ভারত মানে শুধুই দারিদ্র আর আবর্জনা? হলিউডে যেভাবে দেখা যায় আমাদের দেশ
ভারত মানেই নোংরা এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি গরিব দেশ- পশ্চিম বিশ্বে চলা এই ধারণাটা খানিক পাল্টানো গেলে হয়তো বস্তাপচা স্টিরিওটাইপিক যোগা, শাড়ি এবং মিথ্যে কলোনিয়ালিজম থেকে বেরিয়ে এসে ভারতকে অন্যভাবে দেখিয়েও সিনেমা তৈরি করতে...
ভারতীয়দের মধ্যে এখনও অনেকেই পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে সব সময় উঁচুতেই রাখেন। সেখানকার খাওয়াদাওয়া হোক কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা, আইনি ব্যবস্থা হোক কিংবা শিল্পব্যবস্থা, পাশ্চাত্যের সুখ্যাতিতেই যেন এঁদের সুখ। ঠিক একইভাবে টলিউড, বলিউড, এমনকী দক্ষিণ ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রি বাদ দিয়ে তাঁদের মূলত ঝোঁক থাকে হলিউডের দিকেই। তাই প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার হলিউড যাত্রা নিয়ে তাঁদের গর্বের কোনও শেষ নেই। আর শাহরুখ খান কেন এখনও পর্যন্ত হলিউডে একটাও সিনেমা করতে পারলেন না, তা নিয়ে মাথাব্যথার অন্ত নেই।
হলিউডের প্রতি এই ফ্যান্টাসি যদিও প্রত্যেক সাধারণ মানুষের মধ্যেই একটু হলেও রয়েছে। হলিউডের কোনও একটি ছবিতে যদি আমরা একটুকরো ভারত দেখতে পেয়ে যাই, কেমন যেন গদগদ হয়ে উঠি। 'লাইফ অফ পাই' কিংবা 'লায়ন'-এর মতো অস্কারজয়ী সিনেমায় ভারতের দৃশ্য ব্যবহার করা, এমনকী, 'স্লামডগ মিলিয়নিয়ার'-এর মতো সিনেমাতেও ভারতের দৃশ্য দেখে আমরা যারপরনাই খুশি।
কিন্তু, 'ব্রহ্মাস্ত্র'-র ট্রেলারে ভিএফএক্স এবং মোশন গ্রাফিক্স দেখে ট্রোল করার সময় হোক কিংবা মালায়ালম ইন্ডাস্ট্রির 'মিন্নাল মুরলি'-র মতো ছবির সুপারহিরোকে নিয়ে খিল্লি করার সময়, হলিউডের মার্ভেল কমিকস এবং ডিসি কমিকসকে যেভাবে আমরা সম্মান দিয়ে বেঞ্চমার্ক হিসেবে সেট করি, হলিউড কি ভারতীয় সেন্টিমেন্ট নিজেদের সিনেমায় ব্যবহার করার সময় একইরকম সম্মান প্রদর্শন করে? হয়তো না। নাহলে অধিকাংশ হলিউড সিনেমায় ভারত মানেই শুধুমাত্র দারিদ্র এবং পথশিশুদের দুর্দশা দেখানো হতো না। ভারত মানেই নোংরা এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি গরিব দেশ- পশ্চিম বিশ্বে চলা এই ধারণাটা খানিক পাল্টানো গেলে হয়তো বস্তাপচা স্টিরিওটাইপিক যোগা, শাড়ি এবং মিথ্যে কলোনিয়ালিজম থেকে বেরিয়ে এসে ভারতকে অন্যভাবে দেখিয়েও সিনেমা তৈরি করতে পারতেন হারগ্রেভ, ড্যানি বয়েল কিংবা অ্যাং লি-রা।
আরও পড়ুন: হলিউড-বলিউড নয়, কোন জাদুতে তরুণ প্রজন্ম মজছে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে?
ভারতীয়দের নাম উচ্চারণ করা কি এতটাই কঠিন?
হলিউডে এমন অনেক সিনেমা রয়েছে, যেখানে ফরাসি ভাষার নতুবা লাতিন ভাষার বিস্তর ব্যবহার রয়েছে। সেই সমস্ত ভাষা শেখার জন্য যদি হলিউড তারকারা যথেষ্ট সময় দিতে পারেন, তাহলে ভারতীয় নাম কী করে উচ্চারণ করতে হয়, তার জন্য একটুও সময় তারা খরচ করেন না কেন? যেখানে তাঁরা ভাল করেই জানেন, কোনও একটি ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে ভারতের এক বড় সংখ্যার জনগণ তা দেখবে, সেখানে ভারতীয়দের নাম উচ্চারণ সঠিকভাবে করার জন্য যদি কিছুটা সময় খরচ করতে হয়, তাহলে তো ক্ষতির কিছু নেই। স্থানীয় ভাষার নাম উচ্চারণ করা অন্যান্য দেশের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে কিছুটা শক্ত কাজ, কিন্তু চেষ্টা করলে ভারতীয়দের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব।
যোগা এবং ধর্ম নিয়ে অত্যধিক মাতামাতি
যে কোনও হলিউড সিনেমায় যখন ভারতের কোনও দৃশ্য দেখানো হয়, সেখানে যোগা এবং ধর্মর একটা আলাদা জায়গা থাকে। ভারতীয়দের মধ্যে যোগা এবং ধর্ম- এই দু'টি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধুমাত্র যে এই দুই বিষয়ই দেখাতে হবে, এমনটা কোথাও নির্দেশিত নেই। ভারতে ধর্ম, যোগা, চক্র এবং হিন্দু দেবতা ছাড়াও আরও অনেক জিনিস রয়েছে। আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতা সত্যিই দেখার মতো। ভারতে কুম্ভলগড় কেল্লার মতো একটি জায়গা রয়েছে, যা কি না চিনের প্রাচীরের পর বিশ্বের সবথেকে বড় প্রাচীর। ভারতে সুবিশাল এবং বৈচিত্র্যময় বনভূমি রয়েছে, প্রকৃতির নানা সম্ভার রয়েছে। এছাড়াও সমাজের নানা দিক রয়েছে, যেখানে আলো ফেলা যেতে পারে।
তাই শুধুমাত্র যোগা এবং ধ্যানের ইতিহাস দেখিয়ে ভারতকে বিচার না করে ভারতের বাকি সমস্ত কিছু নিয়েও বিদেশের পরিচালকদের উৎসাহী হওয়া উচিত। তারা যদি শুধুমাত্র একটি দিকেই নজর দিয়ে বসে থাকেন, তাহলে বিষয়টা অত্যন্ত সংকীর্ণ মানসিকতার এবং রক্ষণশীল ও চিরাচরিত ধারণার প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।
একই গতে বাঁধা পোশাকের ব্যবহার
'হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার' সিনেমার পদ্মা ও পার্বতী পাতিলকে মনে পড়ে? সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে তাদের পোশাক এবং তাদের উপস্থাপন করার ভঙ্গি দেখে সেই সময় বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল ভারতে। ভারতীয় সংস্কৃতিকে অনেকটাই নিম্নমানে নিয়ে এসে অত্যন্ত সাধারণ একটি পোশাকে সাজানো হয়েছিল ওই দু'টি ভারতীয় চরিত্রকে। তবে শুধু ওই একটি সিনেমা নয়, একাধিক হলিউড সিনেমা এবং টেলিভিশন সিরিজে ভারতীয় আদব-কায়দা এবং ভারতীয় পোশাক-আশাককে অনেকটাই গৌণ করে দেখানো হয়েছে। ভারতের কাছে ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ঘরানার একটা সুবিশাল কালেকশন রয়েছে। কিন্তু তবুও, ভারতীয় কোনও নারীচরিত্রকে সিনেমায় দেখাতে গেলেই হলিউডের পরিচালকদের চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র লেহেঙ্গা এবং শাড়িতেই এসে আটকে যায় প্রতিবার। তাও আবার ভালো কোনও শাড়ি কিংবা লেহেঙ্গা নয়, খুবই সাধারণ মানের সাদামাটা একটি শাড়ি কিংবা লেহেঙ্গাতেই সাজানোর চেষ্টা করা হয় সেই চরিত্রটিকে।
সাদা চামড়ার রাজত্ব
সিংহভাগ হলিউড সিনেমাতে, যেখানে ভারত অথবা এশিয়ার কোনও দেশকে দেখানো হয়, সেখানে প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে সাদা চামড়ার মানুষদের। সঙ্গে ব্যবহার করা হয় ভারতের দারিদ্রের একটি অদ্ভুত সেন্টিমেন্ট। যদিও শুধুমাত্র এশিয়ার দেশের জন্য এই ধরনের সুপ্রিমেসি ব্যবহার করা হয়, তা বলা ভুল হবে। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের জন্যও এই একইরকম নীতি ব্যবহার করে মার্কিন মুলুক। পাশাপাশি আফ্রিকান-আমেরিকান এবং নেটিভ আমেরিকানদের ক্ষেত্রেও এরকম নীতি চালু রয়েছে।
ভারতীয়রা শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়
যদি কোনও একটি হলিউড সিনেমায় এনআরআই চরিত্র দেখানো হয়, তাহলে সেই চরিত্র হয় ডাক্তার হবে না হলে ইঞ্জিনিয়ার। আর যদি কোনও মহিলা চরিত্র দেখানো হয়, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই চরিত্রটি হবে গৃহকর্ত্রী। শুধুমাত্র ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা গৃহকর্ত্রী ছাড়াও ভারতীয়দের আরও কিছু ভূমিকায় দেখানো যেতে পারে। হলিউড সিনেমায় অলরাউন্ডার ভারতীয় চরিত্র খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। এই বিষয়টা পরিবর্তন করা যেতেই পারে। দু'টি জনপ্রিয় মার্কিন সিটকম, 'দ্য অফিস' এবং 'দ্য বিগ ব্যাং থিওরি'-র দু'টি ভারতীয় চরিত্র বেশ জনপ্রিয়- রাজেশ কুথরাপালি এবং কেলি কাপুর, তাদের সংলাপে বারবার ভারতীয়দের কলসেন্টার কর্মী বলে উল্লেখ করার প্রবণতা দেখা যায়।
হলুদ ফিল্টারের ব্যবহার
এই হলুদ ফিল্টার বিষয়টি শুধুমাত্র ভারতের একচেটিয়া নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ, যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমনকী, মেক্সিকোর কিছু দেশের দৃশ্য দেখানোর সময়ও এই স্যাচুরেটেড হলুদ রঙের ফিল্টার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হলিউড সিনেমায় সাধারণত এই হলুদ ফিল্টার ব্যবহার করা হয় কোন উষ্ণ অঞ্চলকে দেখানোর সময়। কিন্তু কালক্রমে এই হলুদ ফিল্টারের অর্থের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আজকের যুগের হলিউড সিনেমায় হলুদ ফিল্টার ব্যবহার করা হয় দরিদ্র, দূষিত কোনও জায়গার ক্লিপিং দেখানোর সময় অথবা কোনও যুদ্ধক্ষেত্রের ক্লিপিং দেখানোর সময়। বিশেষত নেটফ্লিক্সের 'এক্সট্রাকশন' সিনেমাটি এই হলুদ ফিল্টার স্টিরিওটাইপের নবতম সংযোজন।
বৈচিত্র দেখানোর ক্ষেত্রে অনীহা
আমাদের ভারতে হিন্দু ধর্ম কিন্তু একমাত্র ধর্ম নয়, কিংবা আমাদের দেশে শুধুমাত্র যে গঙ্গা নদী রয়েছে, সেরকমও কিন্তু নয়। কিন্তু বিদেশের কোনও সিনেমা বা সিরিজ হোক, অথবা বিদেশি ফোটোগ্রাফারের ছবি তুলতে আসা, গঙ্গা নদী এবং হিন্দু ধর্ম ছাড়া বাকি কিছুর দিকে তেমন একটা নজর দেওয়াই হয় না। হলিউড সিনেমায় ভারতের কয়েকটি পুরনো কেল্লা, গোয়া এবং কিছু মরুভূমির কিছু দৃশ্য দেখা গেলেও, দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুর মতো শহরের উল্লেখ থাকে না বললেই চলে।
মুম্বইকে দেখানো হলেও, শুধুমাত্র মুম্বইয়ের বস্তির দিকে নজর থাকে বেশি। লাদাখ, মেঘালয়, রনথম্ভোর, সুন্দরবনের মতো জায়গা নিয়ে তেমন একটা উল্লেখ করাই হয় না। তাজমহল, যা বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে একটি, সেটাকে নিয়েও বিশেষ কোনও কথা বলা হয় না। অন্যদিকে, ধর্মের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা। ভারতের প্রধান ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্মকেই সবথেকে বেশি দেখানো হয়। অথচ একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু ভারতের এই বৈচিত্রময় দিকটা তুলে ধরা যেত হলিউডের সিনেমাতেও।
দারিদ্রকে মহিমান্বিত করা এবং ভারতের খারাপ দিকগুলিকে তুলে ধরা
ভারতের দারিদ্রকে মহিমান্বিত করা হলিউড সিনেমার জন্য যেন একটা ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'স্লামডগ মিলিয়নিয়ার' হোক, কিংবা 'লায়ন'- সব ছবিতেই ভারতের দারিদ্রকেই যেনো প্রধান ইস্যু হিসেবে দেখানো হয়েছে। কোনও অস্কারই এই বিষয়টাকে কোনওদিন পাল্টাতে পারবে না, ভারতীয় সেন্টিমেন্টকে তুলে ধরার জন্য 'স্লামডগ মিলিয়নিয়ার'-এর মতো একটি অস্কারজয়ী সিনেমায় শুধুমাত্র কাজে লাগানো হয়েছিল মুম্বইয়ের দরিদ্র বস্তিগুলোর অভাব-অনটনকে। দারিদ্র কোনও এমন বিষয় নয়, যেটাকে নিয়ে ইমোশন তৈরি করতে হবে। কিছু ছবিতে হলে তাও একটা বিষয় ছিল, কিন্তু হলিউডের বহু সিনেমাই এমন রয়েছে, যেখানে ভারতের এই দারিদ্রকেই সেন্টিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত, আমেরিকার থেকে অনেকাংশেই গরিব। তৃতীয় বিশ্বর অনেক দেশেই এই একই সমস্যা আছে। কিন্তু, এই দারিদ্রকেই ভারতের একমাত্র চেহারা হিসেবে উপস্থাপিত করা কোনওভাবেই সঠিক নয়। ভারতের এই দারিদ্রকে দূর করার জন্য চেষ্টা করা উচিত, সেটাকে ব্যবহার করা নয়।