ডালে দোল খাওয়া বালিকাই আসলে কালী! কিংবদন্তি কথা বলে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের মন্দিরে
Sabarna Roychowdhury: বাংলায় প্রায় ১২টি কালীমন্দির রয়েছে সাবর্ণদের। এই মন্দিরগুলির প্রায় সবক'টির সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রয়েছে পরিবারের।
কল্লোলিনী কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কথা। আদি কলকাতা সহ তিনটি গ্রাম জোব চার্ণকের জামাতা চার্লস আয়ারকে ইজারা দেওয়ার কথা বা রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোর কথা আজ প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু সাবর্ণদের পরিবারের সঙ্গে কালীপুজোর নিবিড় সম্পর্কের কথা অনেকেরই অজানা। এমনকী, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কুলদেবী হলেন কালীঘাটের কালী। হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এবং সতীপীঠগুলির মধ্যে অন্যতম একটি কালীঘাটের কালীমন্দির। বলাই বাহুল্য যে, কালীঘাটের মা কালীর সঙ্গে রায়চৌধুরী পরিবারের এক বিশেষ যোগাযোগ রয়েছে। শুধু কালীঘাট নয়, কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণজুড়েই নানা কালীমন্দির রয়েছে এই পরিবারের। বাংলায় প্রায় ১২টি কালীমন্দির রয়েছে সাবর্ণদের। এই মন্দিরগুলির প্রায় সবক'টির সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রয়েছে পরিবারের।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ও কালীঘাটের মা কালী
লক্ষ্মীকান্তর পিতা জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কামদেব ব্রহ্মচারী এবং তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী দেবী হালিশহর থেকে কালিক্ষেত্রে এসেছিলেন সন্তানলাভের আশায়। লক্ষ্মীপুজোর দিন পদ্মাবতী দেবী একটি সন্তানের জন্ম দেন, নাম রাখেন লক্ষ্মীকান্ত। এই লক্ষ্মীকান্তই পরবর্তীকালে মানসিংহ প্রতাপাদিত্যর থেকে জমিদারি লাভ করেন। তবে সন্তান প্রসব করার তিনদিন পরেই পদ্মাবতী দেবীর মৃত্যু হয়। স্ত্রী-র অবর্তমানে দুধের শিশুকে কীভাবে মানুষ করবেন, তা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কামদেবের কাছে। পরে এক শাবক টিকটিকির আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বর সবাইকেই রক্ষা করেন। এরপর লক্ষ্মীকান্তর বুকে একটি শ্লোক লিখে কামদেব মহাতপস্যার জন্য সোমনাথ মন্দিরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হন। কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত আত্মারাম ঠাকুরের কাছেই মানুষ হন লক্ষ্মীকান্ত।
আরও পড়ুন: কখনও প্রলয়ঙ্করী, কখনও কল্যাণময়ী! বিভিন্ন রূপে পাল্টে যায় কালীর অবতার
পুজোপাঠ থেকে শুরু করে পারসিক, সংস্কৃত, বাংলা ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্রর পাঠ সবেতেই লক্ষ্মীকান্তকে পারদর্শী করেন তোলেন তিনি। কালীঘাট পুণ্য পীঠস্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মূলে ছিলেন এই আত্মারাম ঠাকুর। আত্মরামের হাতেই লক্ষ্মীকান্তর উপনয়ন আয়োজিত হয়। রায়চৌধুরী পরিবারের কুলগুরুও ছিলেন এই আত্মারাম ঠাকুর। পরবর্তীকালে ১৬০৮ সালে মানসিংহের থেকে জমিদারি পেলে কালীঘাটের মন্দিরে মায়ের সেবার জন্য ৫৯৫ বিঘা জমি দান করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। রায়চৌধুরী পরিবারের বংশধর শুভদীপ রায়চৌধুরীর কথায়, "১৮০৯ সালে কালীঘাটের মন্দির সংস্কার করেন সন্তোষ রায়চৌধুরী এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র রাজীবলোচন রায়চৌধুরী। এখন যে মন্দির কালীঘাটে দেখা যায় সেটি সন্তোষ রায়চৌধুরীর হাতেই তৈরি হওয়া।" তিনি আরও জানান, "কালীপুজোর রাতে আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। যেহেতু কালীঘাটের মন্দিরে আমাদের বংশের কুলদেবী রয়েছেন, তাই কালীপুজোর দিন সেখানেও দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করা হয়। অর্থাৎ, ধনলক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। বাকি সব মন্দিরে কালীপুজোর আয়োজন হলেও কালীঘাটের মন্দিরে কিন্তু তা হয় না। এটাও সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারেরই রীতি। আমাদের বাড়িতে কালীপুজো করা নিষিদ্ধ কেবলমাত্র মেদিনীপুরের বাড়িতেই কালীপুজো হয়, তাছাড়া বাকি যেসব স্থানে রায়চৌধুরী পরিবারের বসতি রয়েছে, সব বাড়িতেই লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করা হয় কালীপুজোর রাতে।" রায়চৌধুরী পরিবারের ধারা বজায় রেখেই আজও কালীঘাটে দক্ষিণাকালী পূজিত হন।
করুণাময়ী কালীমন্দির
কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর মোড় থেকে যে রাস্তা প্রাচীন আদিগঙ্গা, সাধারণের কাছে ‘টালি নালা’ নামে পরিচিত। এখানেই হরিদেবপুরে রয়েছে করুণাময়ী কালীমন্দির। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন নন্দদুলাল রায়চৌধুরী।
নন্দদুলালের পর পর তিনটি পুত্রসন্তান হয়েছিল– রাঘবেন্দ্র, রামচরণ ও জগন্নাথ। তিন পুত্রসন্তানের পর নন্দদুলালের খুব ইচ্ছা ছিল একটি কন্যাসন্তানের। তাঁর ইচ্ছেমতো একটি কন্যাসন্তানের জন্মও হয়, নাম রাখেন করুণাময়ী। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে করুণাময়ীর অকালপ্রয়াণ ঘটে। কন্যার মৃত্যুতে নন্দদুলাল ভেঙে পড়েন। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত নন্দদুলাল একদিন রাতে স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর মৃত কন্যা করুণাময়ী তাঁকে বলছে– “বাবা তুমি কেঁদো না, আমি তোমায় কোনোদিনই ছেড়ে যেতে পারব না। কাল ভোরে তুমি আদিগঙ্গার ঘাটে গিয়ে একটা বটগাছের তলায় একটি কষ্ঠিপাথর দেখতে পাবে। সেই পাথর দিয়ে তোমার ইষ্টমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠা করো। আমি ওই মূর্তির মধ্যেই চিরদিন চিন্ময়ী-রূপে বিরাজ করব।”
পরের দিন ভোরবেলা নন্দদুলাল গঙ্গার ঘাটে গেলে বটগাছের তলায় কষ্টিপাথর দেখতে পেলেন। বাড়ি নিয়ে গেলেন সেই শিলা। তারপর শুভ দিন দেখে জনৈক ভক্ত ভাস্করকে দিয়ে নির্মাণ করালেন মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট সেই অপূর্ব করুণাময়ী মূর্তি।
১৭৬০ সালে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলো সেই মূর্তির। নির্মিত হলো নবচূড়া সহযোগে মা করুণাময়ীর নবরত্ন মন্দির। কালের বিধ্বংসী স্রোতে ও সংরক্ষণের অভাবে ১৪০ বছরের মধ্যেই মা করুণাময়ীর সেই নবরত্ন মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। পুরনো মন্দির ধ্বংস হলেও নন্দদুলালের প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী এবং মহাকালের মূর্তি আজও অম্লান-রূপে বিরাজমান।
কালীপুজোর দিন রাজবেশে সাজানো হয় মা করুণাময়ীকে। সকালে কুমারীপুজো এবং রাত্রে দেবীর বিশেষ পুজো সম্পন্ন হয়। কালীপুজোর দিন বহু ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে। করুণাময়ী কালীমন্দিরের বৈশিষ্ট্য হলো কালীপুজোর দিন এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় কুমারীপুজো। সেই দিন করুণাময়ীকে রাজবেশে সাজানো হয় অলংকার দিয়ে। রাত্রে মাকে ভোগ হিসেবে ১১ রকমের মাছ, ৭ রকমের ভাজা, ৭ রকমের তরকারি, সাদা ভাত, পোলাও, লুচি, ছোলার ডাল, দই, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
ময়দা কালী
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরে গেলে পড়বে বহড়ু স্টেশন। সেখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার গেলেই ময়দা গ্রাম। এই গ্রামেই রয়েছে সাবর্ণদের তৈরি আরেকটি কালীমন্দির। ময়দানবের আরাধ্য দেবী পাতালভেদী দক্ষিণাকালী ময়দানবেশ্বরী। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্যচরিতামৃত এবং বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত থেকে জানা যায়, আদিগঙ্গার প্রবাহপথ ধরে শ্রীচৈতন্য ময়দা গ্রামের উত্তরে বারুইপুরের কাছে আটিসারা গ্রামে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি অনন্ত পণ্ডিতের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
ময়দার এই কালীমন্দির কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা নির্মাণ করেন ১১৭৬ বঙ্গাব্দে এবং বন্দ্যোপাধ্যায়দের মন্দিরের সেবায়েত নিযুক্ত করেন। তবে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়েও এক কাহিনি আছে।শোনা যায়, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের এক বংশধর বজরা নিয়ে গঙ্গার বুকে বেড়াতে বের হন। হঠাৎ চোখে পড়ে দূরে বকুলগাছের ডালে একটি ছোট মেয়ে দোল খাচ্ছে। জমিদার বজরা থামিয়ে সেই মেয়ের খোঁজ করতে থাকলে মাঝিরা জানায়, 'ও ডাইনি, ওকে ধরা যায় না।' রাতে ওই বালিকা স্বপ্নে জানায় যে, সে পাতালভেদী দক্ষিণাকালী। বকুল গাছের গোড়ায় যে মাটির স্তূপ আছে, তা খুঁড়লেই পাওয়া যাবে একখণ্ড শিলা। ওখানেই মন্দির তৈরি করে দেওয়ার আদেশ দেয় ওই বালিকা। কালীপুজো উপলক্ষে এই দেবীরই আরাধনা করা হয় ময়দা গ্রামে। তবে শুধু কালীপুজোতেই নয়, বিশেষ বিশেষ তিথিতে পুজো দেওয়ার জন্য খুব ভিড় হয়। এখনও কালীপুজোর সময় সাবর্ণ চৌধুরীদের নাম করে জোড়া পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। কালীপুজোর সারাদিন মায়ের পুজো চলে, তবে মায়ের বিশেষ পুজো চলে রাত ১২টা থেকে ভোর তিনটে পর্যন্ত।
রায়চৌধুরী পরিবারের অন্যান্য কালীমন্দির
রায়চৌধুরী পরিবারের আদি বাসস্থান হালিশহরেও একটি সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির রয়েছে তাঁদের। কথিত আছে, বিদ্যাধর রায়চৌধুরী সকালে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে একটি কষ্টিপাথর পেয়েছিলেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে এক অন্ধ ভাস্করকে দিয়ে ওই একটি কষ্টিপাথর থেকেই নির্মাণ করিয়েছিলেন কালী, বুড়ো শিব এবং শ্যামরায়ের মূর্তি। সেই মূর্তিগুলি হালিশহরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটি ফেরিঘাট অঞ্চলেও তাঁদের পরিবারের দু'টি কালীমন্দির রয়েছে। এর মধ্যে একটি মন্দিরে মা কালীর চারহাত এবং অন্যটিতে দু'হাতের দেবী প্রতিমা বিরাজমান। এছাড়া নিমতার রায়চৌধুরী পরিবারেও একটি প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের মা কালীর মূর্তিতেও দেবীর দুহাত।
রানি রাসমনির সঙ্গে চৌধুরীদের বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল। কারণ যে হালিশহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই হালিশহর সমাজ গড়ে তুলেছিলেন এই বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়া রানির প্রিয় হালিশহর সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরও সাবর্ণ চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। এক সময় দক্ষিণেশ্বর ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপ্রসাদ রায়চৌধুরী এবং ভবানীপ্রসাদ রায়চৌধুরী দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলে প্রথম জনবসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে এখানেই রানি রাসমণি তৈরি করেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির। তাছাড়া এই বংশের সন্তান যোগীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণর ত্যাগী সন্তানদের অন্যতম এবং মা সারদার প্রথম মন্ত্রশিষ্য।
পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের হাতে তৈরি বিভিন্ন কালীমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত।