই হোটেল। বর্তমান মালিক গঙ্গাধর দাস।রোজ দিন বেলা ১০টা থেকে রাত ৯টা অবধি খোলা থাকে দোকান। রান্নার ভার এখনও রয়েছে ওড়িয়া রাঁধুনিদের হাতেই আছে। এই হোটেলে রকমারী মাছের পদের আধিক্য। মেনুতে রুই, কাতলা থেকে শুরু করে ইলিশ, বাটা, ট্যাংরা, চিংড়ি, পার্সে, কই, মাগুর, পমফ্রেট, পাবদা, চিতল, শোল, কাঁকড়াও আছে। তবে এ দোকানের আসল ইউ এস পি হল পাঁঠার মাংস। বৃহস্পতি বাদে সপ্তাহের ছয়দিন এখানে কচি পাঁঠার টানে খদ্দেরের ভিড় উপচে পড়ে। তবে মুরগীর মাংস ও ডিম পাওয়া যায় না জগন্মাতায়।
সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম - কলকাতার পাইস হোটেল বলতে আমরা যে সেকেলে ছবিটাকে কল্পনা করে নিতে পারি তার ব্যতিক্রম এই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। ১৯ নম্বর মির্জা গালিব স্ট্রিটের এই বাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে চাকচিক্যহীন তবে সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে গেলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। কলকাতায় এই হোটেলের পথ চলা শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। সেই থেকেই বাঙালি খাবারের স্বাদ মন ভোলাচ্ছে কলকাতাবাসীকে। আধুনিকতার সঙ্গে খানিক পাল্লা দিতে চাকচিক্য এসেছে, তবে পরম্পরায় আঁচ লাগতে দেননি কমকর্তারা। ঐতিহ্য মেনে এখনও মেনুতে রয়েছে পুরনো স্বদের আলু পোস্ত, পোস্তের বড়া, মোচা চিংড়ি, মুড়ি ঘন্ট, রুই ভাপা, কালিয়া, গলদা চিংড়ি, মাটন কারি, চিকেন কারি সবই।প্রতিদিন বেলা ৯টা থেকে ৩.৩০ এবং সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১০.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানটি।
স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল - কলকাতার পাইস হোটেল মানচিত্রে এই হোটেলের নাম থাকবে সবার উপরে। আসলে এই হোটেলের নামটাই কাফি — ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’। স্বাধীনতার আগে ১৯২৭ সালে পথ চলা শুরু হয় দোকানটির। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পাশের রাস্তাটি চিরকালই বিপ্লবের আঁতুড়ঘর, তাই সেসময়ে এই দোকানটিও ছিল বিপ্লবীদের আখড়া। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ের দাগ যেন এখনও বহন করে চলেছে দোকানটি। আগে নাম ছিল শুধু হিন্দু হোটেল তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর হোটেলের নাম বদলে রাখা হয় ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’। যেন ইতিহাসের সরণি বেয়ে হাঁটা এই দীর্ঘ যাত্রাপথ। দোকানের দেওয়ালে এখনও লেগে রয়েছে বীরযোদ্ধাদের রোমহষর্ক কাহিনী। কলাপাতায় ভাত এখনকার আসল মাহাত্ম্য। তবে কলা পাতার জন্যে বাড়তি পয়সা লাগে। এদের নানা ধরণের খাবারের মধ্যে মাছের মাথা দেওয়া ছ্যাঁচড়া, তোপসে ফ্রাই, মাছের ডিমের বড়া, খাসির মাংসের সুনাম আছে।
আরও পড়ুন - বাংলার ভাঁড়ার শূন্য, ২০২২ সালের জিআই ট্যাগ পেয়েছে এই সব রাজ্যের বিখ্যাত যে খাবারগুলি
তরুণ নিকেতন - রাসবিহারী মোড় থেকে মাত্র দুই মিনিট হাঁটলেই শতাব্দী প্রাচীন এই দোকানটি। হোটেলের মালিক নিজের নানেই এ দোকানের নাম রেখেছিলেন তরুণ নিকেতন। প্রথমে মাটিতে বসে কলাপাতায় ভাত খাওয়াই এখানকার রেওয়াজ ছিল। এখনও সেই কলাপাতাতেই পরিবেশন করা হয় ভাত। তবে চেয়ার টেবিল এসেছে ১৯৭৫ সালে। ডাল, সবজি, ভাজা, শাক, হাঁসের ডিম, চিকেন, মাটন, মোচার ঘণ্ট, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক আরও কত কিই না রয়েছে মেনুতে। তবে আসল আকর্ষণ বাহারি মাছের পদ। প্রতিদিন প্রায় দশ থেকে বারোরকম মাছের মেলে এখানে। ইলিশ, পাবদা, চিংড়ি, ভেটকি, চিতল, কই, রুই, কাতলা, তেলাপিয়া তো পাবেনই; ইচ্ছা করলে পেতে পারেন আর কিংবা বোয়াল মাছ। ইলিশের তেল ভাজাও হয় বর্ষায়। ভেটকি পাতুরি থেকে পুঁটি মাছের চাটনিও পেয়ে যাবেন।
ইয়ং বেঙ্গল হোটেল - আধুনিকতায় পাল্লা দিয়ে যখন সমাজ অনেকটা উঠতি পথে তখনও প্রাচীনত্ব আঁকড়ে ইয়ং বেঙ্গল। এখানে আজও মাটির উনুনে ঘানির তেলে রান্না হয়, সম্পূর্ণ বাটা মশলায় রান্না করা হয়। খেতে দেওয়া হয়, কলাপাতায়। তার সঙ্গে মাটির ভাঁড়ে হল। যেন নিমেষে বাঁধা পড়ে যেতে হয় প্রাচীনত্বের টানে। খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটের কাছে গিয়ে খোঁজ করলেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে শতাব্দী প্রাচীন হোটেলটি। এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারাপদ গুহরায়। বিউলির ডাল, আলু-পোস্ত, উচ্ছে-ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি, কচু শাক, মুড়িঘণ্ট, মোচার কোপ্তা, ডালের বড়ার ঝাল, কাঁচকলার কোপ্তার, মাটন কষা, চিকেন কষা, বাহারি মাছ থেকে শীতকালের স্পেশাল পঞ্চরত্ন সবই যেন এক্কেবারে লা জবাব!
এছাড়াও,জগন্নাথ ভোজনালয়, মহল, কমলা হোটেল সহ আরও অসংখ্য পাইস হোটেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কলকাতা শহরের আনাচে কানাচে। নাম, স্থান, গঠন অথবা স্বাদের তফাৎ থাকলেও ঐতিহ্যের সফরে সকলেই সওয়ার। তাই কলকাতার খাবারের জার্নিতে হাল আমলের ক্যাফে রেস্তোরাঁর পাশেই সবেকিয়নার ঠাঁই একইরকম অটুট।