জঞ্জাল নয়, মূল্য আছে ভালো লেখার! বাংলা লেখালেখির যেভাবে বাঁক বদল ঘটাচ্ছে ইনস্ক্রিপ্ট

Inscipt.me Subscription: লেখার যে বাজারমূল্য তার আশি শতাংশই লেখকের পাওনা। কারণ সৃষ্টিটা তারই। লেখাটা পরিবেশন এবং বিতরণের জন্য কুড়ি শতাংশ রাখতে চাইছি আমরা।

ইনস্ক্রিপ্ট, বাংলার প্রথম লেখক-পাঠকের যৌথমঞ্চ আরও একবার নতুন ভাবনা বাস্তবায়ন করছে। এক কথায় বললে, ডিজিটাল পৃথিবীতে লেখার এবং লেখকের 'দাম' তৈরি করার ব্যাপারে পদক্ষেপ করলাম। ইনস্ক্রিপ্টের বেশ কিছু লেখাই এখন পাঠক কিনে পড়ছেন। সাবস্ক্রিপশন ধর্মী প্ল্যাটফর্ম বাংলায় কম নেই। কাজেই কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন আমরা নতুন কী করলাম। এখানেই দু'কথা বলা প্রয়োজন।

গত দশ বছরের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায় দেখা যাবে, বাংলা ডিজিটাল মাধ্যমটা ধাপে ধাপে আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। মানুষের মনবদলে এই মাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এবং সেটা নেতিবাচক। যে আলোর-ভালোর সলতেটা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ২০০ বছরের বেশি জ্বালিয়ে রেখেছিল তা নিভিয়ে দিতে এই মাধ্যমের জুড়ি নেই। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয় দুই বর্গের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করতে, হিংসে ছড়াতে। এই মাধ্যমে নামজাদা প্রতিষ্ঠানও ধর্ষণের ফিরিস্তি লেখে রসিয়ে রসিয়ে। ধর্ষকের দৃষ্টিতেই দেখে মেয়েদের। খবর বলতে এখানে চলে অমুক নেতা আর তমুক নেত্রীর উবাচ। কিন্তু সে তো তারা ট্যুইটই করছে অহরহ। তবে কেন সময় দেব? চলে এক ধরনের ঝুঁকে থাকা, যেদিকে পাল্লা ভারী, যেখানে নিরাপত্তা, সেদিকে ঝুঁকে থাকা। এই যে চটকের পৃথিবী, এতে প্রতিদিন ক্ষয়ে যাচ্ছে পাঠকের মন। সব ক'টা মাধ্যমেই তুল্যমূল্য একই প্রতিবেদন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলছে, সবার গায়ে এক জামা, ভিড়ের মধ্যে কেউ আলাদা নয়। এর ফলে আমরা ধরেই নিয়েছি, লেখা মানে যেন এমনটাই, এর জন্য স্কিল দরকার নেই, যে কেউ পারে। কিন্তু সবটাই মুড়ি নয়, মিছরিও যে রয়েছে, ভালো লেখা রয়েছে, গবেষণাধর্মী লেখার লোক আজও রয়েছে, লঘুচাল থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণের মন নিয়ে কফির কাপ পাশে রেখে রাত জেগে লিখছে এক বাঙালি, একটা গল্প আলপনার মতো সাজাচ্ছে কেউ- এ কথা যেন আমরা ভাবতেই পারি না। এখানেই, এই মৃত্যুঘণ্টা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলা, এগুলি বাংলা লেখার ঐতিহ্য নয়, বাঙালি পাঠক প্রস্তুত পাঠক, তারা রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্তান, মলমূত্রবত লেখা তাদের প্রাপ্য নয়। বিনামূল্যে দিচ্ছ বলে তুমি মাথা কিনে নাওনি, দিচ্ছ না তুমি, আসলে সুড়সুড়ি দিয়ে নিচ্ছ অ্যাটেনশান টাইম। এই ধাক্কা দেওয়ার কাজটাই আমরা করে গেছি গত এক বছরের বেশি সময় নিরন্তর।

আমরা নামীদামী লেখকদের ভালো লেখাকে আমাদের মাধ্যমে পাঠকের জন্য তুলে এনেছি, আবার বহু নবীনের উঠে আসার সিঁড়ি হয়েছে ইনস্ক্রিপ্ট। আমরা জ্যোতিষ, কুসংস্কার বিজ্ঞপিত করিনি, যৌন সুড়সুড়িকে জায়গা দিইনি। হাজার হাজার পাঠক যখন আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে লেখকদের লেখা পড়েছে, মত দিয়েছে, তখন একটা কথা বোঝা গেছে, আছে বল দুর্বলেরও। আমরা বুঝেছি ডিজিটাল পাঠক চাতকের মতো অপেক্ষা করে আছে স্রেফ ভালোর জন্য। এই ভালোটুকু প্রতিষ্ঠা করতেই লড়ে যাচ্ছি আমরা।

কিন্তু মুখে ভালো বললেই তো হবে না। যিনি ভালো লেখাটা লিখছেন তার ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে হবে। তবেই জোয়ার আসবে, বিন্দু বিন্দু মিশে তৈরি হবে ভালোর সিন্ধু। ডিজিটাল স্পেসে যারা লেখেন, তারা সংস্থা নির্ধারিত দাম পায় অথবা দাম পায় না, দাস্যভাব ধরে রেখে বেগার দেয়। এই কারণেই লেখার উপর কর্তৃপক্ষের গা-জোয়ারিটা বড় করে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে অশিক্ষাটা৷ একজন লেখক এখানে দাসের ভূমিকা পালন করেন। কর্তৃপক্ষের অঙ্গুলিহেলনে খারাপকে ভাল বলতে হয়। দিন রাত ব্রা-বিকিনি-যৌনাঙ্গ ভজনা করতে হয়। আমরা চাই, এই মৌরসিপাট্টা ভেঙে যাক। অন্য সব মাধ্যমের মতো লেখার পৃথিবীও দালালমুক্ত হোক। ভালো লেখাকে স্বাগত জানাক পাঠকই।

ভালো পণ্য পাঠক মূল্য দিয়েই কেনেন। তেল, নুন, সাবান- সবই আমরা ভালোটা চাই। তাই মূল্য দিই। আর্টের দাম হয়। ছবির, নাটকের দাম হয়। কারণ এগুলি আমাদের যাপনকে ঋদ্ধ করে। তাহলে, লেখার তেমন দাম হতে পারে না? আর এই দামটা অন্য কেউ ধার্য কেন করবে? প্রতিষ্ঠান কেন বলবে কোন শিল্পের কত দাম? কেন বেঁধে দেওয়া হবে লেখকের পাওয়া, না পাওয়া। আমরা চাই বন্ধনমুক্তি। লেখকই ঠিক করে দিক, তার লেখার দাম কত। ভালো পাঠক তাকে সেই দাম দেবে। এটা ধারাবাহিক ভাবে করতে পারলেই ঘটবে নিঃশব্দ বিপ্লব। লেখার পণ্যমূল্য তৈরি হবে, হারানো বিশ্বাস ফিরে আসবে। লিখে যে রোজগার করা যায়, সেই বিশ্বাসটায় দাঁড়াতে পারবেন লেখক। পাঠকের সাহায্যেই সে নতুন ভালো লেখা তৈরির মনটা গড়তে পারবে। লেখক-পাঠক দুই গোষ্ঠী যত কাছাকাছি আসবে ততই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে মধ্যসত্ত্বভোগী। দয়া দাক্ষিণ্য লেখক চায় না। পাঠকও লেখার নামে আলগা কথা চায় না, সে মূল্য দিয়েই লেখককে বাঁচিয়ে রাখে, এই বিশ্বাসটাকে আমরা প্রযুক্তির হাত ধরে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি।

এই কারণেই ইনস্ক্রিপ্টে নানা লেখার জন্য মূল্য ধার্য করা হচ্ছে৷ এই দাম আমরা ধার্য করছি না। করছেন লেখকই। একটি বই লিখে তিনি রয়ালটি হিসেবে ১০ শতাংশ পান। অনেক সময় তাও পান না। আমরা বলছি লেখার যে বাজারমূল্য তার আশি শতাংশই তার পাওনা। কারণ সৃষ্টিটা তারই। লেখাটা পরিবেশন এবং বিতরণের জন্য কুড়ি শতাংশ রাখতে চাইছি আমরা। আমরা চাই না ক্ষমতাবলে কে লিখবে, কে লিখবে না ঠিক করতে। আমরা চাই, কলকাতার ছেলেমেয়ে যেমন লিখছেন তেমন পুরুলিয়ার বলরামপুর, মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার লেখকও লিখুন, একই শক্তি সঞ্চারিত হোক সব বাঙালির মধ্যে। দাক্ষিণ্যে, অনুকম্পায়, অনুশাসনে বাঁচত হবে না তাকে, দাদাগিরি সইতে হবে না তাকে। নিজের লেখার দাম নিজে তৈরি করুন তারা। লেখার বিষয়, লিখনভঙ্গিমা যদি পাঠকের ভালো লাগে তারা চা- সিগারেটের টাকা বাঁচিয়ে লেখা কিনবেন। যেভাবে বাসভাড়া বাঁচিয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যায় সাধারণ মানুষ। কতজন পাঠক লেখকের লেখা কিনছেন তার স্বচ্ছ হিসেব প্রতিটি লেখকের কাছে থাকবে।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছি আমরা। গেল গেল রব তোলা সহজ, এগিয়ে এসে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া কঠিন। আমরা চাই, বাংলার লেখক পাঠক এই যৌথমঞ্চ ব্যবহার করে বাঙালির সংস্কৃতির নরকগমন আটকে দিক। ভালো লেখা পাঠকের মনে ঠাঁই পাক। বাঙালির উপর আমাদের আস্থা অটুট।

More Articles