উৎসবের নামে কতদিন চলবে নিগ্রহ — রংখেলার সিনেমা ও বাস্তব
Holi Celebration: এখন হোলিতে বক্স, ডিজে অপরিহার্য। এবং পুরনো থেকে নতুন সমস্ত গানই সেখানে চলে।
‘হোলি’ এবং ‘দোল’ এই দুই উৎসবই বিষ্ণুর সঙ্গে জড়িত। ‘হোলি’ মূলত উত্তর ভারত কেন্দ্রিক উৎসব, বাংলায় ‘দোল’। তবে বাংলায় হোলির অনুপ্রবেশও কম দিন না। বিশেষত সিনেমার ক্ষেত্রটিতে। সাহিত্যে কোথায় কখন ধীরে ধীরে দোল ও হোলি মিশতে শুরু করেছে বা আদৌ করেছে কিনা তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে সিনেমা ক্ষেত্রটির গ্রহণক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা দুইই মাত্রাতিরিক্ত। কাজেই আঞ্চলিক ও জাতীয় পরিসরের আদান প্রদান এখানে খুব দ্রুত হয়। সেই দুই সংস্কৃতিই দুটিকে পরস্পর প্রভাবিত করে। আঞ্চলিক ভাষার সিনেমায় প্রধান ঝোঁক দীর্ঘদিন ছিল আঞ্চলিক। ফলত জাতীয় সংস্কৃতির কিছু প্রভাব সেখানে পড়লেও তা খুব প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি। ‘মূলধারা’ হিসেবে বাংলা ছায়াছবিতে দোলের গানই হয়ে এসেছে। পাশাপাশি দু' একটি হোলির গান হলেও সেখানে বাংলা নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছে দীর্ঘদিন।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় ‘খেলব হোলি রং দেব না’ গানটির কথা। অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান। রাহুল দেব বর্মণের সুরে আশা ভোঁসলে ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কণ্ঠ বাংলায় এখনও পাড়ার মোড়ে মোড়ে শোনা যায় নির্দিষ্ট দিনটিতে। ছবির নাম ‘একান্ত আপন’। ‘দাদার কীর্তি’-র ‘সাত সুরোঁ কি বাঁধ পায়েলিয়া’ গানটির কথাও তুলতে পারেন কেউ কেউ। অবশ্য তার পটভূমি ছিল তৎকালীন বাঙালির ‘পশ্চিম’। সেই পটভূমিতে হোলির গান অবশ্যই মানানসই।
কিন্তু সিনেমার কথা বলতে গিয়ে গানের কথায় কেন এলাম। কারণ খুব পরিষ্কার। ভারতীয় সিনেমায় উৎসব মূলত মিউজিক্যাল। বর্তমানে নানা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বাস্তবকেও তার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয় পুরোদমে। কিন্তু বাস্তব তো আর উপস্থাপনা নয়। কাজেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাঁরা নানান কারণে সেই উৎসবের অংশ হতে পারেন না বা চান না, বা উৎসবের অংশ হলেও সেই অস্বাভাবিক বুক ধুকপুকে সঙ্গীত-তাণ্ডব পছন্দ করেন না, তাদের উপর অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে যায়। উৎসব তখন একটা সিনেমাটিক ক্যারিক্যাচারে পরিণত হয়। নেশাভাং উৎসবের সঙ্গে জড়িত বহুদিন। তাই নিয়ে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু উন্মত্ত অবস্থায় যৌন হেনস্থা করাকে অত্যন্ত সুকৌশলে ‘স্বাভাবিক’ বলে উপস্থাপনা করার চেষ্টা নিয়ে যথেষ্ট অসুবিধা রয়েছে। এবং গত কয়েক দশক ধরে বাংলায় রং খেলার চিত্রও বদলাচ্ছে অতি দ্রুত। এর কারণ? বলিউড। মূলত হিন্দি গান। হোলি একটি উৎসব। কাজেই তার উপস্থাপনাও বলিউডে মূলত মিউজিক্যাল। সেক্ষেত্রে সিনেমায় হোলির উপস্থাপনা নিয়ে আলোচনায় গান একটি প্রধান বিষয়।
দীর্ঘদিন ধরে সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এখন হোলিতে বক্স, ডিজে অপরিহার্য। এবং পুরনো থেকে নতুন সমস্ত গানই সেখানে চলে। উৎসবের গানের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য বাকি গানের মতন তা ‘পুরনো’ হয়ে যায় না। বারবার পুনরাবর্তিত হওয়া ও নতুনভাবে বাজারে আসার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা তাদের রয়েছে। এবং সর্বোপরি গানগুলি ‘জনপ্রিয়’। এমতাবস্থায় কেউ যদি বলেন বলিউডের হোলি সংক্রান্ত গান নিয়ে প্রভূত সমস্যা রয়েছে, তবে আশেপাশের লোকজন আঁতকে উঠবে বৈকি। কিন্তু হরি হে মাধব, সমস্যা যে সত্যিই রয়েছে। ১৯৫৩র ছবি ‘আন’ থেকে ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’, ‘খেলো রং হামারে সং’ থেকে ‘বালম পিচকারি’ —বলিউডের বেশিরভাগ হোলির গানই অত্যন্ত সমস্যাজনক।
প্রায় প্রত্যেকটি গানের লিরিকে মেয়েদের যৌন হেনস্থা করাকে পুরুষত্বের তথা প্রেমের ‘অত্যন্ত স্বাভাবিক’ প্রকাশ হিসাবে উপস্থাপনা করা হয়ে থাকে। ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়’--অর্থাৎ হোলি সেক্ষেত্রে ধর্ষকামকে স্বভাবিকত্বের পরিসরে এনে ফেলে। বিশ্বাস না হলে কতগুলি উদাহরণ দেওয়া যাক। “সোনি সোনি আখিওঁ ওয়ালি/ দিল দে জা ইয়া দে জা তু গালি/ জা কুড়িয়ে জো কর লে/ গোরা বদন তেরা রং দিয়া”। প্রেক্ষাপট ‘মুহব্বতেঁ’। সঙ্গে চিরকালীন হাইপার-সেক্সুয়ালাইজড অর্চনা। এবং অবশ্যই সাদা কাপড়ে। “কিউঁ নো-ভ্যাকেন্সি কি হোঠোঁ পে গালি হ্যায়/ জবকি তেরে দিল কা কামরা খালি হ্যায়”-- ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র ‘বালম পিচকারি’। নারী একা থাকতে পছন্দ করলে তাকে যৌন নিগ্রহ করা যেতেই পারে গোছের একটা ব্যাপার আর কি! ‘রাপট লিখা দো রাপট লিখা দো থানে মে/ হাম ভর দেঙ্গে জুরমানা/ অঙ্গ সে অঙ্গ লাগানা/ সজন হামে অ্যাইসে রং লগানা” —এক্ষেত্রে মেয়েটির লিপে পুরুষের বাচন। এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়।
প্রতিটি গানের কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ছেলেদের পোশাক হবে রঙিন। মেয়েরা তুমুল রং খেলার মাঝেও অদ্ভুত ভাবে বিন্দুমাত্রও রং না মেখে নাচবে টাচবে। তাদের রং মাখাবে কেবলমাত্র তার প্রিয়। শরীর আদতে সংস্কৃতির দ্যোতক। পুরুষের যৌনতা তার রং মাখা শরীরের মতো বাধ্যবাধকতাহীন, কিন্তু নারী যতই হাইপারসেক্সুয়ালিজড্ হোক, যতই মর্ষকামী রূপে উপস্থাপিত হোক, তার ‘পবিত্রতা’ বজায় থাকতেই হবে। তাই গানের শুরুতে বা শেষে নারীকে তার প্রিয়তমই কেবলমাত্র রং মাখিয়ে দেবে। এবং গানের এই পরিসরে একটি বেড়া ভাঙার ব্যাপার থাকবে। কোথাও অতি লাজুক কোনও পুরুষ নেশার ঘোরে ‘সাহসী পুরুষালি’ পদক্ষেপ নেবে (যা আদতেই যৌন হেনস্থা) অথবা কোথাও কোনও একা থাকতে পছন্দ করা করা নারী ‘সামাজিক’ হয়ে উঠবে। প্রতিটি পুরুষের হাতে থাকবে পিচকারি। তারা নারীদের নানা রঙে রাঙিয়ে দেবে। পিচকারি দিয়ে পুরুষাঙ্গের ইঙ্গিত দেওয়া অতি ক্লিশে। কিন্তু হোলিরক্ষেত্রে আবশ্যিক। সঙ্গে রয়েছে ‘মঙ্গল পাণ্ডে’র ‘হোলি রে’ গানের পরিণতিও। এছাড়া নেশার ঘোলে ‘কনসেন্ট’ জাতীয় সম্পূর্ণ ‘অপ্রয়োজনীয়’ ধারণা টারণা কোথায় উড়ে যাবে। তার উপর রয়েছে বিশেষ সাজ-পোষাক। নারীদের ইচ্ছে থাকুক না থাকুক, তাদের যৌন আবেদন ফুটিয়ে তুলতে হবে পোষাকে এবং অলঙ্কারে, একটা সাজো সাজো ব্যাপার থাকবে, বলতে হবে “পুরুষের ধর্ষকাম আমরা অত্যন্ত উপভোগ করি হোলির দিনটিতে”, বিপরীতে পুরুষরা কিন্তু জামা বা কুর্তা ইত্যাদি ট্রাডিশনাল পোষাক আশাকই পরবে। তাদের ঐ আঁটসাঁট অস্বস্তিকর পোষাক পরে রঙ খেলার অত্যচার সহ্য করতে হবে না। অবিশ্যি বর্তমানে পুরুষের শরীরকেও অবজেক্টিফাই করা হয়ে থাকে।
বলা বাহুল্য এ যাবতীয় হোলির উপস্থাপন একটি মিথ। বাস্তবের রং খেলা এ ধরনের কোনওদিনই ছিল না। বরং তুমুল রং খেলোয়াড়েরাও পুরনো জামাকাপড় পরে, গায়ে তেল ডলে খেলতে নামতেন। পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া পথে ‘ফ্যাশনেবল’ হয়ে কোনওদিনই রং খেলতে নামতে হতো না নারীদের। কিন্তু বর্তমানে সিনেমার প্রভাবে এক ধরণের নতুন প্রবণতা তৈরি হয়েছে। নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে যাঁরা সচেতন, তাঁরা বাদে, আপামর নারীসমাজে এই সিনেমার প্রভাব এতটাই মারাত্মক যে তাঁরাও এই নিগ্রহিতা হবার ঘটনাকে স্বভাবিক তো বটেই, কোথাও কোথাও আকাঙ্ক্ষিতও মনে করছেন।
পরাণাদি গল্পের সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার যোগ দাদা সাহেব ফালকের সময় থেকে। জাতীয়তাবাদের উৎপত্তির সময় মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ক্ষেত্রটিতে পুরাণাদি ধর্মীয় প্রভাব বাড়তে থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার তাগিদে। রাজনৈতিক পরিসর যখন ব্রিটিশের হাতে, তখন আধ্যাত্মিক পরিসরে ভারতীয়রা রাজা–এমন একটা প্রচার ‘জাতি’র মেরুদণ্ড গঠনে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছিল। সেই পরিসর একাকার হয়ে যেতে থাকে রবি বর্মার ছবিতে। জাতীয়তাবাদ তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিতেও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। রবি বর্মার ছবির প্রভাব বহুল পরিমাণে দাদা সাহেব ফালকের মধ্যেও পড়েছিল। ফলত ভারতীয় সিনেমার জন্মলগ্ন পৌরাণিক আবহের মধ্যে যা একই সঙ্গে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। স্বাধীন ভারতে ধীরে ধীরে পৌরাণিক আবহ ম্লান হয়ে এলেও রয়ে গেল খেয়ালে বেখেয়ালে তার নানা উল্লেখ। সেই পথ বেয়েই হোলি বা দোলের অনুসঙ্গ ভারতীয় ছায়াছবির গানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রটিতে দোল সংক্রান্ত গান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কানন দেবীর লিপে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ থেকে ‘খেলবো হোলি রঙ দেবো না’ —এতে অব্জেক্টিফিকেশন কোথায়? এখানেই জাতীয় স্তর ও আঞ্চলিক স্তরের দ্বন্দ্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। জাতীয় স্তরে বাজার যেভাবে থাবা গেড়েছে সেই স্থানে পৌঁছতে বাংলা সিনেমার সময় লেগেছে ঢের। তাই ‘প্রেমে’র অনুষঙ্গ আনতে বাংলা ছায়াছবির গানকে দীর্ঘদিন যৌন হেনস্থার স্বাভাবিকীকরণ করতে হয়নি। রাধা কৃষ্ণের প্রেম সেখানে ভক্তি আন্দোলনের রেশ হিসেবেই এসেছে। শরীর অবশ্যই এসেছে। আসবেও। তবে শরীরকে নিছক বাজারি বস্তু বলে উপস্থাপিত করতে হয়নি গানে। বলিউডে মূলত ‘ভ্যাম্প’ চরিত্রের পরিসরটিতেই প্রথম প্রথম অবজেক্টিফিকেশন আটকে থাকলেও, সেই জাতীয় চরিত্র মুছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মূল নারী চরিত্রের পিতৃতান্ত্রিক উপস্থাপনা। ‘বাগবানে’র তুমুল জনপ্রিয় গান ‘হোলি খেলে রঘুবীরা’তে হেমা মালিনীর চরিত্রটি বয়স্ক, কাজেই বলিউডের নীতি মেনে ডিসেক্সুয়ালাইজড। কিন্তু তাতে কী! সেক্ষেত্রে বাকি কয়েকটি আবেদনময়ী নারীচরিত্র গানের মধ্যে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এবং সবথেকে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার অমিতাভের চরিত্রটি কিন্তু সেই একই ফর্মুলা মেনে অযৌনায়িত নয়, বরং তার যৌনতাকে যথার্থ করেই উপস্থাপিত করা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলা গানের অবস্থাও বলিউডের মতোই। আঞ্চলিকতা দিয়ে কিছু দিন বাজারের প্রবণতা রোখা যায়, শেষ পর্যন্ত সচেতনতা না বাড়লে সে প্রতিরোধ আদতে টেকে না। বাংলা সিনেমার নিশি পাওয়া অবস্থা এখন। মুহুর্মুহু বেড়ে চলেছে হোলির উচ্চবর্ণীয় বিষমকামী পুরুষের দৃষ্টিকোণকেই নর্মস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা। বলিউডে তো একরকম ‘স্বাভাবিক’ হয়েই গিয়েছে সবটা। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা তার একটু বেশিই। তুলনামূলকভাবে বনশালীর ‘লহু মুহঁ লাগ গয়া’ যৌনতার ক্ষেত্রটিতে নারীর প্রতিনিধিত্বকে অনেকটাই বলিষ্ঠতার সঙ্গে উপস্থাপন করতে সক্ষম। হোলি বা দোল, রঙের উৎসবে মেতে উঠুক মানুষ। তবে পাশাপাশি সমাজ নারী-নিগ্রহ নিয়েও সচেতন হয়ে উঠুক। নারীদের যৌনতার বিষয়ে নারীরা সচেতন ভাবে কী চান–তাতেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হোক। মানুষকে বস্তুরূপে উপস্থাপনা বন্ধ হোক। মানুষের উৎসব মানুষেরই থাকুক। মানবিকতার থাকুক। এইটুকু শিক্ষার দাবি আজকের দিনে খুব বড় দাবি কি? ভেবে দেখাই যাক না একরত্তি!