৫৩ বছরে এই প্রথম খাঁটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে দেখছি
Bangladesh Quota Movement: দেশের কোটি কোটি মানুষের ভেতরের কথাটাই ছাত্ররা বলে দিল, যা অন্যরা এতদিন শুধু নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছিল।
যারা রাজনীতি করেন এবং রাজনীতির ফায়দা লোটেন তারা অহরহ মিথ্যা কথা বলেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই মিথ্যাটা একটু বেশি বলেন। শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে কিছু মানুষ আছেন, পদকের লোভে, পদের লোভে, ভাতার লোভে, মঞ্চে বড় আসন পাওয়ার লোভে এইসব মিথ্যাচারের পক্ষে নানারকম চাতুর্যপূর্ণ বয়ান দিয়ে থাকেন। আমি এতদিন ভেবেছিলাম বাংলাদেশের মানুষের আইকিউ যেহেতু পৃথিবীর গড় বুদ্ধিমত্তার বেশ নিচে তাই ওদেরকে সহজেই বোকা বানিয়ে এরা ক্ষমতায় টিকে থাকে। কিন্তু ছাত্রদের এই আন্দোলনের সময় ওদের অসাধারণ সব সৃজনশীল স্লোগান, মন্তব্য, বক্তব্য শুনে মনে হলো আসলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, মানে যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, বিশেষ করে ছাত্ররা, মোটেও বোকা নয়। বরং ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন মূর্খতাকে ওরা এতদিন করুণা করেছে। ওরা ওইদিকটাকে আসলে গুরুত্বই দিতে চায়নি। ওদের ভাবটা এমন ছিল যে, ওটা মূর্খদের বাজার, ওখানে নাক গলিয়ে নিজের সময় ও সম্মান নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।
ছাত্র আন্দোলনের প্রথম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগানটা কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং স্যাটায়ারে পূর্ণ! কী দারুণ দক্ষতায় ওরা প্রধানমন্ত্রীর ছুঁড়ে দেওয়া গালি তাঁর দিকেই ঘুরিয়ে দিল। অথচ রাজনীতির লোকেরা তো নয়ই, বুদ্ধিজীবীর পোশাক পরা চাটুকারেরা পর্যন্ত এর মর্মার্থ বুঝতে পারল না। লেখক জাফর ইকবাল তো সকলের চেয়ে একধাপ বেশি চালাকি করতে গিয়ে চরমভাবে অপমানিতই হলেন। দেশের সব বড় বড় বই বিক্রির পোর্টাল তাঁর বই নামিয়ে ফেলল, অধিকাংশ প্রকাশক, পত্রিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল। এই বয়সে এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে! চিত্রনায়ক এবং মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এই ঘৃণ্য শব্দটি ছাত্রদের মুখে শুনে, পরে যেন হঠাৎই তিনি জেগে উঠলেন এবং বুঝতে পারলেন এর আসল মর্মার্থ। লেখক, কলামিস্ট এবং অধ্যাপক আসিফ নজরুল বেশ কিছু বক্তব্যে, টক-শো-তে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পরে অতি চালাকেরা বুঝতে পারলেও, নিজেদের বোকামি ঢাকার জন্য শুরু করলেন গোঁয়ার্তুমি।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন, মৃত্যু নিয়ে কেন চুপ হাসিনার ‘বন্ধু’ ভারত?
হঠাৎ দেখি ফেসবুকে সবাই লিখতে শুরু করল 'সন্ধ্যা সাতটায় নর্দমার ঢাকনা খোলা হবে'। আমি যেহেতু চলমান আন্দোলনের সকল খোঁজ-খবর রাখতে পারিনি, তাই প্রথমে বুঝতেই পারিনি 'নর্দমার ঢাকনা খোলা হবে' মানেটা কী! যখন বুঝলাম তখন অবাক হলাম এই ভেবে যে দেশের কোটি কোটি মানুষের ভেতরের কথাটাই ছাত্ররা বলে দিল, যা অন্যরা এতদিন শুধু নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছিল।
ছাত্রদের সলিডারিটিও ছিল চোখে পড়ার মতো। নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে, কানাডায়, ইওরোপের বিভিন্ন দেশে সতীর্থ ছাত্র ভাই-বোনদের প্রতি সংহতি জানাতে নদীর স্রোতের মতো এসে জড়ো হয়েছে আন্তর্জাতিক বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা। ওদের চোখে-মুখে ভাই হারানোর, বোন হারানোর শোক, বুকে সাহস আর হৃদয়ে লাল-সবুজের উড্ডীন পতাকা। ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ৫৩ বছরের বাংলাদেশে সম্ভবত এই প্রথম একদল পরার্থপর খাঁটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে দেখছি। ঠিক এইরকম দেশমাতৃকার প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছিল বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানেও দেখেছি তবে নব্বইয়ের ঘটনাটি ছিল শুধুমাত্র ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এবারই প্রথম দেখলাম বিশ্বজুড়ে বাঙালি ছাত্রসমাজ এক অভিন্ন রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেনি। একজন আহত পুলিশকে কয়েকজন আন্দোলনকারী বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল যাতে তাঁকে উত্তেজিত জনতা মারধর না করে। ছাত্রলীগের নেত্রীদের ওরা আটক করেছে এবং কান ধরে ওঠবস করিয়েছে, দড়ি দিয়ে বেঁধেছে কিন্তু মারধর করেনি। এক জায়গায় দেখলাম আন্দোলনরত বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা পুলিশকে জল এবং চকলেট দিচ্ছে।
আরও পড়ুন- স্বৈরাচারী এরশাদকেও গদি ছাড়তে হয়! বাংলাদেশে গণআন্দোলন কি আর সেই ক্ষমতা রাখে?
সবচেয়ে ভালো লেগেছে ছাত্রীরা তাদের সম্পূর্ণ বুকভরা ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ওদের চোখে-মুখে এমন প্রত্যয় ছিল যে মনে হচ্ছিল ওদের আপন সহোদর বিপদগ্রস্ত। দরিদ্র হকারকে দেখলাম মাস্ক এবং ক্যান্ডি বিনামূল্যে আন্দোলনকারী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিতরণ করছে। বেশ কিছু রেস্তোঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ঠিকানা দিয়ে বলেছে আন্দোলনরত ভাই-বোনদের জন্য বিনামূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, চলে আসুন। অনেক মা এবং ছোট শিশু জলের বোতল নিয়ে রাস্তায় ছুটে এসেছে আন্দোলনরত ছেলে-মেয়েদের তৃষ্ণার্ত মুখে একটু জল তুলে দিতে। কী যে এক অভাবনীয় দৃশ্য, দেশপ্রেমের এমন মধুর, নিষ্কলুষ, নির্মল দৃশ্য সম্ভবত বাংলাদেশের মানুষ এর আগে আর দেখেনি।
তরুণদের বুদ্ধিমত্তা, তাদের দেশপ্রেম যদি নষ্ট রাজনীতি স্পর্শ না করে তাহলে এই তরুণরাই পারবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশকে নানা নেতিবাচক কারণেই পৃথিবীর মানুষ চেনে, অসংখ্য আবর্জনার অন্ধকারে এখনও পর্যন্ত একমাত্র আলো মহম্মদ ইউনূস, যাঁর জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর মানুষের কাছে কিছুটা মর্যাদা পায়, আমার বিশ্বাস এই তরুণরা দেশের নেতৃত্বে এলে এমন অসংখ্য ইউনূস তৈরি হবে।