বন্দিদের কী পরিণতি হয় ইজরায়েলের জেলে? বর্ণনা দিচ্ছেন নির্যাতনের সাক্ষী

Israel-Palestine conflict: এক সপ্তাহ ধরে হাত ভেঙে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন নাজাল। এতদিন ধরে বারবার চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করেও মেলেনি ফল।

চার দিনের যুদ্ধবিরতিতে সত্যিই কি কিছু বদলালো গাজায়। এরই মধ্যে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে সাতশোরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে গাজায়। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকেই গাজা যেন মৃত্যুপুরী। যুদ্ধবিরতি চলাকালীন ইজরায়েলি জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১৮ বছরের ফিলিস্তিনি তরুণ মহম্মদ নাজি। যে অপরিসীম যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা কার্যত নজিরবিহীন। অপরাধী বন্দিদের ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা দিতে বাধ্য যে কেউ। সেখানে একজন নিরপরাধ তরুণকে সেইটুকু সুবিধাও দেয়নি ইজরায়েল। ইজরায়েলের প্রতিটি বন্দিশালায় চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।

অধিকৃত পশ্চিম তীরের কাবাতিয়া শহরের বাসিন্দা ১৮ বছরের মহম্মদ নাজাল। গত অগস্ট মাসে তাকে গ্রেফতার করে ইজরায়েলি সেনা। কোনও রকম অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল ইজরায়েলের জেলখানায়। শুধু নাজাল নয়, ইজরায়েলি বন্দিশালায় বন্দি শতাধিক ফিলিস্তিনি কোনও রকম অভিযোগ ছাড়াই। দু-দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগার পর থেকেই তাঁদের উপর অত্যাচার বেড়েছে। জেলের প্রহরীদের মুখের চেয়ে বেশি কথা বলেছে হাত। প্রতিদিন আট মিনিটেরও বেশি সময় ধরে নির্মম ভাবে লাঠি চলত নাজালের উপর। শরীরের যেখানে সেখানে। মাথা নিশানা করে নেমে আসত  লাঠি। কোনও মতে দু-হাতে মাথা ঢেকে রেহাই পেতেন নাজাল। হাতে-পায়ে-গায়ে কালশিটের দাগ শুকোতে না শুকোতে ফের মার। নাজালের হাত দু'টো গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। ভেঙে গিয়েছে একাধিক আঙুল। চিড় ধরে হাতের অন্যান্য অংশেও। বাঁচার উপায় অস্ত্রোপচার। তবে বারবার আকুতি জানানোর পরেও তাঁর কথা শোনেনি কেউ। অস্ত্রোপচার তো দূরের, চিকিৎসকের পরামর্শটুকুও নেওয়া হয়নি। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হাত দু'টো নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে জেলখানার মাটিতে কাতরে গেছেন বছর আঠেরোর তরুণ। এই ভাবে কেটে গিয়েছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।

আরও পড়ুন: যুদ্ধের বাজারে জ্বালানি অমিল! মাটির সাবেক উনুনে ফুটে ওঠে ভাতই ভরসা এখন বিধ্বস্ত গাজায়

অবশেষে দু-দেশের মধ্যে বন্দিমুক্তির চুক্তি সাক্ষর হয়। ইজরায়েলি সসস্ত্র সংগঠন হামাসের চার দিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয় ইজরায়েল। হামলার মাত্রা যারপরনাই বাড়িয়ে কোনও এক শুক্রবার শুরু হয় গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি। সে সময় গাজায় হামাসদের হাতে বন্দি বেশ কয়েক জন ইজরায়েলিকে যেমন ছাড়া হয়, তেমন ভাবেই ইজরায়েলের জেলে বন্দি ফিলিস্তিনিদেরও ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় নেতানিয়াহপ সেনা। মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসে নাজালদের। এক সপ্তাহ ধরে হাত ভেঙে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন নাজাল। এতদিন ধরে বারবার চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করেও মেলেনি ফল। তবে এতদিন বাদে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তাঁকে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে রাজি হন জেল কর্তৃপক্ষ।

রেড ক্রসদের মাধ্যমে অবশেষে পরিবারের কাছে পৌঁছয় ইজরায়েল। ইজরায়েলের জেলখানায় ফিলিস্তিনি বন্দিদের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হয়, সেই ভয়ঙ্কর গল্প মিডিয়ার সামনে আনেন তরুণ। নাজালের কণ্ঠস্বর সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে ইজরায়েল সরকার। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর অফিসের তরফে একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আনা হয়। যেখানে দাবি করা হয়, নাজালের হাতে কিছুই হয়নি। এমনকী রেড ক্রসের বাসে চড়ার সময়েও তাঁর হাতে ব্যান্ডেজজাতীয় কিছুই ছিল না। ফিলিস্তিনিরা ইজরায়েলি কয়েদখানায় অত্যাচারের হয় বলে যে দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, তা সর্বৈব মিথ্যা বলে দাবি করা হয়েছে ওই ভিডিওয়।

তবে ইজরায়েলের এই দাবি যে সত্যি নয়, তাঁর প্রমাণ মিলেছে নাজালের ডাক্তারি পরীক্ষাতেই। এক্স রে রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, তাঁর একাধিক আঙুল ভেঙে গিয়েছে। পিঠে ইজরায়েলি সেনার অত্যাচারের ছাপ স্পষ্ট। নাজাল যে একরত্তিও মিথ্যে বলেনি, এবং নিজেদের পরিষ্কার রাখতে নাজালকে মিথ্যেবাদী সাজানোর চেষ্টা করছে ইজরায়েল, তা স্পষ্ট। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সেখানকার অভিজ্ঞতা মিডিয়ার সামনে এনেছে নাজাল। তবে নাজালই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক ফিলিস্তিনি জানিয়েছেন, ইজরায়েলি জেলে বন্দি থাকার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। কীভাবে বিনা অভিযোগে বিনা দোষে দিনের পর দিন ইজরায়েলি সেনার অত্যাচার, মারধর এবং হেনস্থা সহ্য করে যেতে হয় ফিলিস্তিনি বন্দিদের।

 

১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করার পর থেকেই ইজরায়েলি জেলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের এই অত্যাচারের রীতি চলে আসছে। এমনকী ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়েও একই কাজ করা হত জেলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের সঙ্গে। কয়েক দশক ধরে চলে আসা সেই অত্যাচারের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নথিভুক্তও রয়েছে। তবে নাজাল যে মিথ্যা কথা বলছে না, তার আরও প্রমাণ রয়েছে। মিসবার নামে একটি ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম সম্প্রতি প্রকাশ্যে এনেছে মুক্তির দিনে নাজালের মেডিক্যাল রিপোর্ট। যেখানে তাঁর হাতের হাড়ের চিড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পিঠে আঘাতের চিহ্নও স্পষ্ট সে রিপোর্টে। সেইসব মেডিক্যাল রিপোর্ট যাচাই করে নিয়েছে বহু মিডিয়াই। তাতে যে একবিন্দুও মিথ্যা নেই, তা একবাক্যে মেনেছেন সকলে।

দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েলি একটি অন্যায় রীতি চলে আসছে। যেখানে বিনা বিচারে বা বিনা অভিযোগেই ফিলিস্তিনিদের ৬ মাসের জেল দিয়ে আসছে ইজরায়েল। অদ্ভুত ব্যাপার, এমন একটি আইনবিরুদ্ধ কাজের জন্য আইন রয়েছে ইজরায়েলে। যেখানে আইনে বলা হয়, দোষী শাস্তি পাক ছাই না পাক, নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি নয় কোনও শর্তেই। সেখানে ইজরায়েল যেন উলট পূরণ। সে দেশের কারাগারে বিনাদোষে আটক অজস্র ফিলিস্তিনি। তাদের দোষপ্রমাণ হয় না, বিচার হয় না! অথচ সাজা ঘোষণা হয়ে যায় ঠিকই। চলে জেলের ভিতরে মারাত্মক মারধর, অকথ্য অত্যাচার। গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার পর থেকেই আরও চড়েছে নির্যাতনের পারদ। বন্দিদের খাবার-জলে রেশন লাগানো হয়েছে। মিলছে না চিকিৎসা পরিষেবা। এমনকী তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ব্যাপারস্যাপারগুলির সরবরাহও বন্ধ করেছে ইজরায়েল সরকার। পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করার সুবিধাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ইজরায়েলি কারাগারে বন্দি শিশুদের সঙ্গেও একই রকম ব্যবহার করছে ইজরায়েলি প্রশাসন। এমনকী বহু সময় তাঁদের মিলিটারি কোর্ট প্রসেসের মধ্যেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে ইজরায়েলের জেলখানাগুলিতে যাতে আরও বেশি সংখ্যক বন্দিকে জায়গা দেওয়া যায়, তার জন্য সদাসচেষ্ট ইজরায়েল প্রশাসন।

আরও পড়ুন: ওষুধের জোগান নেই, নামছে হাসপাতালে ঝাঁপ! জর্ডনের ফিল্ড হাসপাতাল বাঁচাবে গাজাকে?

একদিকে গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে একের পর এক মারণ হামলা ইজরায়েলি সেনার। একের পর এক হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরকে নিশানা করে চলেছে তারা। মুহূর্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টিয়ান ভূখণ্ডের একের পর এক নগর, শহর, জনপদ। তার উপর রয়েছে জবরদখলকারীদের অত্যাচার। একই সঙ্গে যারা পরিবার ছেড়ে, ঘর সংসার নিজের দেশ ছেড়ে বন্দি হয়ে পড়েছেন ইজরায়েলি জেলখানায়, তাঁদের জন্য রাখা নাজালের মতোই কোনও না কোনও পরিণাম। শুধুই যে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ-তাই নয়, ফিলিস্তিনিদেক অবস্থা যেন সবদিক থেকেই শেষ হয়ে যাওয়ার। যে ভাবে প্যালেস্টাইন জুড়ে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল, যে পরিমাণ মৃতদেহের পাহাড় জমছে দেশ জুড়ে, তাতে কিছুদিন পর ফিলিস্তিনি শব্দটার অস্তিত্ব থাকবে কেবল ইতিহাসে। এমনটাই আশঙ্কা করছে বিশ্বের তাবড় মানবাধিকার দলগুলি। দেখতে দেখতে আটান্ন দিনে পড়ল ভয়াবহ এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই যার বলি অন্তত ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি। এইভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে থামবে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয় বইকি।

More Articles