সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?
Amitabh Bachchan Rajiv Gandhi Relation: রাজীব গান্ধী সেই সময়ে আমেরিকায় পাইলটের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। রাজীব নিয়ম করে দু’টি চিঠি লিখতেন। একটি বাড়ির জন্য, আরেকটি অমিতাভের জন্য।
একজন তরুণ অভিনেতা তাঁর বন্ধুকে নিয়ে অডিশন দিতে এসেছেন পরিচালকের কাছে। বিগত ৩-৪ বছরে কয়েকটি সিনেমা রিলিজ করলেও বলিউডে এখনো নাম কামাতে পারেননি তিনি। কেরিয়ারে ‘ব্রেক’ খুঁজছেন ওই উঠতি অভিনেতা। কিন্তু অডিশন দিতে গিয়ে বিধি বাম। ডিরেক্টর নেশায় বিভোর হয়ে রয়েছেন এবং জেদ ধরেছেন যে তিনি ওই উঠতি অভিনেতাকে নয় তাঁর বন্ধুকেই সিনেমায় নেবেন। কারণ ওই অভিনেতার বন্ধু অভিনেতার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন এবং স্মার্ট। এমনকি কড়কড়ে ৫ হাজার টাকাও দিয়ে ফেললেন অভিনেতার বন্ধুকে। এমতাবস্থায় দুই বন্ধু যখন অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেই সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে এলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টরকে কানে কানে তিনি এমন কিছু বললেন যে সঙ্গে সঙ্গে নেশা কেটে গেল তাঁর। এই উঠতি অভিনেতা হলেন অমিতাভ বচ্চন এবং তাঁর বন্ধুটি হলেন রাজীব গান্ধী। ডিরেক্টর হলেন মেহমুদ এবং সিনেমাটির নাম ‘বম্বে টু গোয়া’।
মেহমুদকে যখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জানালেন যে রাজীব গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বড় ছেলে, তাঁর মুখের অবস্থা হয়েছিল দেখার মতো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার ভুল শুধরে নিলেন এবং ৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন অমিতাভকে। অবশেষে ১৯৭২ সালে মুক্তি পেল ‘বম্বে টু গোয়া’। অবশ্য নিজের কেরিয়ারের প্রথম ‘ব্রেক’ ততদিনে পেয়ে গেছেন অমিতাভ বচ্চন। ১৯৭১ সালেই মুক্তি পেয়ে গেছে রাজেশ খান্নার সঙ্গে তাঁর অভিনীত ছবি ‘আনন্দ’।
এই প্রতিবেদন অবশ্য অমিতাভ বচ্চনের ফিল্ম কেরিয়ার বা ‘বম্বে টু গোয়া’ নিয়ে নয়, এই প্রতিবেদন দুই বন্ধুর গল্প। দুই বন্ধু যারা শৈশব থেকে একসঙ্গেই বড় হয়েছেন, দু’জনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নাম করেছেন এবং একটা সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দিয়েছেন। রাজীব এবং অমিতাভ দু’জনেই শৈশবের বন্ধু। মাত্র ৩-৪ বছর বয়স থেকেই একে অপরের খেলার সঙ্গী। শৈশবের অনেকটা সময়ই অমিতাভ বচ্চন কাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রাজীব এবং সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে। রাজীব গান্ধীর দাদু অর্থাৎ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ছিলেন অমিতাভ বচ্চনের বাবা অর্থাৎ হরিবংশ রাই বচ্চনের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত। বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের ফারাক হলেও হরিবংশ রাই বচ্চন এবং জওহরলাল নেহেরুর বন্ধুত্ব ছিল নিখাদ এবং অটুট। প্রধানমন্ত্রী হয়েই যুবক হরিবংশ রাইকে নিজের সেক্রেটারিয়েটে নিতে চেয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরু। যদিও তা অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে দেন তিনি।
আরও পড়ুন-ক্ষমা চাইতে হয়েছিল খোদ সুচিত্রা সেনকে! স্বর্ণযুগের অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ছিল আড়ালেই
রাজীব গান্ধী এবং অমিতাভ বচ্চন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব কতটা মজবুত ছিল তা একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝা যায়। ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়, সেই সময় অমিতাভ বচ্চন কলকাতায় বার্ড কোম্পানির সেলস এক্সিকিউটিভের কাজ করছেন এবং থিয়েটারে অভিনয় করছেন। রাজীব গান্ধী সেই সময়ে আমেরিকায় পাইলটের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। রাজীব তখন নিয়ম করে দু’টি চিঠি লিখতেন। একটি বাড়ির জন্য, আরেকটি অমিতাভের জন্য। দু’জনের বন্ধুত্ব এতই গভীর ছিল সে ১৯৬৮ সালে সনিয়া মায়নো (‘গান্ধী’ তিনি তখনও হননি) যখন ভারতে আসেন তখন তাঁকে এয়ারপোর্টে নিতে যান অমিতাভ বচ্চন। এর দেড় মাসের মাথায় সনিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় রাজীব গান্ধীর। সেই বিয়েতে সনিয়ার কন্যাদান করেছিলেন স্বয়ং হরিবংশ রাই বচ্চন।
এরপর এল ১৯৭০-এর দশক। একাত্তরের জয়ের পর চুয়াত্তর সাল আসতে আসতে ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পারেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম কঠিন সময় উপস্থিত হচ্ছে। দাম বৃদ্ধি এবং দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা তোপ দাগছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে অন্যরকম মাত্রা পাচ্ছে বিজেপি আন্দোলন এবং কংগ্রেসের অন্দরেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন মোরারজি দেশাই, বাবু জগজীবন রাম, হেমবতী নন্দন বহুগুণা, চন্দ্রশেখররা। বাধ্য হয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন এমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থার। এই অবস্থায় গান্ধী পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেই সময় দেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন। স্বভাবতই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে সমালোচনার পাত্র হয়ে দাঁড়ান অমিতাভ। এরপর ১৯৭৭ সালে এমার্জেন্সি তুলে দেন ইন্দিরা গান্ধী। লোকসভা ভোটে মুখ থুবড়ে পড়ে কংগ্রেস এবং নিজের প্রধানমন্ত্রীর পদ খোয়ান ইন্দিরা গান্ধী। তার পরবর্তী তিন বছর, অর্থাৎ ১৯৮০ সাল (১৯৮০ সালে ফের ক্ষমতায় আসেন ইন্দিরা গান্ধী) পর্যন্ত বিভিন্নভাবে পর্যদুস্ত হতে হয় গান্ধী পরিবারকে। কিন্তু তাতেও বন্ধুর পরিবারের পাশ থেকে সরে যাননি বিগ বি। রাজীব এবং অমিতাভের এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল আশির দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত।
১৯৮৪ সালে খুন হন ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী হন রাজীব গান্ধী। তখন লোকসভা ভোটের আর মাত্র দেড় মাস বাকি। এবার দেশের সবচেয়ে বড় নেতা দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেতাকে অনুরোধ করলেন ভোটে দাঁড়ানোর জন্য। ছোটবেলার বন্ধুর এই অনুরোধ ফেলতে পারেননি অমিতাভ। অভিনয় থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে এলাহাবাদের লোকসভা সিট থেকে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়ান অমিতাভ বচ্চন। এলাহাবাদে অমিতাভ বচ্চনের পৈতৃক ভিটেও ছিল।
এলাহাবাদে অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে জনতা পার্টির টিকিটে দাঁড়ালেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হেমবতী নন্দন বহুগুণা। আর প্রথম ভোটেই বাজিমাত করলেন বিগ বি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে হারিয়ে লোকসভার পথে পাড়ি দিলেন অমিতাভ বচ্চন।
আরও পড়ুন-চা খেতে ডেকেছিলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম! ঋষি কাপুরের বয়ানেই স্পষ্ট বলিউডের মাফিয়া যোগ?
এরপর এল ১৯৮৭ সাল, সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন দখল করল বোফর্স কেলেঙ্কারি। একের পর এক দুর্নীতিতে নাম জড়াতে থাকল ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীব গান্ধীর। এবার রেহাই পেলেন না রাজীব গান্ধীর হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ অমিতাভও। তাঁর বিরুদ্ধেও উঠতে লাগল একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। বাধ্য হয়ে ১৯৮৭ সালেই লোকসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন অমিতাভ বচ্চন। এই ঘটনায় বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। এই ঘটনা থেকেই দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে এবং ক্রমে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র দুর্নীতির অভিযোগই এসেছিল, শেষ পর্যন্ত আদালতে প্রমাণ কিছুই হয়নি।
তবে দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়িকভাবে ব্যাপক মার খান অমিতাভ বচ্চন। তাঁর প্রোডাকশন কোম্পানি ABCL প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে চলে যায়। এহেন অবস্থায় অমিতাভ বচ্চনের পাশে দাঁড়ান সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিং। আস্তে আস্তে কংগ্রেস ছেড়ে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় বচ্চন পরিবারের। অবশ্য মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেলেও রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর খবরে নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি অমিতাভ। ছুটে গিয়েছিলেন কাছের বন্ধুকে শেষবার দেখার জন্য।
শোনা যায়, সেই সময় অমিতাভ সনিয়া গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন কংগ্রেসের হাল ধরতে। সেই সময় অমিতাভের কথা না রাখলেও প্রায় সাত বছর পর, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসে ফের শুরু হয় গান্ধী যুগ। ‘শোনা যায়’ বলতে হল কারণ কোনও পক্ষের তরফেই এই সাক্ষাৎকারের বিষয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি, সবটাই সাংবাদিকদের ‘সূত্র মারফত’। অবশ্য এরপর সম্পূর্ণভাবে গান্ধী এবং বচ্চন পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ২০০৪ সালে যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শোনা যাচ্ছিল যে জয়া বচ্চন রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চলেছেন তখন জল্পনা ওঠে যে তিনি কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে লড়বেন কিনা। কিন্তু সেই সময় উত্তরপ্রদেশের শাসক দল সমাজবাদী পার্টি জয়া বচ্চনকে তাদের টিকিটে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানেও অমিতাভ বচ্চনের স্ত্রী জয়া বচ্চন সমাজবাদী পার্টির টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ। পরবর্তীকালে অমিতাভ বচ্চনকে গান্ধী এবং বচ্চন পরিবারের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “ওঁরা রাজা, আমরা সাধারণ মানুষ। কোনও তুলনা হয় নাকি!”