কেমন ছিল পুরীর মন্দিরের দেবদাসীদের জীবন...

Devadasi: মরার আগে অবধি মন্দির শশীমণিকে দিত মাত্র তিনশোটি টাকা পেনশন, প্রতি মাসে!

“....উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল

এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে

শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;

নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;

তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?

কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”

মেয়েটি নেচে চলেছে একা। মন্দিরের বুকে অস্তরাগের লজ্জা পা রাখে। মেয়েটির গালে, ঠোঁটে, নাকের কিয়ংদশ সেই রাগ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘুরেফিরে। পায়ের তালের সঙ্গে তাল রাখা সে সরলরেখার পক্ষে অসম্ভব। তবু যেটুকু পাওয়া যায়। তবু যেটুকু পড়ে পাওয়া জুটলে ধন্য হয় মালিক সূর্যদেব, সেইটুকু। ধূলায় জড়িয়ে জড়িয়ে মেয়েটির নাচের তেজ উঠে যায় ক্রমশ সূর্যের দিকে। যেমনটি গিয়েছিল কৃষ্ণের দ্বারা নিহত কর্ণের বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসে। কে কার অলঙ্কার? কী ভালো কীইবা মন্দ? এইসব ক্ষেত্রগুলো এতটাই ধূসর, মাঝ বরাবর কোনও দাগ টানা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেটুকু তখন থাকে পড়ে, সেইটুকুই দৃষ্টি।   দেবদাসী প্রথাকে কী আখ্যা দেব? প্রেক্ষিত বিবর্জিত আখ্যারা চিরকালই অনাচারী।

ইতিহাসে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য় নজির

দেবদাসী প্রথার ইতিহাস ভারতে বেশ দীর্ঘ। বুকানন থেকে দুবোয়া, দেবদাসীপ্রথা নজর এড়ায়নি কারো। পর্তুগীজ পর্যটক ডোমিনগো পায়েস কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে বিজয়নগরের দেবদাসীদের জাঁকজমকের যা বর্ণনা করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। ১৫০০ থেকে ১৫০২ সালের মধ্যে লেখা হচ্ছে এই বিবরণ। ধারওয়ার বা কাঞ্চিপুরমের মন্দিরের দেবদাসীরাও জগৎ বিখ্যাত। তবে শুধু দক্ষিণে নয়, এদেশের সর্বত্র এককালে এই প্রথা যে ছিল, তার প্রমাণ মেলে। ‘মালবিকাগ্নিমিত্রমে’র মালবিকা দেবদাসী হয়তো ছিলেন না, কিন্তু কালিদাসের আমলে যে এই প্রথা ছিল তার অন্যতম প্রমাণ ‘মেঘদূত’। তার পাতায় পাতায় দেবদাসীর ‘হিল্লোলিত অঙ্গের কল্লোল’ যেন এখনও ভেসে আসে। উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে মেয়েটির সেই নাচ! পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণেও নাকি দেবদাসীর উল্লেখ আছে। ভবিষ্যপুরাণ তো পরামর্শই দেয়– “যদি, সূর্যালোকের মন জয় করতে চাও, তবে কোন সূর্যমন্দিরে একদল নর্তকী উপহার দিয়ে যাও!” অধিকাংশ পুরাণ রচনার কাল অনুমান করা হয় খৃষ্টিয় ষষ্ঠ শতক। সপ্তমে হিউ এন সাং, অষ্টমে রাজতরঙ্গিনী-তেও সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে কাশ্মীরে এককালে দেবদাসী ছিল। আলবেরুনি দেবদাসীদের দেখতে পেয়েছিলেন পশ্চিম ভারতেও। আল্‌কেতার লিখেছেন, ‘কুট্টিনিমাতম’ অনুযায়ী বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরেও এককালে ওঁরা নাচত। টাভারনিয়ার গোলকুণ্ডায় ওঁদের পল্লি দেখেছিলেন। এবং সবশেষে আসি বার্‌নিয়ারের কথায়, কারণ বার্‌নিয়ার পুরীর মন্দিরে দেবদাসী দর্শন করেছিলেন!

আদিতে যেমন ছিল

পুরীর মন্দিরে অধুনালুপ্ত দেবদাসী প্রথা প্রায় ৮০০ বছর পুরনো। নব্বইয়ের দশকে প্রায় মরে আসা প্রথার গোড়ায় জল ঢালার চেষ্টা করে মন্দির কর্তৃপক্ষ, কিন্তু দেশজোড়া আন্দোলনে তা কার্য্যকর হয়নি। ৩৬ ধরনের সেবা করতেন দেবদাসীরা। দ্বাদশ শতকের এই বিষ্ণু মন্দিরে এটাই একমাত্র ক্ষেত্র, যা নারীর অস্তিত্বকে স্বীকার করেছে। রবি নারায়াণ মিশ্রের বলছেন, দেশে এই একটি মাত্র বিষ্ণুমন্দির, যেখানে নাচ গানের বাইরেও মেয়েদের বিগ্রহের সেবা করতে দেওয়া হত। ৩৬ নিয়োগের মধ্যে মহরি সেবা মূলত দেবদাসীদের সেবা। পুরীর মন্দিরে দেবদাসীদের অপর নাম মহরি।

কেমন সেই সেবার ধরন

মন্দিরে জগন্নাথ দেব ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার সামনে নাচ গান নিবেদন করা হত। প্রচলিত বিশ্বাস, কলার মধ্য দিয়েই জীবাত্মার পরিশুদ্ধি। রত্ন সিংহাসন হল ‘ওম’, সৃষ্টির আদি নাদ। নাচ, গান এবং বিভিন্ন চারুকলা হল সেই বিভিন্ন নাদের আলো যা সৃষ্টির আদিতে ফেরার পথ দেখায়, পরমের সঙ্গে একাকার করে। এই একাকারে, একতায় বেদান্তের অদ্বৈতবাদেরই প্রতিফলন। জগন্নাথের দর্শন থেকেই পুরীর মন্দিরের বিভিন্ন শিল্পকলায় এসেছে বৈচিত্র। মন্দিরে দেখা যায় বীণা, বাঁশি, মাদল, ডম্বরু, কহলি ইত্যাদি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র! রাবণের রাজসভার আদল যেন। মাদল পাঞ্জী কবি নরসিংহ দেব (১২৮২-১৩০৭ খৃষ্টাব্দ) প্রথম গীত-গোবিন্দ গান ও নৃত্য মন্দিরে প্রবর্তন করেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মহরি নাচ শুরু হয় মন্দিরে। অনেকে বিশ্বাস করেন, রম্ভা এবং মেনকা জগন্নাথের প্রথম দেবদাসী। প্রায় মন্দির প্রতিষ্ঠার কাল থেকেই ‘নাচুনি’ সেবায়তদের সেবার অঙ্গ। দেবদাসীদের এই মহরি নৃত্য ছিল ওড়িয়া সংস্কৃতি গড়ে ওঠার একটা মূল স্বোপান। ওড়িশি নৃত্য এবং গতিপুয়া নৃত্য এই মহরি নাচের ধরনেই গড়ে উঠেছে। 

পুরীর মন্দিরের এই দেবদাসীদের কখনও কখনও রাধাদাসীও বলা হত। জগন্নাথ স্বয়ং কৃষ্ণ। বেদান্তের অদ্বৈতবাদের ফাঁক গলে বৈষ্ণব দ্বৈতবাদ সরু হয়ে জাফরি কাটে এখানে ওখানে। যদিও দেবদাসীদের ওপর নানান অত্যাচারের গল্প হয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়, পুরীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্য রকম। শোষণ যখন অভ্যেসে পরিণত হয়, তখন তার ধার যায় কমে, শোষকের তৈরি রীতির ভিতরেই শোষিত প্রতিরোধের জন্ম দেয়। এখানেও সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পুরীর দেবদাসীদের বিয়ে হত জগন্নাথের বিগ্রহের সঙ্গেই। যদিও বাঈজিদের মতোই রাজসভায় বা জমিদার ঘরে তাদের ডাক পড়ত হামেশায়, কিন্তু দেবদাসীদের সমাজ থেকে প্রাপ্য সম্মান ছিল অনেকটাই বেশি।

ভক্তদের মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হত তাঁদেরই। বিয়ের পর শুরু হত তাদের দীক্ষা। তরুণীদের দত্তক নিত যে প্রবীণ দেবদাসীরা, সেই মায়েরাই ছয় থেকে সাত বছর নৃত্যগীতকলায় তাঁদের পারদর্শী করে তুলত। ভগবানের সঙ্গে মিলিত হবার অধিকার জন্মে তখনই যখন সে জাগতিক চাওয়া পাওয়া থেকে মুক্ত-- এই শিক্ষায় তাঁদের নিজস্ব যৌন ইচ্ছার বিপদকে খানিক প্রশমিত করত ব্রাহ্মণরা। এক্ষেত্রে পুরষ্কারের চলও ছিল। যে দেবদাসী সারা জীবনে প্রেম বা যৌনইচ্ছা প্রকাশের থেকে বিরত থাকত, যাঁদের তৎকালীন উচ্চবর্ণ ‘পতিব্রতা’ বলত, একমাত্র তাঁরাই বিয়ের সময় মন্দির থেকে তাঁরা যে শাড়ি পেয়েছিলেন, তাই পরে চিতায় ওঠার ‘সম্মান’ পেতেন। এ পুরষ্কারকে লোভনীয় করে তোলার চেষ্টায় বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। তবে প্রতিরোধ কীভাবে? তাতেও আসব ক্রমে।

শেষ দশক

নথি বলছে গত শতাব্দীর শুরুতেও  পুরীতে ৫০-৬০ ঘর দেবদাসী ছিল। এঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন, সেই অনুপাতে আলাদা আলাদা বিভাগ ছিল। গর্ভগৃহের ভিতরে জগন্নাথের খাওয়ার সময় যাঁরা গান করতেন তাঁদের বলা হত ভিতর-গায়নী। দেবদত্ত সামন্তের মতে ভিতর-গায়নীর শেষ প্রদীপটি নিভেছে ১৯৯২ সালে, কোকিলপ্রভা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই! আশির দশক পর্যন্তও হরপ্রিয়া, কোকিলপ্রভা, শশীমণি ও পরশমণি-বেঁচে ছিলেন এই চারজন। এছাড়া ছিল ‘নাচুনি’, যাঁরা মূলত গর্ভগৃহের সংলগ্ন প্রেক্ষাগৃহে নাচতেন, ‘পাতুয়ারি’, যাঁরা ভগবানের যাত্রায় ও নানা মিছিলে রাস্তায় নাচতেন। এবং গর্ভগৃহের বাইরে যাঁরা গান করতেন, তাঁদের বলা হত ‘বাহার গায়নী’। শশীমণি ও পরশমণি ছিলেন এইদলের। বিশেষত রথযাত্রা ও নবকলেবর উৎসবে এঁদের মুখ্য ভূমিকা ছিল। চোদ্দ বছরে একবার জগন্নাথের কাঠের বিগ্রহ পালটে ফেলা হয়। সেই অনুষ্ঠানই নবকলেবর। এছাড়া চন্দন যাত্রা, চম্পক দ্বাদশী, হের পঞ্চমীতেও দেবদাসীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজ কি এঁদের আপন করে নেবে? নিয়েছে কোনওদিন?

মিসেস মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি, শ্রীমতী আমান্না রাজা, রাও বাহাদুর এস কে বোলে--একের পর এক সিলেক্ট কমিটির কাছে বিল উত্থাপন করে বহু চেষ্টায় এই প্রথ রদ করা হয় ৪৭ সালে স্বাধীনতার কয়েক মাস আগেই। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সন্দেহ নেই। বিশেষত মদনমোহন মালব্য থেকে গান্ধীজি, সবাই যখন বারংবার এঁদেরকে পতিতা, অসৎ চরিত্রা বলেছেন! ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য-পিতৃতান্ত্রিক বোধ তখন উচ্চবর্ণ তথা মধ্যবিত্ত নারী-পুরুষদের আহ্লাদই না দিয়েছিল। তাদের দেশ নিয়ে আর কুৎসা রটবে না! এইবার কলঙ্ক ঘুচল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, অন্তত সনদে সই করতে গেলে আর কেউ প্রশ্ন করবে না! অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এ বিষয়ে দেবদাসীদের মতামত কেউ জানতে চাইলে না! আইনে কোথাও লেখা রইল না, এই বাতিল প্রথার যে ছেঁড়াখোড়া শিকড় পড়ে রইল, এঁদের দায়িত্ব নেবে কে? সমাজ কি এঁদের আপন করে নেবে? নিয়েছে কোনওদিন?

শেষ দেবদাসীর মৃত্যু

নতুন দেবদাসী নেওয়া বন্ধ করা হল, অত্যন্ত সুখের বিষয়! প্রশ্ন থেকে যায় যাঁরা ততদিনে দেবদাসী হয়ে গিয়েছে তাঁদের কী হবে? ৮৫ বছর বয়সে ভাঙা পা নিয়ে শয্যাশায়ী শশীমণি একটা ভাঙা ঘরে ধুঁকতে ধুঁকতে যে দৃঢ়তায় বলে গেলেন, “কোনো বাছাকে জোর করে দেবদাসী করা পাপ!” সেই দৃঢ়তার কী মূল্য দিয়েছে সেই উল্লাসিত শিক্ষিত উচ্চবর্ণ? মরার আগে অবধি মন্দির শশীমণিকে দিত মাত্র তিনশোটি টাকা পেনশন, প্রতি মাসে! মন্দিরের আয় কিন্তু কমেনি! প্রচণ্ড গরীব অবস্থায় ২০১৫ সালে ৯২ বছর বয়সে মরে জুড়িয়েছেন শশীমণি। একা পরশমণি মিটিমিটি জ্বলছিলেন। গত বছর জুলাইয়ে তার মৃত্যু হলো।

এককালে দেবদাসীরা ছিলেন সমাজে অত্যন্ত ‘সম্মানিত’! তাঁদের বৈধব্যের যন্ত্রণা ছিল না! সম্মান, শুদ্ধতার সাবর্ণধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল তাদের বেঁচে থাকা। পতিতা বলে ভাবা হতো না তাদের।  প্রচুর বিত্ত, প্রচুর ক্ষমতা থাকত প্রতিষ্ঠিতা দাসীদের। এবং সর্বোপরি দেবদাসীদের সম্পত্তিতে ছেলে এবং মেয়ের ছিল সমান অধিকার ছিল। তা বলে অবশ্য এই কুপ্রথার অন্ধকারকে অস্বীকার করা যাবে না।

তথ্যঋণ-

Devadasi tradition dying at Puri temple in Orissa, DNA, Nov 19, 2013

Devadasis Of Lord Jagannath: A Lost Tradition Of Divine Romance, Charudutta Panigrahi, DISHABYTES, Jul 20, 2018

Jagannath Temple’s last ‘devdasi’ Parasmani Devi dies at 90, Mint, 10th july 2021

দেবদাসী, শ্রীপান্থ, দে’জ পাবলিশিং

মেঘানাদবধ কাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত

 

More Articles