দেওয়া হয় না ওষুধটুকুও! যেভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক বন্দিদের
Political Prisoners: ওষুধের অভাবে জেলে রাজনৈতিক বন্দির গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
ভারতের জেলগুলিতে মোট যতসংখ্যক বন্দি রয়েছেন তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বন্দিই মুসলমান, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। বিভিন্ন সমীক্ষাতে ধরা পড়েছে এই উদ্বেগজনক তথ্য। এও দেখা যাচ্ছে, জেলের অভ্যন্তরে যেখানে ১০০ জন বন্দির সংকুলান হওয়ার কথা, সেথানে বন্দি হিসেবে রয়েছেন অন্তত ১১৮ থেকে ১১৯ জন। এঁদের মধ্যে অনেকে নাম পর্যন্ত সই করতে পারেন না। অধিকাংশ আবার দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ নন।
দেশজুড়ে জেলগুলিতে যে বন্দিরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। সরকারের পেশ করা হিসেব অনুসারে, মোট বন্দির মধ্যে ৪৮ শতাংশ হিন্দু। জেলে বন্দির স্থান সংকুলানের জন্যে যথেষ্ট জায়গা না থাকলেও বন্দির সংখ্যা ২০২০ সাল থেকে ক্রমশ বাড়ছে। অন্যদিকে, বিচার প্রক্রিয়া চলছে বিলম্বিত লয়ে।
এদেশের জেলগুলিতে যে বন্দিরা রয়েছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবাও প্রশ্নচিহ্নর মুখে। গুরুতর অসুস্থ হলেও ওঁরা ডাক্তার দেখানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বহু ক্ষেত্রে মিলছে না ওষুধপত্র। এই পরিস্থিতি সাধারণ বন্দিদের পাশাপাশি সহ্য করতে হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দিদেরও। বন্দিদের উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা না মেলাটা কিংবা ওষুধপত্র না মেলাটা দেশের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারের পরিপন্থী তো বটেই, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদেরও পরিপন্থী।
আরও পড়ুন: কারাগারে নরকবাস! ভারতের বিচারাধীন বন্দিরা থাকছে মৃত্যুকূপে
সেই কবে ১৯৪৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, স্বাস্থ্যের পরিষেবার অধিকার যে কোনও মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভের অধিকার বন্দিদেরও অধিকার। এরপর দশকের পর পর দশক পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি খাতায়-কলমই থেকে গিয়েছে।
বর্তমানে ভারতের জেলগুলিতে বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দি রয়েছেন। এঁদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-র জমানায় 'আরবান নকশাল' সন্দেহে ধৃত। রাজনৈতিক এই বন্দিরা বয়স্ক এবং অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা ওষুধপত্র পাচ্ছেন না। ওষুধের অভাবে জেলে রাজনৈতিক বন্দির গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এরই এক নমুনা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ধৃত ৮৪ বছরের জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু। আদিবাসী আন্দোলনেন নেতা স্ট্যান স্বামী পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সিপার ও স্ট্র ছাড়া খাবার-দাবার খেতে পারতেন না। যদি সেই সামান্য সিপার ও স্ট্র পর্যন্ত জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জোগান দেয়নি। এরপর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছে জেল হেফাজতে। ৮৪ বছরের জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু নিয়ে দেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহল থেকেও প্রতিবাদ উঠেছে। রাষ্ট্রসংঘ এই মৃত্যু প্রসঙ্গে জানিয়েছে, স্বামীর এভাবে মৃত্যু হওয়ার কথাই ছিল না। জেলে স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ মিললে তিনি মরতেন না।
জেল হেফাজতে থাকাকালীন একইভাবে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পাননি কিংবা ওষুধপত্র জুটছে না ভীমা কোরেগাঁও মামলায় 'আরবান নকশাল' হিসেবে ধৃত অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সমাজকর্মী তথা শিক্ষাবিদ ভারনন গঞ্জালভেস, কবি ও লেখক সাগর গোরখে, সাংবাদিক সিদ্দিকি কাপ্পানের মতো রাজনৈতিক বন্দি। গুরুতর অসুস্থ রাজনৈতিক বন্দিদের জন্যে় ডাক্তার কিংবা ওষুধপত্রর ব্যবস্থা না করাটা মানবাধিকার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও যেন রীতি হয়ে্ উঠেছে। যা এদেশের সংবিধানের ১৪ এবং ২১ নম্বর ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
হার্ভার্ডের তরফে করা আর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের জেলগুলিতে যে বন্দিরা রয়েছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও শুশ্রূষার কোনও ব্যবস্থাই নেই। এও এদেশের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। তাছাড়া ভারতের জেলগুলিতে বন্দিদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও নেই। এ-ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিজন পলিসি ইনিশিয়েটিভের চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জেলে বন্দিরা অনেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, এইচআইভি কিংবা যক্ষ্মায় আক্রান্ত। অথচ ওষুধপত্রের কোনও ব্যবস্থা নেই। এছাড়া জেলবন্দিদের একাংশ মানসিক সমস্যার শিকার। জেলে নিয়মিত মাদক নেওয়ার ফলে ওঁরা নানা ধরনের মানসিক অসুখে ভুগছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও ভারতের জেলগুলিতে রাজনৈতিক বন্দিদের অসহনীয় অত্যাচারের শিকার হতে হত। এখন স্বাধীন দেশেও রাজনৈতিক বন্দিরা একই অবিচারের শিকার। ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে লাহোর জেলে ২৪ বছরের বিপ্লবী যতীন দাস রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক আচরণে্র বিরোধিতায় লাগাতার ৬৩ দিন অনশন করেন। অনশনরত অবস্থাতেই মৃত্যু হয় যতীন দাসের। যতীন দাসের মৃত্যু দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছিল। লাহোর থেকে যতীন দাসের মরদেহ কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর কলকাতায় বিপ্লবী যতীন দাসের মৃতদেহ নিয়ে বিরাট মিছিল বেরিয়েছিল। সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
ব্রিটিশরা ভারত থেকে ১৯৪৭ সালে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি অত্যাচারের যে নিদর্শন রেখে গিয়েছে, সেই ট্র্যাডিশন বহন করে চলেছে স্বাধীন দেশের সরকার। সরকারের বিরোধিতা করলে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বিনাবাক্যব্যয়ে পুরে দেওয়া হচ্ছে জেলে। এরপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। আবার ব্রিটিশ আমলেও যে রাজনৈতিক বন্দিদের জেলে পোরা হতো, তাঁরা সকলেই ব্রিটিশ শাসকের চোখে ছিল সন্ত্রাসবাদী। এই যুক্তিতে পরাধীন ভারতে জেলবন্দি হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওপর অসহনীয় নির্যাতন চালিয়েছে ব্রিটিশরা।
ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার যে পথে চলেছে, তা নিয়ে দেশজুড়ে ঘোরতর আপত্তি উঠেছে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, পরিবেশবিদ এমনকী, সরকারের সমালোচনার দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রীদের নির্বিচারে জেলে পোরা হচ্ছে। সরকারের অভিযোগ, এঁরা সকলেই সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের জেলে পোরা হয়েছে তাঁদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক বন্দিই জামিন পেয়েছেন টানা কয়েকমাস জেলে থাকার পরে। বাকিরা এখনও জেলকুঠুরিতে পচে মরছেন।
আর একটা কথা, ব্রিটিশ আমলেও রাজনৈতিক বন্দিদের জেলে পোরা হতো নানা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯২৪ সালের কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯২৪ সালের মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। আর আজ, স্বাধীন দেশেও একই কৌশল অবলম্বন করে ভীমা কোরেগাঁও-এলগার পরিষদ ষড়যন্ত্র মামলা সাজানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে। কিন্তু কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, 'অচ্ছে দিন'-এর। সেই 'অচ্ছে দিন' আসলে যে সোনার পাথরবাটি- তা হাড়ে হাড়েই মালুম পড়ছে।