বল পড়ে, টাকা ওড়ে || বেটিং অ্যাপ যেভাবে বদলে দিল ক্রিকেট-দর্শন
IPL Betting: একবার ভেবে দেখা যাক, ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য্যে ক্রিকেট আপনাকে বিনোদন দিতে পারছে কি? না এমন কিছু উপাদান খেলার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে ক্রিকেটের নন্দনতত্ত্বকেই গ্রাস করে ফেলছে?
It’s just not cricket!
জীবন বোধহয় চাইছে আরও অনেক কিছু। মোবাইলের স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে শুধু ক্রিকেট দেখেই চাহিদা মেটে না। তাই আইপিএল ক্রিকেটের সঙ্গে বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের এক মোহনায় মিলিয়েছে। কোটিপতি এই তারকাদের জীবনযাত্রাও ফ্যানদের প্রভাবিত করে চলেছে প্রতিদিন। আজকাল আর এই টি-২০ লিগ মানে তারকা নিলামই নয়, মরসুম জুড়ে বেসরকারিভাবে সাধারণ দর্শকদের জন্যও রয়েছে কোটি টাকা রোজগার করার হাতছানি।
এই উদ্দেশ্যেই বাজার মাতাচ্ছে কিছু গেমিং অ্যাপ ও বেটিং সাইট। লিগের সেরা তারকা, ফিল্মস্টারদের এই অ্যাপগুলোর বিজ্ঞাপনে নিত্য যাওয়া-আসা। “শুধু ক্রিকেট দেখ না হাঁ করে, একটা টিম বানিয়ে ফেল তাড়াতাড়ি, আর জিতে নাও…”, বা “তুমি টিম বানাও, বাকিটা আমি করে দিচ্ছি”- তারকাদের এই বিপণন স্টান্স আশ্বাসবাণীর মতো কাজ করছে কোটি কোটি দর্শকদের মধ্যে। এবং খুব সহজেই তারা প্রভাবিত হয়ে বাজি ধরে ফেলছেন নিজের একদিনের রোজগার, কখনও বা এক সপ্তাহের, কখনও বা সারা মাসের। শুরুতে একবার দু'বার টাকা খোয়ালেও কুছ পরোয়া নেহি; মোট ৭৪ টা ম্যাচ রয়েছে টুর্নামেন্টে। আর একটু 'সমঝদারের' মতো টাকা খাটালে, সামনের দিনে 'সাফল্য' আসবেই! একটা দুটো ম্যাচ হারলেই কি একটা টিম ছিটকে যায়? অর্থাৎ জুয়ার এই মোহ সহজে ছাড়ে না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে; টুর্নামেন্ট যত এগোয় ম্যাচ পিছু লগ্নির পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ফুলে-ফেঁপে ওঠে বেটিং অ্যাপগুলো।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, ষষ্ঠদশ আইপিএলের মোট বিজ্ঞাপনের কুড়ি শতাংশ এসেছে ইকম-গেমিং অ্যাপগুলো থেকে, গত বছরের তুলনায় যা অনেক গুণ বেশি; বিজ্ঞাপনদাতার তালিকায় তারপরেই রয়েছে পানমশলা। এবং এই মরসুমে বিজ্ঞাপনদাতার চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, ট্যাম স্পোর্টস-এর (ট্যাম মিডিয়ার অন্তর্গত একটি বিভাগ) রিপোর্ট অনুসারে। গত মরসুমের প্রথম সাতটি ম্যাচের নিরিখে বিজ্ঞাপনদাতার তালিকায় এগিয়ে ছিল ই-কম শিক্ষা, ইকম-শপিং ও ইকম-ওয়ালেট সংস্থাগুলো। এর থেকে কিছুটা পরিষ্কার, শহর থেকে প্রান্তিকে ব্যবসা বৃদ্ধি হয়েছে গেমিং-অ্যাপগুলোর এবং এই মরসুমের শুরু থেকেই আরও বড় মুনাফার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়েছে তারা। আর একটা জিনিসও কিছুটা মালুম হয় যে, এই রমরমা বেটিং সিন্ডিকেট এখন বৃহৎ অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন- রঙিলা আইপিএল এবং ভারতীয় ক্রিকেটের বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ
গ্লোরিয়াস গেম অব আনসার্টেনটি, বা মহান খেলার অনিশ্চয়তা এই জুয়াচক্রের বড় পুঁজি। খেলার এই অনিশ্চয়তা অবশ্যই টি-২০ তে অনেকগুণ বেশি, যেখানে পরপর তিন-চারটে বলই বদলে দিতে পারে ম্যাচের রং। তবে গেমিং অ্যাপ-বেটিং সাইট সহ সমগ্র বেটিং সিন্ডিকেটের আরও বড় পুঁজি হলো বর্তমান অর্থনীতিতে জীবনে ও জীবিকার অনিশ্চয়তা; বাড়তে থাকা বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান আর্থসামাজিক সঙ্কট ও নিরাপত্তাহীনতা, দৈনন্দিন জীবনের অভাববোধ ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে অ্যাপগুলো সহজেই কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়ার 'সুযোগ' নিয়ে হাজির, বা 'কপাল ভালো' হলে কোটিপতি বানিয়ে দেওয়ার মোহ। ক্রিকেটবোদ্ধা থেকে ক্রিকেট বুদ্ধু, দুই প্রকারের মানুষই এই মোহজালে জড়িয়ে পড়েন সহজেই। কিন্তু মোহ আর বাস্তবতা তো এক জিনিস নয়, তাই অধিকাংশ গেমারই এক্ষেত্রে খোয়াবেন বেশি, এটাই ক্রিকেট জুয়ার নির্মম পরিণাম। যেমন কেউ কেউ মনে করেন, তাদের ক্রিকেট-বোধ এক্কেবারে নামী কোচ বা বিশেষজ্ঞদের মতোই, তাদের ক্রিকেট-জল্পনা কখনও ভুল হতেই পারে না! আবার এমনও আছেন, যারা ক্রিকেটের কিছুই প্রায় বোঝেন না, ক্রিকেটারদের দক্ষতা তো দূর অস্ত, নাম পর্যন্ত জানেন না, কিন্তু হঠাৎ কিছু বাড়তি উপার্জনের জন্য তারাও এই মোহজালে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এই দ্বিতীয় পক্ষ অনেক সময় নির্ভর করে প্রথম পক্ষের ওপর। কিন্তু আইপিএল বেটিং আপাতভাবে যতটা সরল, নির্যাসে ততটাই জটিল। তাই কোনও কোনও অ্যাপে মাত্র দুশো টাকায় বাজি ধরা শুরু করা যায়, চার হাজার টাকা অবধি বিনামূল্যে খেলে যাওয়ায় যায়। শুরুর দিকে সামান্য কিছু টাকা জিতলে ঝোঁক বেড়ে যায়, সেটা পরের ম্যাচে আবার খাটানোর অঢেল সুযোগ। কিন্তু 'বড়' বাজি জেতা প্রায় অসম্ভব।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ক্রিকেট বেটিং কি নতুন কিছু? বিধানসভা নির্বাচন সহ অনেক কিছু নিয়েই তো জুয়া চলতে থাকে। তাহলে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় তার বিষয়ের ওপর দখল কাজে লাগিয়ে বাজি ধরতে চান এবং কিছু রোজগার করেন, এতে আপত্তি কিসের? পর্তুগালের মতো কিছু দেশে খেলা নিয়ে তিন ধরনের জুয়া আইনসম্মত। তাই বছর দশেক আগে অবধি আইপিএল বেটিং সিন্ডিকেটেরও হেড কোয়ার্টার ছিল পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহর। তখন স্রেফ ফোনের মাধ্যমে খেলা যেত, আলাদা অ্যাপ বা সাইট ছিল না এবং বিষয়টা মূলত তথাকথিত হোয়াইট কলার ম্যানেজার আর ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে অ্যাপের মাধ্যমে এই জুয়াচক্রের রমরমা জেলায় জেলায় আমজনতার মধ্যে জাল বিস্তার করে ফেলেছে। চাকরিজীবী থেকে গৃহবধূ, বর্তমানে মহিলারদের মধ্যেও ক্রিকেট-জুয়ার প্রবণতা উর্ধ্বমুখী। এদেশে এরকম বেটিং আইনসম্মত কিনা তা নিয়ে প্রবল সংশয় আছে। যদি তা না হবে, তাহলে এত প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন হতে পারে কী করে? কী করেই বা সমাজমাধ্যম থেকে জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলে বারবার ভেসে উঠবে অ্যাপে ডাউনলোড করার বার্তা?
বিজ্ঞাপনের শেষে অবশ্য তারকারা টাকা খাটানোর ঝুঁকির বিষয়টা নিয়ে একটা সতর্কবাণী দেন, কিন্তু 'খেলায় মেতে ওঠার' মূল আবেদনের তীব্রতায় তা চাপা পড়ে যায়। সুপারস্টারা মাঠ ও বিজ্ঞাপন থেকে মোটা টাকা পান, এছাড়া তাদের আর কোনও বাড়তি দায়বদ্ধতা নেই। ক্রিকেট জুয়ার পক্ষে যারা সওয়াল করছেন, তাদের পাল্টা প্রশ্ন করুন, এ ধরনের বেটিংয়ের পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা বলে কোনও বিষয়বস্তু থাকা আদৌ সম্ভব কি? বিশেষ করে কোনও টিমের হারার উপরও যখন মোটা টাকা বাজি ধরা যায়! ক্রিকেট-জুয়া নিয়ে নির্দিষ্ট আইন না থাকলেও, ম্যাচ-ফিক্সিং বা স্পট ফিক্সিং নিয়ে তো আছেই। সেক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ইতিহাস আর একবার স্মরণ করে দেখা যাক।
আরও পড়ুন- ক্রিকেটারের ধর্ম কী? জানা কি খুব জরুরি?
আইসিসি নিয়োজিত পল কন্ডন কমিটি ২০০৬ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে যে, ভারত উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ বিশ্বকাপের বহু ম্যাচ ফিক্স করেছিলেন বুকিরা। ২০০০ সালের ভারত সফরে এসে একদিনের সিরিজে হ্যানসি ক্রোনিয়ের ঘটনা কেই বা ভুলতে পারেন? পরে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন অধিনায়ক কবুল করেন তিনি টাকা নিয়ে ম্যাচ ছেড়েছিলেন। শাস্তিস্বরূপ তাঁর চিরনির্বাসন ও তার কিছুদিন পরেই রহস্যমৃত্যু। সেখানেই শেষ নয়; সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ফর্মে নানা যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন কোচ বব উলমার। পাকিস্তানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ চলাকালীন, হোটেলের ঘরে নিহত হন তিনি। উলমার একটি বই লিখছিলেন, যাতে ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে একটা অধ্যয় ছিল। উলমারের অকস্মাৎ মৃত্যুতে সেই বই অপ্রকাশিতই থেকে যায়। বছর দশেক আগে আইপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য শ্রীসন্থ সহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। পরে তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়ে শাস্তিও পান, যদিও তারপর বিশদ তদন্তে যবনিকা পড়ে যায়। অর্থাৎ, যত দিন গেছে ফিক্সিং-রহস্য ততই ঘনীভূত হয়েছে, আর ক্রিকেট জুয়া ততই সংগঠিত ও রমরমা হয়েছে। কৃত্রিম উপায় খেলার অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়ে বেটিং-সিন্ডিকেটই ক্রিকেটকে বেসবলে পরিণত করছে না তো? খুঁটিয়ে কোনও ম্যাচ বিশ্লেষণ করলে, সংশয়টা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।
বিশেষ করে টস থেকে শুরু করে শেষ ওভারে ক’টা উইকেট পড়বে বা ক’টা ছক্কা হতে পারে, সব কিছু নিয়েই যেখানে বাজি ধরার উপায় রয়েছে! একটা টি-২০ ম্যাচে ২৪০ টা বল, গড়পড়তা ম্যাচ পিছু যদি ১২০০-১৪০০ কোটি টাকা খাটে, তাহলে বল পিছু কত টাকার জুয়া হয় হিসেব করে দেখুন একবার! নকআউট পর্বে এই জুয়ার পরিমাণ চার-পাঁচগুণ বেড়ে যেতে পারে! আর যখন এই জুয়ার জোয়াড়ে গা ভাসিয়ে কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, কেউ বা সর্বস্বান্ত, কোথাও বা বিশ্বাসের সম্পর্কে চিড় ধরছে, এমনকী আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, তখন বিষয়টা গভীর উদ্বেগের ও বিশেষভাবে তলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে নিঃসন্দেহে! এবছর মহিলা ক্রিকেটেও আই পি এল ধাঁচের লিগ শুরু হয়েছে; বিষয়টা বহু নতুন মহিলা-ক্রিকেটারকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে পারে, আবার এই জুয়াচক্রের অশনি-সংকেতও রয়ে যাচ্ছে; যা শেষ করে দিতে পারে প্রতিযোগিতার ক্রিকেটীয় গুণাবলী।
তাই ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তা উপভোগ করুন, রিঙ্কু সিংয়ের মতো উঠতি তারকাদের উৎসাহ জোগান; কিন্তু আলেয়ার পেছনে ছুটে নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি না বাড়ানোই ভাল। একবার ভেবে দেখা যাক, ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য্যে ক্রিকেট আপনাকে বিনোদন দিতে পারছে কি? না এমন কিছু উপাদান খেলার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে ক্রিকেটের নন্দনতত্ত্বকেই গ্রাস করে ফেলছে?
What do they know of cricket, who only cricket know?
C.L.R James