বাঙালির প্রিয় এই সন্দেশের সৃষ্টি জামাই ঠকাতে! বাড়িতেও বানাতে পারেন এই মিষ্টি
চন্দননগরের সূর্য মোদকের হাতেই প্রথম তৈরি হয়েছিল জলভরা সন্দেশ। তাও কিনা জামাই ঠকাতে! কী আজব কাণ্ড ভাবুন!
দুই বছর পর এবার জামাই-আদরের সুযোগ পেয়েছেন শাশুড়িরা। সেই সুযোগ যে তাঁরা কাজে লাগাবেন, তা বলাই বাহুল্য। তাই এবার জামাইয়ের পাতে কী মিষ্টি উঠবে, তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে গবেষণা। ফিউশনের পাশাপাশি সাবেক মিষ্টিতে জামাইয়ের মন ভোলানোর চেষ্টা করা হবে। তবে সব মিষ্টিকে কিস্তিমাত করতে তৈরি জামাই-ঠকানো জলভরা সন্দেশ। বাংলার মিষ্টির ঐতিহ্য নিয়ে লেখা হলে তাতে হুগলি যে এগিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
ভাঁড়ে কেশর ভাপা, ক্ষীর-চকোলেটের মনোহরা, হিমসাগর আম, পেয়ারা সন্দেশ, ক্যাডবেরি সন্দেশ- এসবের পাশাপাশি পাল্লা দিচ্ছে সাবেক মিষ্টি। জনাইয়ের মনোহরা, কামারপুকুরের সাদা বোঁদে, রিষড়ার ফেলু মোদকের ছানার মুড়কি, লবঙ্গলতিকার স্বাদ যিনি একবার পেয়েছেন, তিনি যে সারাজীবন ভুলতে পারবেন না, তা বলাই বাহুল্য। সূর্য মোদকের বিখ্যাত জলভরা সন্দেশ হুগলির আর একটা বিশেষ সম্পদ। এই মিষ্টি পাওয়া যায় চন্দননগর শহরে।
বর্ধমানের নাম বললে চোখের সামনে যেমন মিহিদানা-সীতাভোগ ভেসে ওঠে, তেমন হুগলির চন্দননগরের নাম বললেই জিভে জল আসে জলভরা সন্দেশের কথা ভেবে। চন্দননগরে পৌঁছলে সব মিষ্টির দোকানে জলভরা পাবেন। কিন্তু চন্দননগরের সূর্য মোদকের হাতেই প্রথম তৈরি হয়েছিল জলভরা সন্দেশ। তাও কিনা জামাই ঠকাতে! কী আজব কাণ্ড ভাবুন!
আরও পড়ুন: সন্তানলাভের সঙ্গে জড়িত জামাইষষ্ঠীর আচার, পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে যে কাহিনি
জামাই ঠকানোর ইতিহাস
ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদারবাড়ি থেকে হঠাৎ নির্দেশ আসে, এমন মিষ্টি বানাতে হবে, যাতে জামাই ঠকানো যায়। বাড়ির নতুন জামাইকে প্রথম ষষ্ঠীতে ঠকানোর জন্য ময়রার সঙ্গে রীতিমতো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন জমিদারের পরিবারের মেয়ে-বউরা। জমিদার বাড়ির মান ও মন রাখতে ষড়যন্ত্র করলেন যে ময়রা, তার নাম সূর্য মোদক। জমিদারবাড়ির মেয়েরা বললেন, এমন মিষ্টি বানান, যাতে মিষ্টি মুখে দিয়ে একদম হাঁদাগঙ্গারাম হয়ে যান জামাই।
সময়টা ১৮১৮ সাল। জামাইষষ্ঠীর দিনে বাড়ির নতুন জামাইরা বাবু হয়ে পাত পেড়ে বসতেই থালায় চলে এল প্রকাণ্ড একটা ক্ষীরের তালশাঁস সন্দেশ। জৈষ্ঠ মাসের দুপুর, আম, কাঁঠালের গন্ধে ম ম করছে জমিদারবাড়ির অন্দরের হেঁশেল। থালা থালা ফল-মিষ্টি কেমন সাবড়ে দিচ্ছেন জামাইরা। তারই মধ্যে কড়াপাকের তালশাঁস, আহা! ভেবে কামড় বসাতেই ঘটল বিপত্তি। প্ল্যান সাকসেস, তালশাঁসের ভেতর থেকে গরদের ধুতি, পাঞ্জাবি ভাসিয়ে দিল লুকিয়ে থাকা গোলাপ জল। সে একেবারে মাখামাখি কাণ্ড! সেই থেকেই ভরা জৈষ্ঠে জামাই ঠকাতে তালশাঁসের জন্ম।
বানানোর প্রক্রিয়া
এই সন্দেশ বানানোর মূল উপাদান ছানা, চিনি, গোলাপ জল ও শীতকালে নলেন গুড়। সূর্য মোদকের দোকানে গোলাপ জল আসে নিয়ম মেনে কনৌজ থেকে। কিছুটা সন্দেশে প্রথমে ছাঁচের মধ্য দিয়ে আঙুলের চাপে একটা গর্ত করে নেওয়া হয়। সেই গর্তে গোলাপ জল ঢেলে আবার সন্দেশ দিয়ে বাকিটা ঢেকে ছাঁচের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। এভাবেই জলভরা সন্দেশ তৈরি করা হয়।
রবীন্দ্রনাথও সন্দেশের ভক্ত ছিলেন
জলভরা সন্দেশে মন মজেনি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরাও এই মিষ্টিতে মজেছেন যুগ যুগ ধরে। অনেক গল্পই শোনা যায় এই মিষ্টি ঘিরে। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাকি সূর্য মোদকের মতিচুর ও জলভরা সন্দেশ খেয়ে তারিফ করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় নাকি চন্দননগরের ওপর দিয়ে কোথাও গেলেই এই দোকানে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতেন। এরকমই নাকি একবার বোলপুরে শুটিংয়ে যাওয়ার পথে সূর্য মোদকের দোকানে সন্দেশ খেয়ে তিনি অগ্রিম ১০ টাকা জমা রেখে যান ফেরার পথে সন্দেশ নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু ফেরার পথে অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়ায় আর মিষ্টি নিয়ে যাওয়া হয়নি। সেই দশ টাকা নাকি আজও জমা রাখা আছে সত্যজিৎ রায়ের নামে।
কে এই সূর্য মোদক
চন্দননগর নামটা শুনলে ২টো জ-এর কথা মনে আসে, জগদ্ধাত্রী আর জলভরা সন্দেশ। আর জলভরা সন্দেশ বলতে একটাই নাম, সূর্য মোদক, যে মিষ্টান্ন-কারিগরের হাতে এই রহস্যময় সন্দেশের সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার শুরু। তবে জলভরার সঙ্গে আজকের চন্দননগরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেও সূর্যকুমার মোদক ও তাঁর পরিবার কিন্তু এখানকার আদি বাসিন্দা নন। এঁরা ছিলেন মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগণার সুখচর অঞ্চলের বাসিন্দা। পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের মুখ থেকে শোনা যায় সূর্যকুমার মোদকের পিতা মাধবচন্দ্র মোদক সম্ভবত উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিজের পরিবার নিয়ে সুখচর থেকে গঙ্গা পেরিয়ে ফরাসডাঙার পাশে বারাসাত (২৪ পরগণার বারাসাত নয়, ভদ্রেশ্বরের বারাসাত) অঞ্চলে চলে আসেন। সূর্যকুমার তখন সবেমাত্র বালক। তখনও তাঁদের মিষ্টির দোকান হয়নি। আর আজকের মতো এতরকম মিষ্টিরও সেকালে এত চল ছিল না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালির পুজো-পার্বণ বা উৎসব-অনুষ্ঠানে মণ্ডা, মিঠাই, বরফি, মোরব্বা ইত্যাদি সাধারণ কিছু মিষ্টান্নই প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মিষ্টির দোকানে ছাঁচের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন ডিজাইনের সন্দেশের প্রচলন হয়। জলভরা তালশাঁসের সন্দেশ আসে তার কিছু পর। সূর্যকুমার মোদক কেবল একজন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীই ছিলেন না, তাঁর ভেতরে শিল্পবোধের সহজাত প্রতিভা ছিল। তাঁর হাতের আঁকাও নাকি ছিল চমৎকার। মাটি ও কাঠের ছাঁচও তিনি নিজে হাতেই বানাতেন বলে শোনা যায়। ক্ষীরপুলি, মতিচুর ইত্যাদি সন্দেশ তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কার নিঃসন্দেহে আজকের জলভরা সন্দেশ।
আড়ম্বরের ভেতর দিয়ে রঙ্গ-তামাশা প্রবেশ করবে না, তা হয় নাকি? কাজেই আপনার পাতে যদি জামাইষষ্ঠীতে এই মিষ্টি পড়ে, ঘাবড়াবেন না। আগে থেকে জলভরা তালশাঁসের গুপ্তকথা জানলে আপনিও শ্বশুরবাড়িকে বোল্ড আউট করতে পারেন। এক্ষেত্রে কিস্তিমাত!