জোড়া পা খুইয়েও এভারেস্টের শীর্ষে, কী ভাবে অসাধ্য সাধন করলেন হরি মাগার?

Mount Everest : দুই পা হারিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, মনের জোরে কৃত্রিম অঙ্গ নিয়েই জয় মাউন্ট এভারেস্ট! নতুন উদাহরণ তৈরি করলেন অভিযাত্রী হরি মাগার

কেবল ইচ্ছে শক্তির জোরে যে কোনও যুদ্ধই যে জেতা যায়, ফের একবার প্রমাণ করে দিলেন বছর তেতাল্লিশের হরি বুধামাগার। আজ প্রায় ১৩ বছর হল তাঁর দুটি পা-ই নেই। কিন্তু মনের জোর আছে ভরপুর। আফগানিস্তানের ব্রিটিশ গোর্খা রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন হরি। ২০১০ সালে সেই বাহিনীতেই কর্তব্যরত অবস্থায় একটি বীভৎস আইইডি বিস্ফোরণে দু'টি পা-ই উড়ে গিয়েছিল তাঁর। এর পর থেকেই ভরসা কেবল কৃত্রিম পা জোড়া। পা দুটি চলে যাওয়ায় তাঁকে বাধ্য হয়েই সরে আস্তে হয়েছিল গোর্খা সেনাবাহিনী থেকে। প্রাথমিকভাবে এই আকস্মিক ঘটনা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি তিনি, ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে জমে থাকা যোদ্ধার রূপটা তাঁকে ফের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। নতুন কোনও যুদ্ধ। কৃত্রিম পা জোড়া সম্বল করেই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ান হরি বুধামাগার। আর সেই নতুন যুদ্ধে আজ তিনি জয়ী। মনের জোরেই সম্প্রতি এভারেস্টের শিখর ছুঁয়েছেন তিনি। তাঁর এই লড়াই আজ আরও অনেকের কাছে উদাহরণ, তা বলাই বাহুল্য।

হরি বুধামাগার, পাহাড়ি ছেলে। ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত হরি কাটিয়েছেন নেপালের একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে। দুর্গম পথে হাঁটার শুরু তাঁরা সেই ছেলেবেলা থেকেই। চড়াই উৎরাই পাহাড়ি পথে শৈশবে খালি পায়ে স্কুলে যাওয়ার পথেই মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখতেন হরি। সেই স্বপ্নকে সঙ্গী করেই পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে সাথ দেয় না। মাঝ পথে হঠাৎ চলে যায় তাঁর পা দুটো। কিন্তু স্বপ্ন দেখার তো এভাবেই শেষ হয় না, তাই পা হারিয়েও স্বপ্ন হারাননি তিনি। একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেছেন যাতে একদিন সত্যিই ছুঁতে পারেন হিমালয়ের চূড়া।

hari budha magar reaches summit of mount everest

কিন্তু এই অভিযান মোটেই সহজ ছিল না হরির কাছে। বারবার বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু জেদ ছাড়েননি। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ মনে করেছিলেন হরি। এগিয়ে গেছেন লক্ষ্যের দিকে। প্রথম দিকে বেশ কিছু বাধা আশায় মানসিক অবসাদে ভোগেন, তবে পরবর্তীতে কাটিয়ে ওঠেন সেইসব। একটু একটু করে নকল পায়ে ভর দিয়ে সাইক্লিং, গল্ফ, ক্লাইম্বিং চলতে থাকে। অচিরেই ফিরে পান আত্মবিশ্বাস। ব্যাস অমনি সেই জনে থাকা স্বপ্ন পূরণের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেন।

আরও পড়ুন - মৃত ছেলে বেঁচে থাকবে অন্য ১১ জনের মধ্যে, যে উদাহরণ গড়লেন মহারাষ্ট্রের চিকিৎসক দম্পতি

বছর কয়েক আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন সফরের কিন্তু তাতেও উপস্থিত হয় বেশ কিছু বাধা। কেবল প্রাকৃতিক এবং শারীরিক বাধাই নয়, এভারেস্টের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বেশ কিছু আইনি জটিলতাও। অন্ধ কিংবা দু'টিই কৃত্রিম পায়ের পর্বতারোহী এবং একক পর্বতারোহীদের ক্ষেত্রে এভারেস্ট অভিযানের উপর ২০১৭ সালে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নেপাল সরকার। ফলে ২০১৮ সালে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা করেও পিছিয়ে আসতে হয় প্রাক্তন গোর্খা জওয়ানকে। কিন্তু সে বারও হাল ছাড়েনি তিনি। নেপাল সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন হরি। তাঁর পক্ষেই রায় দেয় নেপালের শীর্ষ আদালত।

hari budha magar reaches summit of mount everest

এরপর শুরু হয় আসল সফর। অবশেষে চলতি বছরের ৬ মে এভারেস্টের বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করেন হরি মাগার এবং তাঁর সঙ্গীরা। তারপর দীর্ঘপথ অতিক্রম করে গত ১৮ মে দুপুর ৩টে নাগাদ পৌঁছন এভারেস্টের ৮ হাজার ৮৪৮ মিটারের শৃঙ্গের মাথায়। ঘড়িতে তখন বিকেল তিনটে। এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করলেন হরি মাগার। দীর্ঘদিন ধরে জমানো স্বপ্নের উদযাপন করলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে প্রথম এই শৃঙ্গ হয় করে পর্বতারোহীদের মনে স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন তেনজিং নোরগে ও এডমুন্ড হিলারি। সেই স্বপ্নই বাস্তব করে দেখালেন ৪৩ বছর বয়সি হরি। এক্ষেত্রে অবশ্য হরি মাগারের কৃতিত্ব আরও অনেকখানি বেশি। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার যে জেদ তিনি আজ সারা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরলেন, তা আগামীতে আরও অনেককে জীবনের পথে সাহস জোগাতে সাহায্য করবে, তা বলাই বাহুল্য।

More Articles