রহস্যমৃত্যুর ডিপো! ডাকবাংলো মানেই অলৌকিকের হাতছানি

ডাকবাংলোর ভূতের গল্পে স্থান পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, সেগুলি ঘিরে অসংখ্য রহস্যমৃত্যু। আত্মহত্যা থেকে খুন- সবকিছুই ডাকবাংলোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।

 

ইতিহাসের কয়েকটা হারিয়ে যাওয়া পাতা থেকে বিভিন্ন ভূতের গল্পে আমাদের খুব পরিচিত একটা শব্দ ফিরে ফিরে আসে, ডাকবাংলো। এই ডাকবাংলোর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খুঁজলে আমরা বহু অজানা গল্প এবং তথ্য জানতে পারি।

১৮৪০ সালে লর্ড অকল্যান্ড ডাকবাংলোর নির্মাণ-সংক্রান্ত এক ডিক্রি জারি করেছিলেন। সেই সঙ্গে তার অজান্তেই শুরু হয়েছিল ডাকবাংলোর এক বিচিত্র এবং রহস্যময় অধ্যায়। লর্ড অকল্যান্ডের ডিক্রি অনুযায়ী ভারত-সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বিভিন্ন দেশে ডাকবাংলোর নির্মাণ শুরু হয়। সেই সময় নির্দেশ অনুযায়ী কোনও এলাকায় দু'টি ডাকবাংলোর মধ্যে দূরত্ব থাকত বারো থেকে পনেরো মাইল। ব্রিটিশদের শাসনকালে কোনও আধিকারিকের ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধেবেলা ডাকবাংলোয় পৌঁছনো থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পথ হারিয়ে জনমানবশূন্য এলাকায় ডাকবাংলো খুঁজে পাওয়া অবধি বিভিন্ন পরিস্থিতি বিভিন্ন ভূতের গল্পে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। শহরের বাইরে নির্জন এলাকায় অবস্থিত ডাকবাংলো ভূতের গল্পের এক একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।

Illustration of Satyajit Ray

'নীল আতঙ্ক'-র অলংকরণ, শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

ডাকবাংলো শুধুমাত্র ডাকব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সেগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। যাত্রীদের আশ্রয়, প্রজাদের থেকে তোলা খাজনা রাখার অস্থায়ী ঠিকানা থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় সাময়িক আদালত হিসেবেও ডাকবাংলো ব্যবহার করা হতো। সেই সময় কম খরচে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে ডাকবাংলোর নাম ছিল। বিভিন্ন নথি থেকে ডাকবাংলোতে এক রাত থাকার খরচের হিসেব পাওয়া যায়। সেই খরচ আট আনা থেকে শুরু হতো এবং তার মধ্যে ঘোড়ার খাওয়ার জন্য ঘাস, আগুন জ্বালানোর কাঠ থেকে যাত্রীদের খাবার জন্য ডিম, মাংসের দাম ধরা থাকত। ডাকবাংলোতে অনেক ক্ষেত্রেই খাটের ব্যবস্থা থাকলেও তোষক, বালিশ অথবা চাদরের কোনও ব্যবস্থা থাকত না। ব্রিটিশ সরকার এটাই আশা করত যে, আধিকারিকরা ঘোড়ার পিঠে নিজের বিছানা সঙ্গে করেই নিয়ে আসবেন। সত্যজিৎ রায়ের লেখা 'নীল আতঙ্ক' গল্পে আমরা সেই তথ্যের সমর্থন পাই। সেই গল্পে অনিরুদ্ধকে ডাকবাংলোর চৌকিদার সুখনরাম বলেছিল যে, ডাকবাংলোতে খাট রয়েছে, কিন্তু বিছানা পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন: মাংস-ডিমের মিশেলে সাহেবদের জন্য তৈরি এই পদের স্বাদ আজও অটুট

বিভিন্ন পুরনো নথি থেকে ডাকবাংলোর অস্থায়ী আদালতের বিভিন্ন ঘটনা জানা যায়। তার মধ্যে একটি বিচিত্র ঘটনা লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্ট্যানফোর্ডের লেখা থেকে জানা যায়। তার লেখা অনুযায়ী, এক প্রত্যন্ত এলাকার ডাকবাংলোকে একটা অস্থায়ী আদালতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। একজন বিচারক সেখানে বেশ কিছুদিন থাকবেন বলে ঠিক করেছিলেন। বিচারক বিচার-সংক্রান্ত সমস্ত কাজ একতলায় করতেন। একদিন বিচারকের কাজের সময় তাঁর স্ত্রী দোতলায় বন্ধুদের সাথে জুয়া খেলছিলেন। জুয়া খেলার হইহট্টগোলের ফলে বিচারকের কাজে অসুবিধে হচ্ছিল। তিনি বিরক্ত হয়ে তার স্ত্রীকে হইহট্টগোল কম করতে অথবা জুয়া খেলতে বারণ করায় তার স্ত্রী একতলায় এসে সবার সামনেই বিচারককে জুতোপেটা করেন। বিচারক অপমানিত হয়ে সেইদিন কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন নথি ঘেঁটে এই তথ্যও পাওয়া যায় যে, সিপাহী বিদ্রোহের শুরুতে বহু ব্রিটিশরা ডাকবাংলোগুলিকে তাদের নিরাপদ আশ্রয় এবং পালানোর পথ হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

ডাকবাংলোর ইতিহাসের শুরুতে বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন লোক নিয়োগ করা হলেও পরবর্তীকালে একমাত্র চৌকিদারের ওপর ডাকবাংলোর সমস্ত কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা একাধারে রান্নার ঠাকুর অন্যদিকে পাহারাদার আবার কখনও সমস্ত ফাইফরমাশ খাটার লোকের কাজ করতে শুরু করেছিলেন। সাহেবের উগ্র 'চৌকিদার' ডাক থেকে সাধারণ মানুষের 'কেউ আছেন' ডাক শুনলেই তারা হাজির হয়ে যেত। ডাকবাংলোর মতোই তাদের চৌকিদাররা আমাদের পড়া অথবা শোনা বিভিন্ন ভূতের গল্পের এক-একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছে। ডাকবাংলোর চৌকিদার বললেই আমাদের মনে হয়, একমাথা পাকা চুল, শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ হাতে লন্ঠন অথবা হ্যারিকেন নিয়ে এসে বলে, এখানে বহু বছর কেউ আসেনি। তারা চমৎকার রান্না করতে পারে। বিভিন্ন গল্পে তাদের তৈরি মাংসের খিচুড়ি থেকে মুরগির মাংসের ঝোল অথবা ডিমের পরোটার কথা পাঠকের মনে সেই খাবার খাওয়ার ইচ্ছা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ভূতের গল্প পড়ে মনে হয়, এই লোকগুলো যেন ডাকবাংলোর অংশ হয়ে থেকে গিয়েছিল। তাদের যেন অন্য কারও সঙ্গেই সেইরকম যোগাযোগ নেই। গল্পে এতটা গুরুত্ব পাওয়া ডাকবাংলোর চৌকিদারদের নিয়ে ইতিহাসের পাতায় সেইরকম কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো সেই সময় নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে করা এই লোকগুলো পরবর্তীকালে যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সেই কথা কেউ মনে করেননি।

ডাকবাংলোর ভূতের গল্পে স্থান পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, সেগুলি ঘিরে অসংখ্য রহস্যমৃত্যু। আত্মহত্যা থেকে খুন- সবকিছুই ডাকবাংলোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। কখনও একাকীত্ব, আবার কখনও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যার বহু ঘটনা বিভিন্ন ডাকবাংলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে লোভ এবং প্রতিহিংসা থেকে খুন। বিভিন্ন নির্জন এলাকার ডাকবাংলোয় ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো বিভিন্ন ভূতের গল্পের আদর্শ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

বর্তমানে ভারতে খুব অল্পসংখ্যক ডাকবাংলোর সন্ধান পাওয়া যায়। আজ তাদের পরিচয় বদলে গিয়েছে। তারা আজ বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, অধিকারিকের বাড়ি আবার কখনও হোটেলে পরিণত হয়েছে। ডাকবাংলো এবং তার পরিচয়ের থেকে দ্রুত উধাও হয়ে যাচ্ছে তার ইতিহাস। বেঁচে থাকা ডাকবাংলোগুলোই সেই বিচিত্র ইতিহাসের কিছুটা নিজের সঙ্গে লুকিয়ে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

More Articles