কেমন আছেন 'পথের পাঁচালী'-র অপু ও দুর্গার অভিনেতারা?
অপু এবং দুর্গা, দুই চরিত্রাভিনেতা আজও সব আলোর ঝলকানি থেকে দূরেই রয়েছেন।
২৬ অগাস্ট, ১৯৫৫। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো, ঐতিহাসিক দিন। এই দিন মুক্তি পেয়েছিল 'পথের পাঁচালী'। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমা সমগ্র বিশ্বের সামনে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার এক নতুন রূপ তুলে ধরেছিল। সময়ের সঙ্গে বহু সম্মান এবং সুখ্যাতি এই সিনেমা অর্জন করেছে। ৬৭ বছর পার করেও বর্তমানে এই সিনেমার জনপ্রিয়তা প্রায় একইরকম রয়েছে। 'পথের পাঁচালী'-র নাম শুনলেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তীর নাম আমাদের মনে আসে। এই মহীরুহদের ছায়ায় তিন বছর ধরে তৈরি হওয়া 'পথের পাঁচালী'-র সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকেই ঢাকা পড়ে যান। এই বিখ্যাত সিনেমার সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ এবং স্থানের নাম সাধারণ মানুষ ভুলতে বসেছে। তাঁদের খবর কেউ খুব একটা রাখে না। যদিও তাঁদের অভিনীত চরিত্র অথবা কিছু সিনেমার কিছু দৃশ্য আজও মানুষের মনে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে রয়েছে।
'পথের পাঁচালী'-র নাম উঠলেই যে দু'টি চরিত্রের নাম প্রায় সকলেই বলতে পারে, তারা হলো দুর্গা এবং অপু। সত্যজিৎ রায় ১৯৫০ সাল থেকে ছোট্ট অপুর চরিত্রের জন্য অভিনেতা খুঁজছিলেন। শোনা যায় যে, সেই সময় একদিন সত্যজিৎ রায়ের লেক অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির সামনে কয়েকটা ছোট ছেলে খেলা করছিল। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে অপুর চরিত্রের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ের। তিনি সত্যজিৎ রায়কে বিষয়টি জানানোর পরেই লেক অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ছেলেটির ডাক পড়েছিল। এই ছেলেটির নাম সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। দাদার সঙ্গে লেক অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে আসা ছেলেটিকে দেখে সত্যজিৎ রায় প্রশ্ন করেছিলেন, "বায়োস্কোপ করবে?" সুবীরবাবু শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন। তাঁকে নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন। তারপরই তিনি ঠিক করেছিলেন যে, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ই অপুর ভূমিকায় অভিনয় করবেন।
আরও পড়ুন: মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ‘পথের পাঁচালী’-র সুর সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর
যদিও ছেলের অভিনয়ের কথা শুনে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা শুরুতে ঘোরতর আপত্তি করেছিলেন। তিনি ছেলের মাথা ন্যাড়া করিয়ে নিজের বাপের বাড়ি গিরিডিতে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বহুবার বোঝানোর ফলে তিনি রাজি হয়েছিলেন। এই সিনেমার শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে শিশুশিল্পীদের শুটিংয়ের শুরুতে একটা আড়ষ্ট ভাব থাকলেও পরে তা কেটে গিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'পথের পাঁচালী'-র অপুকে সবাই মনে রেখেছে। যদিও বেশিরভাগ মানুষ সুবীর ব্যানার্জিকে ভুলে গিয়েছেন। 'পথের পাঁচালী'-র পরে আর কোনও সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন নি। ফ্যাক্টরির মিলহ্যান্ড থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হয়ে চাকরিজীবন কাটিয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। গত দশকে তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে 'অপুর পাঁচালী' নামে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত 'অপুর পাঁচালী' সিনেমায় পর্দা এবং বাস্তবের অপুর জীবনের বহু মিল দেখানো হয়েছিল।
'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে ও সিনেমায় অপুর দিদি দুর্গাকে পাঠক ও দর্শকমাত্রেই রেখে দেন মনের মণিকোঠায়। বিভিন্ন বয়সি দুর্গার চরিত্রে বিভিন্ন অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন। এই সিনেমায় অভিনয়ের পরেও মানুষের কাছে অপরিচিত হয়ে রয়ে গিয়েছেন উমা দাশগুপ্ত। ছোট দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রুণকি বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দুই অভিনেত্রী শুধুমাত্র 'পথের পাঁচালী' সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। যে দুই অভিনেত্রী দুর্গার মতো জনপ্রিয় একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁরা কেউই পরবর্তীকালে কোনও সিনেমায় অভিনয় করেননি। তা শুনলে মানুষের অবিশ্বাস হয়। যদিও ফোন অথবা কম্পিউটারে কয়েকটা খুটখাট করলেই গুগল আমাদের সামনে তথ্যের ডালা তুলে ধরে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে সে অপারগ। রুণকি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে খুব মামুলি কিছু তথ্য ছাড়া তার সঞ্চয়ে রয়েছে। উমা দাশগুপ্ত সংক্রান্ত তথ্যের ক্ষেত্রে তার ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। অবশ্য এই ক্ষেত্রে নির্জীব মাধ্যমকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাঙালি কতটা খোঁজ রাখে তার অপু-দুর্গার? মানুষ 'পথের পাঁচালী'-র দুর্গাদের মনে রেখেছে, কিন্তু সেই চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রীদের ব্যাপারে খুব একটা জানার আগ্রহ কেউ বোধ করেনি। তাঁদের অভিনীত চরিত্রই তাঁদের পরিচিতি তৈরি করেছে।
অসংখ্য পুরস্কার, সম্মান, স্বীকৃতি- সবকিছুর পরেও অপু এবং দুর্গা, দু'টি চরিত্রের অভিনেতারা আজও সব আলোর ঝলকানি থেকে দূরেই রয়েছেন। তাঁরা মানুষের কাছে শুধু অপু আর দুর্গা হয়ে বেঁচে আছেন।