খাঁচাবন্দি জীবন, রান্নাঘরে বারুদের গন্ধ! কেমন আছেন কাশ্মীরের মেয়েরা?
সীমান্তের 'জুমরাতে' কারফিউ নেমে আসে এখানে, মানচিত্রের রাজনীতিতে রান্নাঘরে পৌঁছে যায় বন্দুকের নল। হাতরুটিগুলো পুড়ে খাক হয়, আধার নম্বরের মতো চওড়া হয় ভাগ্যের পরিহাস।
বিস্তীর্ণ চারণভূমি। রকমারি সবুজে আচ্ছন্ন ভূস্বর্গ। হলদে, সবুজ, বেগুনি, নাম না-জানা সব ফুলের শামিয়ানা। যেন সেই সাতশো বছর আগের আমির খসরুর ফেলে যাওয়া কাশ্মীর।
তরুণী আপন মনে শুকনো ভুট্টাগাছের গোড়ায় কাস্তে চালাচ্ছিলেন। মেঘের চিবুক থেকে রোদ পড়ছিল তাঁর গা বেয়ে। মাথায় ফিরোজা ওড়না, নীল সালোয়ার-কামিজ মিশে গিয়েছে সবুজের গালিচায়। কাছে যেতেই মুখটা বেশি করে ঢেকে নিলেন। ছবি তুলতে গেলেও বাধ সাধলেন প্রথমে।পাহাড়ের সিলুয়েট বেয়ে তখন বিকেলের নামাজের শব্দ ভেসে আসছে। শেষমেশ যখন কথা বলা গেল, ততক্ষণে সূর্যের রং করমচা। জানলাম একদম পাশেই লাইন অফ কন্ট্রোল। ওই দূরে দেখা যাওয়া পাহাড়টার দেশ পাকিস্তান।
আফসানাদের ফেসবুক প্রোফাইল আছে, কিন্তু বেনামী। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজদের ছবি দিতে পারেন না ওঁরা। ভয় পান, যদি তাঁদের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। আর তারপরেই পাড়াপড়শির কাছে মুখ দেখানো দায় হবে। নিকাহ হতে গিয়ে চরিত্র নিয়ে টানাটানি পড়বে। তাই আফসানার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে পছন্দের দিশা পাটানির ছবি। অনেকে তো নিজের নামটুকুও রাখেন না নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে। মাল্টিপ্লেক্সের ভিডিও দেখেছেন ইউটিউবে, তবে চাক্ষুষ হয়নি। সরকারি কলেজ রয়েছে, তবু মাদ্রাসায় যেতে বাধ্য হন প্রতিদিন। নামাজের সময় মাথায় কাপড় চড়ে, ঘরের বাইরে বেরোলে মুখ ঢেকে যায় ধর্মের কালো কাপড়ে। মে থেকে সেপ্টেম্বর অবধি চলে চাষবাস। পাহাড়ের ঢালে ভুট্টা, জব, বাজরা, আখরোটের চাষে পুরুষদের সঙ্গে হাত লাগান মেয়েরাও। নভেম্বর পড়লেই বরফ পড়তে শুরু করে। ভারতের শেষ গ্রাম 'গুরেজ' এপ্রিল পর্যন্ত মোটামুটি বরফের চাদরেই ঢাকা থাকে। বাকি সময় চলে 'খেতিবাড়ি', সঙ্গে চলে শীতের মরশুমের জন্য শুকনো খাবার, জ্বালানির জন্য কাঠ-পাতা মজুত করা। এখানে চিনির দাম সাড়ে তিনশো টাকা প্রতি কিলো, তাই চায়ে নুন দিয়ে খাওয়াটাই এখানকার ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যে আখরোটের দাম আমাদের শহরতলিতে প্রায় বারোশো টাকা কেজি, সেই আখরোট ওরা তিনশো টাকা কেজি পাইকারি দরে বিক্রি করেন।
আরও পড়ুন: কেমন আছেন তেভাগার শেষ জীবিত সৈনিক?
কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর যাঁরা কাশ্মীরে জমি কিনবেন বলে উঠে পড়েছিলেন, কিংবা যাঁরা ঠিক করেছিলেন কাশ্মীরের সুন্দরী কোনও মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনবেন; তাঁরা কি জানেন এই মানুষগুলোর জীবনযাপনের চিত্রনাট্য? ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করে টেলিভিশনের প্রাইমটাইম ডিবেটে যাঁরা কাশ্মীরিয়তের সার্টিফিকেট দিলেন, তাঁরা কি জানেন, এ-রাজ্যের একটা বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ আজও ন্যূনতম ইলেকট্রিসিটির আওতার বাইরে, শহরে পৌঁছনোর মতো দিনে একটিমাত্র বাস, সেটাও চালকের মর্জিমাফিক চলে। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম যেতেও প্রয়োজন হয় আধার কার্ডের।
জানতে চেয়েছিলাম, কলকাতা গিয়েছেন কখনও? উত্তর এল, 'কাভি শ্রীনগর হি নেহি গায়ি। আউর কালকাত্তা!' তারপর 'নামকিন চা'-এ একটু গলা ভিজিয়ে ফের হাতে কাস্তে ধরলেন।
জগতের বাহারের মাঝে একটুকরো অন্ধকারে এভাবেই স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপন করছে কাশ্মীরের মেয়েরা। আধুনিকতার লেশমাত্র নেই এখানে। একদিকে পরিবার-সমাজের বেড়াজাল, অন্যদিকে রাষ্ট্রশক্তির প্রহরা। এই কি 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি'? উত্তর মেলে না।
সীমান্তের 'জুমরাতে' কারফিউ নেমে আসে এখানে, মানচিত্রের রাজনীতিতে রান্নাঘরে পৌঁছে যায় বন্দুকের নল। হাতরুটিগুলো পুড়ে খাক হয়, আধার নম্বরের মতো চওড়া হয় ভাগ্যের পরিহাস। মাসের পর মাস ইন্টারনেট বন্ধ থাকে, কারা যেন ইচ্ছে করে নিভিয়ে দেয় সোলার সিস্টেমের আলো। মনে পড়ে যাচ্ছিল, 'দ্য ইকোনমিক টাইমস'-এর সাংবাদিক অরবিন্দ মিশ্রর বর্ণনায় কাশ্মীরি তরুণী নাফিসার কথা।
ইয়া আল্লাহ! যা কিছু আমাদের ওপর হচ্ছে তা যেন অন্য কারও ওপর না হয়, শুধু তুমি এমন একটা কিছু করে দাও, যাতে গোটা পৃথিবী কিছুদিনের জন্য নিজেদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হয়, সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, থেমে যায়। তাহলে হয়তো দুনিয়া এটা অনুভব করতে পারবে যে, আমরা বেঁচে আছি কেমন করে!
তবু ওরা বুরখা আকাশে উড়িয়ে দিতে পারেননি ধর্মের ধ্বজাধারীদের চোখে চোখ রেখে। চিৎকার করেও হার মানতে হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির কাছে।
জানলার কাচের ভেতর থেকেই একটুখানি আকাশ দেখেছে যারা, অঞ্জন দত্তর গানের ভাষায় দেশের সীমারেখা টেনে তারা জানতেই পারেনি কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মালালা ইউসুফজাই-দের গল্প।
শ্রীনগরের ডাল লেকজুড়ে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপন চলছে ভারতীয় সেনার তরফে। একের পর এক শিকারার মাথায় তিরঙ্গা। সুখবিন্দর সিংহের বলিউডি গানে কুমাও রেজিমেন্টের সেনারা পতাকা নেড়ে বোঝাচ্ছেন কাশ্মীরিয়ত মিশছে ভারতীয়ত্বে।
সেই ডাল লেকেরই একটি হাউজবোটের মালকিন রাবেয়া বিবি। গত বছর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনিই হাল ধরেছেন ব্যবসার। ছেলে জুনায়েদ অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। 'চার ওয়াক্ত নামাজ' পড়া তো দূর অস্ত, দিনে একবারও আজকাল আর হয়ে ওঠে না। সারাদিন ধরে ট্যুরিস্টদের ফরমাইশ, নৌকো চালিয়ে গিয়ে বাজার-হাট করা, বুকিং-সংক্রান্ত খুটিনাটি, রান্নাবান্না সমস্ত কিছু একা হাতেই সামলান। অধুনা ইন্টারনেট ট্র্যাভেল ব্যবসাতেও সড়গড় হয়েছেন। ফেসবুকে ছবি ছাড়েন হাউজবোটের, আগত ট্যুরিস্টদের রিভিউ দিতে বলেন। আর এই সবকিছু করতে গিয়ে আজকাল আর হয়ে ওঠে না নিয়মমাফিক জুম্মার নামাজ, দল বেঁধে কোরান শরিফের পাঠ। মাথার কাপড়ও কখনও কখনও সরে যায়। আর তাতেই জোটে পরিবারের ভর্ৎসনা। দোকান-বাজারে গেলে একটু বাঁকা চোখে তাকান পড়শিরা। স্বামীর কবরে মাটি দিয়ে কেউ বলেছিল, হাউজবোট বেচে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে, কেউ আবার বলেছিল নতুন বিয়েতে বসতে। কিন্তু রাবেয়া সেসব কথায় কান পাতেননি। সমাজ এবং ধর্মের চিরাচরিত নামাবলিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে তিনি ও তাঁর হাউজবোট গুগুল-এ রোজ রোজ ফাইভ স্টার রেটিং পাচ্ছেন। বেহেস্তের উপত্যকায় এভাবেই চলছে রাবেয়াদের স্বাধীনতার উদযাপন। সবাই শেহলা রশিদ হন না, যে বুরখার কাপড় উড়িয়ে দিয়ে দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু কেউ কেউ রাবেয়া হন, যাঁদের সংগ্রাম গল্পগাথা হয়।
স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন পণ্ডিত নেহরু-র ভাষায় 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি' কি না জানা যায় না, তবু কারগিলের প্রত্যন্ত গ্রামে পনেরো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রোজ যে মেয়েটা স্কুলে পড়াতে যান, যিনি ওই মেয়েগুলোর মনে চাঁদে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন বুনলেন, তাঁর নাম কল্পনা চাওলা হোক।
কিংবা যে মহিলা ডাক্তার ও তাঁর সহকর্মীরা সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রচার চালাচ্ছেন কাশ্মীরজুড়ে, তাঁদের নাম হোক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।