ChatGPT: পথের পাঁচালির সমালোচনা থেকে যোগীর মূল্যায়ন! যে পথে অসাধ্যসাধন
ChatGPT Biasness: জিজ্ঞেস করলাম, ChatGPT আমাকে গৌতম আদানি নিয়ে একটা প্রশস্তিমূলক কাব্য লিখে দাও, সে লিখতে অস্বীকার করল।
গোড়ার কথা
সত্তরের সেই সোনাঝরা দিন আমরা অনেকেই দেখিনি বটে, কিন্তু ৭০-৮০'র দশকের কথা অনেকেই শুনেছি। ফিরে দেখলে জানা যায়, ১৯৭০-এ IBM যখন ব্যাঙ্ক বা ইনস্যুরেন্স অফিসে প্রথম কম্পিউটার আনতে চেয়েছিল, তখন কলকাতা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় জর্জ ফার্নান্ডেজ এবং অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা সেই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে, ভারত থেকে ১৯৭৭ সাল নাগাদ IBM ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়।
এই কথাটাই ঘরে বসে ভাবছিলাম। তখন কী বেশ খেয়াল হল যে, ChatGPT-কে বললাম, আমাকে একটু ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে ছোট্ট একটা রচনা লিখে দাও। ChatGPT কী করে, বা কী করতে পারে না, তার পরিসীমা বোঝার জন্য আমরা অনেকেই গত কয়েকমাস ধরে এটা নিয়ে খেলাধুলো করে চলেছি। এই খেলাধুলোর মধ্যে দিয়েই কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে আসছে। মূল বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে অর্থবহ বাক্য তৈরি করার ক্ষমতাটা সে অর্জন করেছে, যা দেখে মনে হতেই পারে, ChatGPT হয়তো বুদ্ধিমান হয়ে গেল, প্রায় মানুষের মতোই! কর্মব্যস্ত মানুষ যে কাজগুলো দিনের অনেকটা সময় জুড়ে করে, সেই কাজগুলো করার বেলা হয়তো ফুরোল।
প্রযুক্তি দুনিয়ায় যা রটে, তার অনেক কিছুই ঘটে না। জেফ বেজোস তাঁর পথ চলার শুরুর দিকে, অর্ডার পাওয়ার পর বাজার থেকে বই কিনে এনে সেসব অ্যামাজনের স্টোর থেকে বিক্রি করতেন। সেটা করতে করতে তিনি কয়েক বছরের মধ্যেই পেরিয়ে গেলেন বার্নস অ্যান্ড নোবেলস বা অন্যান্য বড় বড় পুস্তক বিপণনের চেইনগুলোকে। ChatGPT-র ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খানিকটা আলাদা। OpenAI বলে সংস্থাটি বেশ কয়েক বছর ধরেই গতিশীল। স্যাম অল্টম্যান, যিনি এই সংস্থাটির প্রধান বা সিইও, তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। Y Combinator বলে একটি স্টার্টআপ accelerator সংস্থা ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহর থেকে প্রায় ১৫ বছর ধরে সারা পৃথিবীর অন্যতম সফল প্রযুক্তিগুলিকে (যেমন – Airbnb, Doordash, Cruise) পুঁজি ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছে। স্যাম অল্টম্যান সেই Y Combinator-র প্রতিষ্ঠাতা। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। তারপর ২০১৫ সালে OpenAI সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে তিনি এর দায়িত্ব নেন।
ChatGPT 3.5-এর আগে পর্যন্ত GPT-র যে রূপগুলো আমরা দেখেছি সেগুলো দেখে এতটা বিস্ময় জাগেনি। সেগুলো দেখে মনে হয়নি, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের রোজকার জীবনের সঙ্গী হয়ে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং 'ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল' জাতীয় ব্যাপার আমাদের সামনে চলে আসবে। তবে সেদিকে এগোনোর আগে কয়েকটা উদাহরণ দেখানো যাক। প্রথম উদাহরণটিতে, আমি ChatGPT-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলার ছ'টি ঋতু নিয়ে একটা রচনা লিখে দাও। নীচের অংশটি পড়লে আপনারা বুঝতে পারবেন, স্কুল পড়ুয়ার রচনা হিসেবে ব্যাপারটা নেহাত খারাপ নয়।
এরপর ChatGPT-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কলকাতা ঘুরতে যাব, আমাকে তিনদিনের একটা প্ল্যান বানিয়ে দাও।
শেষ উদাহরণটিতে ChatGPT-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে ‘পথের পাঁচালি’ নিয়ে একটা ছোট চিত্র সমালোচনা লিখে দাও। নীচের অংশে আপনারা দেখতে পাবেন, ChatGPT পথের পাঁচালির চিত্র সমালোচনাটা ঠিক কেমন লিখল।
ChatGPT-র অন্দরমহল
বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ChatGPT এখনও অবধি হৃদয়বান বা হৃদয়বতী যন্ত্র হয়ে ওঠেনি। এই বিষয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে যে পরিমাপকে আমরা বোঝার জন্য ব্যবহার করি; সেই Foundational Model ChatGPT নয়। কিন্তু একইরকম ভাবে, আমরা সাধারণত যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলিকে এতদিন অবধি দেখে আসতাম, ChatGPT তাও নয়। ChatGPT একটি উৎপাদক মডেল। অর্থাৎ এটি নতুন দেখা, না শোনা কথা তৈরি করতেও পারঙ্গম।
ব্যাপারটা খুলে বললে দাঁড়াচ্ছে যে, এখনও অবধি আমরা যে মডেলগুলিকে মূলত দেখে আসতাম সেই মডেলগুলির মূল কাজ হলো বিষয় নির্ধারণ। এই নির্ধারণের পদ্ধতিকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ক্ষেত্রে মডেলের উপর তার স্রষ্টার তত্ত্বাবধান থাকে এবং আরেক ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। ধরে নেওয়া যাক, আমার কাছে দুটো রঙের বল রয়েছে। কিছু লাল রঙের বল রয়েছে এবং কিছু নীল রঙের বল রয়েছে। এবার আমরা মডেলটাকে ১০০ বার লাল বলটা দেখালাম এবং বললাম, এগুলো লাল বল, এর রঙ লাল। ১০০ বার দেখালাম নীল বলগুলো এবং তাকে বললাম যে এই বলগুলোর রঙ নীল। তা থেকে আমি আশা করব, মডেল বুঝতে পারবে কোন বলটা লাল আর কোন বলটা নীল! লাল এবং নীল রঙের যে কম্পাঙ্ক, সেই সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে এদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে। ফলত এই ২০০টি বল তাকে দেখানোর পরে ২০১তম বল যখন আমি তার সামনে নিয়ে আসব সেটা যদি লাল বল হয় তাহলে সে বলতে পারবে এটা লাল বল এবং যদি সেটা নীল বল হয় তাহলেও সে বলতে পারবে নীল বল।
দ্বিতীয় আরেক ধরনের মডেল আমরা ব্যবহার করি, তাকে বলে তত্ত্বাবধানহীন মডেল। সেক্ষেত্রে, লাল এবং নীল বলের কম্পাঙ্ক এবং অন্যান্য তথ্য মডেলকে দিয়ে বলা হয় যে, লাল বলগুলোর প্রধান অংশকে, নীল বলগুলোর প্রধান অংশ থেকে আলাদা করো এবং প্রত্যেকটা বলের আলাদা আলাদা করে রঙ না জানতে পারলেও এমনভাবে বলগুলোকে সাজিয়ে দাও যাতে একদিকে বেশি লাল বল এবং একদিকে বেশি নীল বল থাকে।
এই মডেলগুলি বেশিরভাগই সংখ্যাতত্ত্বের মডেল। এগুলি হালেফিলে তৈরি নয়; বানানো হয়েছে কয়েক দশক থেকে কয়েক শতাব্দী আগে। গত ১০-১২ বছরে এই মডেলগুলি তৈরির যে প্রধান প্রক্রিয়া তা পরিবর্তন হয়েছে। যে নতুন বিষয়টি এসেছে, তা হচ্ছে নিউরাল নেট বা স্নায়বিক জাল। আগে মডেলগুলির কার্যকারিতা বুঝতে একটি যুক্তিযুক্ত পারম্পর্য ব্যবহার করা যেত, অর্থাৎ কীভাবে মডেল বুঝতে পারছে এটা লাল বল বা নীল বল।
নিউরাল নেটের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা নিউরন বা স্নায়ুগুলি যেভাবে প্রচুর পরিমাণ তথ্যকে একসঙ্গে দেখে তার সংশ্লেষ করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে- সেই বিষয়টিকেই আমরা এই মডেলগুলি দিয়ে অনুকরণ করানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের দৌলতে যান্ত্রিক গণনার খরচ কমে যাওয়ার সুবাদে, এই নতুন মডেলগুলি প্রচুর পরিমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যকে সহজেই ব্যবহার করতে পারল। সেই নিউরাল নেট মডেলগুলি আগের যুক্তি পরম্পরার মডেলগুলো সরিয়ে সামনের সারিতে জায়গা করে নিল। একে আমরা অনেকে ‘Deep Learning’ মডেল বলেও ডেকে থাকি।
ChatGPT এই নিউরাল নেটের মডেলগুলিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেল এবং নতুন এই মডেলগুলিকে আমরা বলছি জেনারেটিভ মডেল। অর্থাৎ এগুলি কোনও বস্তুকে হ্যাঁ বা না, সঠিক বা বেঠিক এই বাইনারিতে ভাঙে না। বরং প্রচুর পরিমাণ ভাষাগত এবং শব্দ বাক্যের গঠন, কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসলে অর্থবহ আলোচনা তৈরি হতে পারে সেসব ধারণাগুলিকে অনুসরণ করে থাকে। এইজন্যই একে উৎপাদক মডেল বলা হয়।
GPT বা Large Language model গত ৪-৫ বছর ধরে শুধুমাত্র OpenAI সংস্থা নয়, Microsoft, Google, Facebook, Amazon- এই সমস্ত বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলিই তৈরি করছে। কিন্তু এর প্রায় মানুষের মতো কথা বা বাক্য গঠন, বক্তব্য পেশ করার ক্ষমতাটি খুবই সাম্প্রতিক এবং চমকপ্রদ।
বাণিজ্যে GPT লক্ষ্মী
এই মাসের শুরুর দিকে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলের প্রফেসর অতি পরিচিত এবং সুবিদিত লেখক ইথান মালিক লিখছেন, “ChatGPT is a tipping point for Artificial Intelligence”। সাধারণ মিডিয়ার ChatGPT-কে নিয়ে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস জার্নালে একজন লিখছেন যে, আগামী সময়ে ব্যবসা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে যে সংস্থাগুলি এই ChatGPT-কে সঙ্গে করে এগিয়ে যাবে বা তাকে ব্যবহার করবে তারা নাকি অনেকটাই বেশি সুযোগ সুবিধা করে নিতে পারবে। এত বড় দাবি একজন করছেন কী করে?
যদি একটু তলিয়ে দেখা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে, ১০টা- ৫টার অফিসের যে কাজগুলি আজ থেকে ২০ বছর আগে পর্যন্ত মানুষকে করতে হতো তার অনেকগুলিই এখন যন্ত্র করতে পারে এবং মানুষের কাজেরও পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেমন ধরুন, আগে যে হিসেবগুলি হাতে লিখে করতে হতো, যে খবর হাতে করে সাজিয়ে নিতে হতো, সফটওয়্যার এসে সেসবের পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন আমরা বেশিরভাগ সময় কোথায় কাটাচ্ছি? আমরা অনেকটা সময় কাটাই বিভিন্ন লিখিত বিষয় পড়তে, প্রেজেন্টেশন বানাতে, ইমেলে চিঠির বয়ান লিখতে, একটা বড় প্রতিবেদন পড়ে তার একটা সারাংশ বুঝতে বা লিখিত তৈরি করতে। এই সমস্ত কাজগুলো কোনও না কোনওভাবে ভাষাকে ব্যবহার করে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার একটা উপায়। এই আদান-প্রদানগুলি পৌনঃপুনিক যান্ত্রিক কার্যক্রম, এখানে কল্পনা বা মেধা ব্যবহারের সুযোগ সীমিত। বাজার অর্থনীতির ইতিহাস সামান্য দেখলেই বোঝা যায়, যে কাজগুলি অপেক্ষাকৃত সহজ এবং বারবার করতে হয়, সেই কাজগুলিকেই শেষমেশ যন্ত্র এসে কেড়ে নেয়। সেই একই কাজ করেছে ট্র্যাক্টর। ভারতে সবুজ বিপ্লবের সময় জমি চাষের জন্য বলদ আর মানুষের জায়গা নিল ট্র্যাক্টর, টিলার ইত্যাদি। চাষের মাঠে যারা আগে কাজ করতেন তাদের সংখ্যা কমে গেল; ফলত তারা হয় কর্মহীন হলেন অথবা নতুন জীবিকায় প্রবেশ করলেন। অর্থনীতির এই গতি অনিবার্য।
একইরকম ভাবে, শিল্পোত্তর সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ কর্পোরেট জীবিকাগুলিতে মানুষ অনেকটা সময় ব্যয় করেন নানান রকমের লেখালেখিতে। তা চিঠি লেখা, প্রতিবেদন লেখা, কোড করা যেকোনও কিছুই হতে পারে। এইসব গুলোতেই ভাষার অর্থবহ অভিধা তৈরি করার জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা করা, তারপর খসড়া লেখা, তারপর সম্পাদনার মাধ্যমে অসঙ্গতি দূর করার মতো অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়। এই লেখালেখির কাজের অনেকটাই পুনরাবৃত্তিমূলক। এইসব কাজে কল্পনার প্রয়োজন সামান্য এবং মেধা ব্যবহারের প্রয়োজন বা সুযোগও কম। এই কাজগুলিকে ChatGPT-র মতো ভাষা মডেল অনেকটাই করে দিতে পারে। লেখন বা সৃষ্টির যে ক্ষমতা, তা অর্থনীতির প্রেক্ষিতে উৎপাদনের সামিল।
এত অবধি পড়ে, পাঠকের যদি মনে হয় আমি আবারও জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো ১৯৭০-এ স্পোর্টস কারে ইঁট ছোঁড়ার মতো পরিকল্পনার চেষ্টা করছি, ভুল ভাবছেন। আসলে বলতে চাইছি– বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকার সময় পেরিয়ে গেছে। নিজের নিয়মে পুঁজি উৎপাদক মডেল ব্যবহার করে তার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াবে তা অনিবার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এমতাবস্থায় সুদক্ষ, স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের কি পরিবর্তন হবে?
ভারত বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম বড় বাজার। সেই বড় বাজারের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ভারতবর্ষের যুবসম্প্রদায় এবং ২৫ বছরের কম বয়সী যে বিপুল সংখ্যক যুবক-যুবতী আছে, তাদের শ্রম, সৃষ্টিশীলতা, মেধা ও কল্পনার অভাবনীয় ক্ষমতাই আগামী দিনের ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল শক্তি। গত ২০ বছরের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারতবর্ষের পরিষেবামূলক চাকরি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যে প্রভূত সুযোগ তৈরি হয়েছে তার মূল চালিকাশক্তি দু'টি–
১. ভারতবর্ষে নতুন পরিষেবা তৈরি হয়েছে যেখানে আগের ব্যবসাগুলিতে নতুন মোড়ক তৈরি হয়েছে। যেমন – Ola বা Uber এসে জনপরিবহণের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব এনেছে।
২. বিশাল আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি, যেটা ২০০০ সালের সময় থেকে বাড়তে শুরু করে, তা আরও আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
এই দু'টি ক্ষেত্রকে যদি একসঙ্গে দেখা যায়, তাহলে আমরা দেখতে পাব, ভারতবর্ষের এক বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষ, যাদের মধ্যে অনেকেই তরুণ এবং যুব সম্প্রদায়, তারা যে ধরনের কাজগুলি করে থাকেন তার অধিকাংশই অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে ছদ্ম-কর্মসংস্থান। মানে এই চাকরিগুলি অনেকাংশেই রুটিনভিত্তিক এবং পৌনঃপুনিক। এইসব কাজে তাদের সম্পূর্ণ কার্যকারিতাকে ব্যবহারই করতে হয় না বরং আংশিক কার্যক্ষমতাকে ব্যবহার করলেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মেধা এবং কল্পনার প্রয়োজন সীমিত। যে কাজগুলো অন্য উন্নত দেশগুলো করতে চায় না সেই কাজগুলিরই অনুষঙ্গ বলা যায় এই চাকরিগুলিকে।
আমার এক অতি পরিচিত বন্ধু কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থায় সেক্টর ৫-এ রাত ৮ টা থেকে সকাল ৮ টা অবধি কাজ করত। তার কাজ ছিল, আমেরিকায় তার সহকর্মীরা দিনের শেষে যে প্রেজেন্টেশন নিজেরা বানাতে চাইতেন না বা যে প্রেজেন্টেশনগুলো সময়ের অভাবে তারা করতে পারতেন না সেগুলো রাত্রি জেগে বানিয়ে ফেলা, যাতে পরের দিন সকালবেলা প্রেজেন্টেশনগুলো তৈরি থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জেনারেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল গুগল সম্বলিত। গুগল ওয়ার্কস্পেসের ডেমো দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এই ধরনের প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য আর সময় নষ্ট করার প্রয়োজনই নেই, একটা বা দুটো বোতাম টেপাই যথেষ্ট। একটা ডকুমেন্ট থেকে প্রেজেন্টেশন বানাতে বা প্রেজেন্টেশন থেকে ডকুমেন্ট বানাতে, বা প্রেজেন্টেশন থেকে আরও একটা প্রেজেন্টেশন বানাতে গুগল কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় নিচ্ছে। সুতরাং আমার বন্ধুটির আর সারা রাত জেগে থাকার প্রয়োজন নেই এবং তার সীমিত দক্ষতার শ্রমাবলম্বী উপার্জনের উপায়টিও সীমিত হয়ে গেল।
হে GPT তথ্যস্রোত, তুমি এলে কোথা থেকে?
বিষয়ান্তরে যাওয়ার আগে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ChatGPT যে তথ্যগুলি আমাদের পরিবেশন করছে সেই তথ্যগুলি এল কোথা থেকে? এই তথ্যগুলি আমাদেরই সৃষ্টি। ইন্টারনেট জুড়ে সমস্ত আন্তর্জাতিক ভাষাতে লেখা তথ্য এবং সমস্ত কোড মানুষই তৈরি করেছে লিখিত ইতিহাস শুরুর লগ্ন থেকে। ChatGPT এই সমস্ত তথ্যগুলোকে ব্যবহার করছে নিজের ভাষ্য উৎপাদনের জন্য। প্রশ্ন আসে যে, এই তথ্যগুলো যদি আমরাই তৈরি করে থাকি তাহলে সেই তথ্যগুলোর উপর আমাদের আদৌ কোনও অধিকার রয়েছে? কারণ উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলি তো শেষ পর্যন্ত আপনি বা আমি বা আমাদের মতো কেউই লিখেছেন! আন্তর্জালের পাতায় পাতায় আমরাই তো লিখেছি পথের পাঁচালি দেখার অভিজ্ঞতা বা রবিঠাকুরের জীবনী। ChatGPT-র জ্ঞান কি পশ্চিম মুলুকেই সীমাবদ্ধ? বাজিয়ে দেখতে, ChatGPT- কে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলার সুপরিচিত কবিদের বিষয়ে সে কী জানে? জিজ্ঞেস করলাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা কী কী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয় গোস্বামীই বা কী কী লিখেছেন? দেখা যাক ChatGPT আমাদের কী উত্তর দেয়।
ChatGPT যে সারা ইন্টারনেটের সমস্ত তথ্য সংশ্লেষ করছে, সেই তথ্যগুলির অধিকার আসলে কার? মুক্ত আন্তর্জালে এই তথ্যগুলির অধিকার আপনার, আমার কারওই নয়। যেহেতু ChatGPT একেবারে হুবহু কোনও নিবন্ধ থেকে টুকে দিচ্ছে না বরং সংশ্লেষ করছে তাই তাকে কপিরাইটের আওতাতে আনা সম্ভব নয়। এটি আমাদের সবার ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাইরে একটা কালেক্টিভ বা যৌথ সম্পত্তি। পাশাপাশি, ChatGPT বিনামূল্যে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে সবার। ChatGPT প্রযুক্তির ইতিহাসে সবথেকে তাড়াতাড়ি ১০ কোটি গ্রাহক সংখ্যায় পৌঁছে গেছিল যাত্রা শুরুর মাত্র একমাসের মধ্যে। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক কেউই এই রেকর্ড গড়তে পারেনি। যদি অতি দ্রুত ও বাধাহীন ভাবে ব্যবহার করতে চান, ChatGPT-কে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইবও করতে পারেন।
এইখানে এসে আরেকটা প্রশ্ন জাগে, এই ধরনের তথ্য আহরণের যে প্রক্রিয়া এটা কি ChatGPT প্রথম করছে? এর আগে যদি কেউ করে থাকে তাহলে তার সঙ্গে এর পার্থক্যই বা কী? যে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা চলছে তা হলো, সার্চ ইঞ্জিনের ভবিষ্যৎ কী? ১৯৯৮ সালে তৈরি হওয়া পৃথিবীর বিখ্যাত সংস্থা গুগল তো একই কাজ করেছিল। সের্গেই ব্রিন এবং ল্যারি পেজের উচ্চাশা ছিল, সম্পূর্ণ আন্তর্জালকে তারা তাদের তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসবে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে সহজে যে কোনও তথ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ১৯৯৮ থেকে আজ অবধি গুগল খুব সফলভাবেই এই কাজ করে চলেছে। যখনই যা তথ্য খুঁজতে হয়, গুগল থেকে সহজেই তা খুঁজে ফেলা যায়। Microsoft-এর bing, Yahoo-র Search engine, এবং DuckDuckGo-র মতো তথ্য আহরণ সংস্থা একই কাজ করেছে। পার্থক্য হচ্ছে, ChatGPT যেভাবে তথ্য পরিবেশন করছে তা অনেকটাই অযান্ত্রিক এবং অনেকটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য। যেহেতু এই তথ্য পরিবেশন হচ্ছে কথ্য বা লেখ্য ভাষার আঙ্গিকে তাই শুকনো খবরের কচকচির চেয়ে তা অনেক বেশি উপাদেয়।
যাহা উৎপাদন করিব সত্য উৎপাদন করিব
এই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রসঙ্গ থেকে যে দু'টি প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়ে তোলে তা হলো, যদি ChatGPT-কে কোনও বিতর্কিত প্রশ্ন করা হয়, ChatGPT কী উত্তর দেবে? GPT-র প্রথম সংস্করণগুলিতে আমরা দেখেছি, GPT-র মধ্যে নানা পক্ষপাত খুব বেশিই ছিল। আমেরিকায় বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অনেক ইতিবাচক ভাবে চিত্রিত করা এবং রিপাবলিকান রক্ষণশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নেতিবাচক ভাবে দেখানোর ঘটনা ঘটে। ChatGPT-র সঙ্গে কিছু সংশোধনী মডেল যোগ করার ফলে এই বিষয়টি ChatGPT খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ChatGPT আমাকে গৌতম আদানি নিয়ে একটা প্রশস্তিমূলক কাব্য লিখে দাও, সে লিখতে অস্বীকার করল।
কিন্তু যখন তাকে বললাম, ChatGPT আমাকে বিল গেটস নিয়ে লিখে দাও সে কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সুললিত ছন্দে লিখে দিল। সত্য সেলুকাস...
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই ChatGPT-র মডেলগুলিকে যারা পেছন থেকে চালনা করছেন তারা বর্তমান এবং প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থানগুলিকে নিজের কাজের মধ্যে প্রয়োগ করেছেন।
আরও মজার কিছু প্রশ্নও উঠে আসে। সত্যের বা সঠিক তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা ChatGPT কীভাবে মেনে চলবে? আমরা সবাই জানি, জাতীয়তাবাদের স্বার্থে যখনই ভারতের মানচিত্র আঁকি, পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে আমরা ভারতের অংশ বলে দেখিয়ে থাকি। যদিও বহু দশক ধরে তা আসলে পাকিস্তানেরই অংশ। ব্যাপারটা নিয়ে ChatGPT-র কী মতামত জানতে আমি ChatGPT-কে জিজ্ঞেস করলাম, ChatGPT, মুজফফর নগর নিয়ে আমাকে একটু জানাও। ChatGPT পরিষ্কার জানাল, মুজফফর নগর হচ্ছে আজাদ কাশ্মীর যা পাকিস্তানের অংশ এবং সেখানের যে লালকেল্লা আছে, শহিদ গলি আছে তার খবরও জানাল।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ChatGPT আমাদের যে তথ্য পরিবেশন করছে তার একটা আন্তর্জাতিক মান্যতা আছে এবং তা আঞ্চলিক পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে। আদানির প্রশ্নে ফিরে গিয়ে আমার মনে হলো, নীতিগত নিয়মের কী কী বেড়া পরানো আছে ChatGPT-র পায়ে? যে বিষয়গুলো সংবেদনশীল, যেমন ধর্মীয় ইস্যু, কিছু রাজনৈতিক ব্যাপার থেকে সে নিজের দূরত্ব তৈরি করছে। কিন্তু মান্যতার স্বার্থের সঙ্গে জড়িত অ-ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়গুলো সম্বন্ধেও কি সে মৌনই থাকবে? ChatGPT-কে প্রশ্ন করলাম, ChatGPT, জাতপাত কি এক ধরনের বৈষম্য? সে দ্বিধাহীন ভাবে উত্তর দিল, জাতপাত এক ধরনের বৈষম্য।
বর্তমান ভারতের প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ChatGPT, যোগী আদিত্যনাথ কি এই বৈষম্যমূলক জাতপাত মানেন? এটা কি ঠিক? ChatGPT জানাল, যোগী আদিত্যনাথের কিছু কাজকর্ম জাতপাতের বিভাজনকে আরও উসকে দেয়। তবে, যোগী আদিত্যনাথের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে শুধুমাত্র এই একটা প্রেক্ষিত দিয়ে বোঝা বা ভাবা উচিত নয়!
স্পষ্টই বোঝা যায়, যন্ত্রের কোনও বিষয়গত মনন এখনও তৈরি হয়নি এবং তার স্বাধীন মতামত নেই। সে শুধুমাত্র তথ্য উৎপাদন করছে। তাই বলে কি ChatGPT ভুল করে না? ChatGPT ভুল করে। আবারও মনে করিয়ে দিই, ChatGPT যেভাবে কাজ করে, তাতে সে অনুমান করার চেষ্টা করে যে কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসালে অর্থবহ গদ্য বা পদ্য বা সাংকেতিক ভাষা তৈরি করা যাবে। সে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারে না কিন্তু ভাষাগত অর্থবহতাকে সে মান্যতা দেয় তথ্যগত সত্যতার আগে এবং সেখানেই সে তৈরি করে ভ্রম। হ্যালুসিনেশন ChatGPT-র বৈশিষ্ট্য। আরও মনে রাখতে হবে, ChatGPT অন্য যেকোনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো তার প্রশিক্ষণ তথ্যের উপর নির্ভরশীল। GPT ৩.৫ মডেলের ক্ষেত্রে ৮৩% প্রশিক্ষণ হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। বাকি আরও ১০% হয়েছে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায়। তাই তথ্যগত চ্যুতির সম্ভাবনা কোনও ভারতীয় ভাষায় হওয়াটা অনেক বেশি সম্ভাব্য।
ChatGPT আপনাকে বা আমাকে সঠিক তথ্য পরিবেশন করার জন্য তৈরি হয়নি। ChatGPT তৈরি হয়েছে একটি ভাষাগত পারম্পর্যিক মডেল ব্যবহার করে বিনোদন বা তথ্য সরবরাহ করার জন্য। যে তথ্য আপনি আহরণ করছেন সেই তথ্য সঠিক কিনা তার যাচাই করার দায়িত্ব আপনার। যদি ChatGPT-কে সরাসরি ব্যবহার করতে চান নিজের প্রয়োজনে বা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য, সেক্ষেত্রে ChatGPT যে উত্তর দেবে তা সম্পূর্ণ সঠিক নাও হতে পারে। সেই সঠিক অর্থ যাচাই করার দায়িত্ব আপনার।
মানুষ কী করে ChatGPT-কে ব্যবহার করতে পারে? কীভাবে তার কাজগুলিকে, সময়ের ব্যবহারকে আরও সুসংহত এবং উৎপাদনশীল করে তুলতে পারে এই মডেল ব্যবহার করে? অর্থাৎ, একজন কর্মচারীকে নতুন করে আর রিপোর্ট লিখতে হলো না, রিপোর্ট সে উৎপাদন করল ChatGPT থেকে। কিন্তু তার সম্পাদনা সে করল। অর্থাৎ মানুষের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল এই সম্পাদনার কাজ। আপনি যদি বলেন, ChatGPT, এই হচ্ছে আমার অভিধান। এই অভিধান থেকে তুমি আমাকে তথ্য এবং শব্দ তুলে এনে বলো তাহলে ChatGPT শব্দ এবং তথ্য আপনাকে ওই অভিধান থেকেই তুলে এনে বলতে পারবে। সারা পৃথিবীর সমস্ত আন্তর্জাল থেকে তথ্য এনে বলবে না।
এই ফাইন টিউনিংয়ের কাজটিই এখন সারা পৃথিবীর তাবড় সংস্থারা, কোকা-কোলা থেকে মর্গ্যান স্ট্যানলি যারা ChatGPT নিয়ে উৎসাহী তারা নিজেদের কাজের জন্য করে চলেছে। এই ব্যবসাগত কার্যকারিতার উন্নতির প্রসঙ্গেই ইথান মা-লি-ক বলছিলেন, ‘ChatGPT is a tipping point for AI’।
শেষের কথা শুরুর বেলা
রীড হফম্যান, যিনি লিঙ্কডইন সংস্থাটির প্রধান, তিনি গত প্রায় ১ বছর ধরে GPT ৪-এর সঙ্গে নানান বিষয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি বই লিখেছেন। GPT ৪ এবং রীড একসঙ্গেই এই বইটির লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। বইটির নাম “Inpromptu: amplifying our humanity through AI”। তাহলে কি ChatGPT বা এই ধরনের মডেল শুধুমাত্র সাধারণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেওয়া, লাল বল-নীল বলকে খুঁজে বেড়াতেই আটকে নেই আর, মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আস্ত বই লিখে ফেলবে, নয়া মতামত তৈরি করে ফেলতে পারবে? সময় এর উত্তর দেবে। এখনও পর্যন্ত একটা বিষয় নিশ্চিত, রীড ছাড়া একা একা GPT৪ আস্ত বই কেন, একটা লাইনও লিখে ফেলতে পারবে না।
তাহলে আমরা কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আছি? যন্ত্র এসে আমাদের আর কোন কোন কাজ নিজে নিজেই করে দিতে পারবে? তথ্যনির্ভর অর্থনীতিতে যন্ত্রের মৌলিক নতুন সৃষ্টির ক্ষমতা এর আগে এত ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি।
এতদিন অবধি সেই কাজগুলিই যন্ত্র করেছে যাতে মানুষের শ্রমের পরিমাণ অতিকায় বা প্রাণের ঝুঁকি খুব বেশি। যন্ত্র কৃষকের কায়িক শ্রম লাঘব করল, রাস্তা নির্মাণে সহায়তা করল, সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে থাকা তেল তুলে এনে শক্তি পৌঁছে দিল দূর-দূরান্তে, খাদানের মধ্যে থেকে গিয়ে কয়লা তুলে আনতে শুরু করল। মানুষের শ্রম সহজ হল, প্রাণ কিছু বাঁচল। এখন তাহলে যন্ত্রই মানুষের হয়ে প্রতিবেদন লিখে দেবে, কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় পরিকল্পনা করে দেবে? ১৯৭০-৮০ দশকের পর থেকে আমরা শিল্পোত্তর সমাজ অর্থাৎ তথ্যনির্ভর সমাজে বসবাস করছি যার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ইনফরমেশন বা তথ্যের বিশ্বজনীন আদান-প্রদান। এই তথ্যমূলক সমাজে দাঁড়িয়ে আমরা এতদিন অবধি যা করতাম তাতে এই তথ্যের সামগ্রিক যাতায়াতকে আরও সহজ করে তোলা, তার গুণমান বাড়ানো, তাকে নিজেদের প্রয়োজন মতো নিপুণভাবে ব্যবহার করা- এই বিষয়গুলিতে যন্ত্র ছাড়াও মানুষের ভূমিকাই ছিল বেশি। কিন্তু পোস্ট ইনফরমেশন সোসাইটি বা তথ্য-উত্তর যুগ কী? যে সমাজে যন্ত্রই তথ্য উৎপাদন করতে পারে সেখানে তথ্য-শ্রমিকদের কি চাহিদা থাকবে? কীভাবে নতুন শ্রমের সমীকরণ তৈরি হবে তাই নিয়ে আমাদের এখনও অবধি কোনও সঠিক ধারণা নেই। তবে তথ্য-উত্তর সমাজে সম্পদ আহরণের জন্য মানুষের মেধার ও কল্পনার ভূমিকা, প্রয়োজন আরও বাড়বে এবং আমাদের চিরাচরিত শ্রমের প্রয়োজন আরও কমবে। এবং তা মূলগত জায়গায় যে এক বিশাল সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবে; তা অনস্বীকার্য।
কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার! যেহেতু ChatGPT বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে এবং এর ব্যবহারের বাজারমূল্য বেশ সাধ্যের মধ্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে এটা ভাবা অমূলক নয় যে, সেক্টর ৫-এর উজ্জ্বল বিল্ডিংগুলো থেকে সারি সারি বেরিয়ে আসা তরুণ যুবদের কাজের ধরন খুব শীঘ্রই বদলাবে। সাংবাদিকদের বা উকিলদের বা ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও অবস্থা বদলাবে। মধ্যমেধার পরিসরে নিজেদেরকে বেঁধে রাখলে IBM হয়তো একবার ফিরে যাবে কিন্তু কয়েক বছর পর, কয়েক মাস পর, কয়েক সপ্তাহ পর, কয়েক দিন পর বা কয়েক মিনিট পর সে ফিরে আসবে।
তাকে আটকে রাখা অসাধ্য।
লেখক পরিচিতি : লেখক বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে বড় বৈদ্যুতিন ব্যাঙ্ক নুবাঙ্ক-এর জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত; ইতঃপূর্বে ফেসবুক, টুইটার এবং পিনটারেস্টের বিজ্ঞাপন ব্যবসা সংক্রান্ত বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বার্কলে এর স্নাতকোত্তর ও ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী।