মনস্তত্ত্বের খেলা? ভরসা রাখা যায় এই এক্সিট পোলে?

Exit Poll 2024: ১৯৬০ সাল থেকে সেন্টার ফর স্টাডিস অফ ডেভলপিং সোসাইটিস (CSDS)এই এক্সিট পোল (বুথ ফেরত সমীক্ষা) এবং ওপিনিয়ন পোল অর্থাৎ জনমত সমীক্ষার কাজ করার চেষ্টা করছে।

লোকসভা ভোটের সাতটি দফাই শেষ। এখন অপেক্ষা ফলাফলের। কিন্তু এই ভোট মিটে যাওয়া ও ফলাফল প্রকাশের মধ্যে যে বিরতি, সেখানে মাথাচাড়া দেয় বুথ ফেরত সমীক্ষা। চলে অনুমানের পালা। কোন দলের ভাগ্যে জুটতে চলেছে কত ভোট। কে পাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা? কে-ই বা জোর টক্কর দিচ্ছে? শেষপর্যন্ত কে বসতে চলেছে দেশের মসনদে? এই সমস্তই অবিরত বলে যেতে থারে ভোটফেরত সমীক্ষা। ১৯৬০ সাল থেকে সেন্টার ফর স্টাডিস অফ ডেভলপিং সোসাইটিস (CSDS)এই এক্সিট পোল (বুথ ফেরত সমীক্ষা) এবং ওপিনিয়ন পোল অর্থাৎ জনমত সমীক্ষার কাজ করার চেষ্টা করছে। এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নির্বাচকদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করা হয় এবং ভোটের পরবর্তীতে জনমত ওই এক্সিট পোলের সঙ্গে মিলছে কি না, তা-ও মিলিয়ে দেখা হয়। যদিও আজকাল যেভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তাতে একেকজনকে ‘নষ্ট্রাদামুস’ কিংবা তার চেয়েও বড় জ্যোতিষী ছাড়া কিছু মনে হয় না। আজকের সময়ের সমীক্ষা যত না মাটিতে নেমে সমীক্ষা, তার থেকে অনেক বেশী প্রচার। তার মধ্যে নির্বাচকদের ভাবনাচিন্তার কতটা প্রতিফলন হয়, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায় অবশ্য। আজকে যে কোনও নির্বাচক যদি যে কোনও প্রচলিত গণমাধ্যমের এই ধরনের জনমত সমীক্ষা দেখেন, তাহলে তাঁর মনে হতে বাধ্য, এই বিষয়টার মধ্যে কিছু একটা সন্দেহজনক আছে। তাঁর মনে হতে বাধ্য যে এই বিষয়টাই একটা গণমাধ্যমের এবং একটি রাজনৈতিক দলের তৈরি করা চমক ছাড়া কিছু নয়। এই জনমত সমীক্ষা দেখে আসল নির্বাচনে কী ফলাফল হতে চলেছে, তা নির্ভুল ভাবে বলা বেশ কঠিন। কারণ অতীতে বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, সমীক্ষায় দেখানো আর নির্বাচনের ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে।

এই ধরনের সমীক্ষা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত প্রচুর সংখ্যায় নির্বাচকদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো জরুরি, যাতে সঠিক ফলাফলের খুব কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। যত বেশি মানুষের কাছে যাওয়া হবে, ততই গাণিতিক ভাবে এই ফলাফল সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি স্তরের মানুষের, নারী পুরুষ নির্বিশেষে যদি সেই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে সেই সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় বৈকি। তৃতীয়ত যে প্রশ্নগুলো করা হবে, কিংবা যিনি প্রশ্নকর্তা, তাঁর প্রশ্ন করার ধরনের মধ্যে যেন উত্তরের আভাস না থাকে। অর্থাৎ এমন যেন কখনওই মনে না হয়, প্রশ্নকর্তা একটা নির্দিষ্ট উত্তর পেতে চাইছেন বলে প্রশ্ন করছেন। এছাড়াও আরও বেশ কিছু দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। যেমন কোনও একটি জনগোষ্ঠীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সেই জনগোষ্ঠীর যাঁদেরকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁদের সবাইকে যেন সমান সুযোগ দেওয়া হয়। সমীক্ষার জন্য বেছে মানুষের সঠিক নির্বাচনের ব্যাপারটি মাথায় রাখা জরুরি। প্রশ্নকর্তার এমন প্রশ্ন করা উচিত, যা সবাই সহজে বুঝতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে, যাতে মানুষ উৎসাহিত হয়ে তার উত্তর দেয়।

আরও পড়ুন: বিজেপি না ইন্ডিয়া, দেশের রাশ শেষমেশ কার হাতে?

'জনমত সমীক্ষা' বা 'ভোট পরবর্তী সমীক্ষা' — এই শব্দগুলো শুনলেই প্রথমে যে নামটা মনে আসে, তিনি প্রণয় রায়। ১৯৭৯-৮০ সালের কথা হবে। যেদিন থেকে মানুষের বসার ঘরে টেলিভিশন ঢুকল, সেদিন থেকেই বোধহয় আমরা নির্বাচনের আগে এবং শেষে এই ধরনের সমীক্ষা দেখতে শুরু করেছি। ১৯৯০ সালের পরে যখন প্রায় প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন পৌঁছে গিয়েছে, তখন এই সমীক্ষা আরও জনপ্রিয়তা পায়। প্রথমদিকে এই ধরনের সমীক্ষা জাতীয় স্তরের কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তারপরে চাহিদা বাড়ার ফলে, তা দৈনিক পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকে। তারপরে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল বাড়তে থাকে এবং সেগুলোতে দেখানো শুরু হয়। কে বা কারা ভোটের ফলাফল কতটা সঠিক অনুমান করতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। প্রাথমিকভাবে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলেও ঐ সমীক্ষা চালানো হতো, কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে এই প্রচারের ওপর। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এতে নির্বাচকেরা প্রভাবিত হতে পারেন। একে তো বেশীরভাগ গণমাধ্যমেরই মালিকানায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সাম্প্রতিক ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হওয়ার পরে যার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইদানীং সেই সব সমীক্ষাগুলো টেলিভিশনে দেখানো বন্ধ হলেও, স্মার্ট ফোনের দৌলতে মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কোষে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে এবং এই সমীক্ষাগুলোকেই প্রচারের হাতিয়ার বানানো হয়ে গেছে। মানুষের মাথার মধ্যে যদি বারংবার একটা কথা গোয়েবেলসীয় ধরনে পৌঁছে দেওয়া যায়— ‘আব কি বার চারশো পার’, তাহলে যে কোনও মানুষের পক্ষেই তা অস্বীকার করা কঠিন। নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে কতটা সচেতন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নাকি তারা সচেতনভাবেই এই প্রচার চালাতে দিচ্ছেন, তা-ও গবেষণার বিষয় হতে পারে।

একটি নির্বাচন তো শুধু কোনও একটি দলের জেতা বা হারা নয়, একটি নির্বাচনে কোন কোন রাজনৈতিক ইস্যু কাজ করল বা কোনটা কাজ করল না, কোন অংশ, কোন সম্প্রদায়ের মানুষ কী ভেবে কাকে ভোট দিলেন— সমীক্ষার এই সমস্তটা চূড়ান্ত ফলাফলের মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে। এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, যদি তাই হয়, তাহলে এই ধরনের এক্সিট পোল এবং জনমত সমীক্ষার ফল এত বড় করে প্রচার করা হয় কেন? সাধারণত, আজকের সময়ে জনমত সমীক্ষা করানো হয়, একটা ন্যারেটিভ বা ধারণা তৈরি করানোর জন্য, যে ধারণাকে ধরে নির্বাচন হবে, অথচ যাঁরা এবারের নির্বাচন খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই বারের নির্বাচন শুরুর পরের থেকে ধীরে ধীরে বিরোধীরা ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন আর তার উত্তর দিয়েছে সরকার পক্ষ। কংগ্রেস তাঁদের ন্যায়পত্র বা নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করার পর থেকেই বিজেপি এবং তাঁদের প্রধান দু’জন প্রচারক সারাক্ষণ আক্রমণ করে গিয়েছেন সেই ইস্তেহারকে। তথ্য সংশ্লেষ করে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী এই নির্বাচনী প্রচারে ৭৫৮ বার নিজের নাম বলেছেন, অর্থাৎ উচ্চারণ করেছেন ‘মোদী’ শব্দটি। ‘মন্দির’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন ৪২১ বার আর ‘মুসলিম’ শব্দটি বলেছেন ২২৪ বার। অথচ, আজকে এই দেশে, যে শব্দটি উচ্চারিত হওয়া সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল, সেই ‘বেকারত্ব’ শব্দটি একবারও বলেননি। তাহলে কি ভারতবর্ষের সমস্যা একমাত্র ধর্ম এবং মন্দির-মসজিদ, বেকারত্ব নয়? আমাদের পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা কি সেই কথা বলে?

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে সমস্ত প্রচলিত গণমাধ্যম এই ধরনের ভোট পরবর্তী সমীক্ষা কেন প্রকাশ করল? কেনই বা তা নিয়ে চারদিকে এতো আলোচনা হচ্ছে? আসলে বেশীর ভাগ মানুষ যা বিশ্বাস করেন, সেই ধরনের খবর দেখতে এবং পেতে পছন্দ করেন। কিন্তু এই বেশীরভাগের বাইরে আরও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা এগুলোতে বিশ্বাস করেন না। প্রাথমিকভাবে মনস্তাত্বিক জয় লাভ করতে পারলে গণনার দিনে সুবিধা হয়। বহু রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যদি হতোদ্যম হয়ে পড়ে, তাহলে অনেকেই ভয়ে হোক বা অন্য যে কোনও কারণে গণনাকেন্দ্রে উপস্থিত হতে চাইবেন না। বা চাইলেও খুব বেশী লড়াই করতে চাইবেন না। যদি গণনায় কোনও কারচুপি করার চেষ্টা করা হয় সরকার পক্ষের তরফ থেকে, তখন এই ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ফলাফলের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা সুগম হয় সরকার পক্ষের। যখন বিরোধী দলকে বাহবা দিতে হয়, যে তাঁরা যেভাবে একটি বিশেষ ন্যারেটিভের বিপরীতে নিজেদের ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছেন, তাঁদের যদি হীন মনোবল করে গণনায় কারচুপি করা যায়, তাহলে তো ‘কেল্লা ফতে’। অতীতে বহুবার এই ধরনের এক্সিট পোলের ফল বদলে গেছে। ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে, ইন্ডিয়া শাইনিং এবং অটল বিহারী বাজপেয়ীকে জিতিয়েছিল সমস্ত সংস্থার এক্সিট পোল, ফল কিন্তু হয়েছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের আগের এক্সিট পোল কিন্তু বিজেপিকে বিপুলভাবে জেতায়নি, উল্টে নোটবন্দীর কারণে বিরোধীদের জিতিয়েছিল। সাম্প্রতিক ২০২১ সালের বাংলার বিধানসভার নির্বাচনে সমস্ত এক্সিট পোল বিজেপিকে সরকারে এনেই দিয়েছিল, ফলাফল কী হয়েছিল, তা আমরা জানি সকলেই। অতি সাম্প্রতিক কালে ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসকে জিতিয়েছিল এক্সিট পোল, কিন্তু ফল ঘোষণার পরে দেখা গিয়েছিল বিজেপিই জিতেছে।

আরও পড়ুন: অঙ্কে ঝুড়ি ঝুড়ি ভুল! বুথফেরত সমীক্ষা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

সুতরাং শুধু এক্সিট পোল ধরে চললে মনে হতেই পারে, ভারতবর্ষে এখন আর কোনও কিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই, সমস্ত কিছুই বাধা গণমাধ্যমের হাতে। কিন্তু ভরসা রাখা জরুরি মানুষের উপরে। যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাঁদের উপরে, তাঁদের প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার উপরে। মানুষ কোনওদিনও নিরাশ করেনি, করবেও না। রবীন্দ্রনাথের উপর ভরসা রাখা জরুরি— ‘দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই, মরবো না’, বলা নয়, অন্তর থেকে অনুধাবন করা জরুরি।

More Articles