জিও টিভিতে বিশ্বকাপের দফারফা! মোদির ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন কি তবে অধরাই?
FIFA World Cup 2022: গতকাল গুজরাত নির্বাচনে প্রচার চলাকালীন নরেন্দ্র মোদি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, কংগ্রেসের আমলে এই ডেটার খরচ অনেক বেশি ছিল
সালটা ১৯৮২। তখন ইডেন গার্ডেনে নেহেরু গোল্ড কাপ খেলা হতো। বাবা প্রথম সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন মাঠে। সেই প্রথম সামনাসামনি খেলা দেখা, তখন সবে ক্লাস থ্রি! উরুগুয়ে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার খেলা। মাঠে গিয়ে দেখি, প্রচুর মানুষ এসেছেন খেলা দেখতে। আমি তো এমন মাঠে এই প্রথম, তাই স্বাভাবিকই এত মানুষ দেখে অবাক। ভারত খেলছে না, তাও এত ভিড়? সেবার নেহেরু গোল্ড কাপে খেলতে এসেছিল, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি সহ আরও অনেক দল। আয়োজক দেশ হিসেবে ভারতও খেলেছিল। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে লাল রঙের জার্সি পরে মাঠে নামল দক্ষিণ কোরিয়া দল, আজ সেই দলের অনেকেরই নাম মনে নেই, কিন্তু প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে দলের অনেকের নাম এখনও স্মরণে আছে। র্যামোস, ফ্রান্সিসকোলি, রডরিগেসের খেলা আজও মনে আছে। সাইডলাইন দিয়ে র্যামোসের সেই দৌড় আজও চোখে ভাসে।
তারপরের ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ যখন দূরদর্শনে দেখছি, যখন চোখের সামনে র্যামোস, ফ্রান্সিসকোলিদের দেখছি, যখন সেই বছর ফাইনালে আর্জেন্টিনার বুরুচাগাকে দেখছি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার পাশে খেলতে, তখন চোখের সামনে ভাসছে সেই নেহেরু গোল্ড কাপের দৃশ্যরা। তখন দূরদর্শন ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনও বিকল্পই ছিল না, স্মার্ট ফোনও ছিল না, স্মার্ট টিভিও না। সাধারণ সাদা কালো বা কেউ কেউ রঙিন টিভিতে সেই খেলা দেখতেন চুটিয়ে। উপভোগ করতেন বিশ্বমানের বিশ্বকাপ ফুটবল। তখন খেলার পত্রিকা আসত বাড়িতে, খবরের কাগজে খেলোয়াড়দের ছবি থাকত। সেই ছবিগুলো কেটে কেটে নিজেদের খাতায় সেঁটে স্কুলের বন্ধুদের দেখানোর মধ্যে সেই যে উত্তেজনা, ভাষায় প্রকাশ করতে বেগ পেতে হয়। বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময়ে মনে মনে মারাদোনা হওয়ার চেষ্টা করেছি। স্বপ্নের মধ্যে দশ নম্বর জার্সি পরা মারাদোনা হতে চেয়েছি। ১৯৮৬ সালের পরে ১৯৯০ সালে মারাদোনার কান্না দেখেছি, কখন যেন একাত্ম হয়ে গেছি ফুটবলের রাজপুত্রের সঙ্গে।
আরও পড়ুন- সম্প্রচারে তুমুল বেনিয়ম! ফুটবল বিশ্বকাপের শুরুতেই কেন আশাহত ভারতীয় দর্শকরা
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, প্রতি চারবছর অন্তর বিশ্বকাপ সংগঠিত হয়। আজও অনেকে দূরদর্শনেই খেলা দেখি। তখন এত চ্যানেল ছিল না আর এখন? হাজারটা চ্যানেল! এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে একটা ছোট্ট দেশ কাতার। ইতিমধ্যেই খেলা শুরু হয়ে গেছে, আগামী ১ মাস ধরে আমাদের চোখ থাকবে টিভির পর্দায়। কিন্তু চোখ থাকলেই কি দেখতে পাওয়া যাবে, মেসি, নেইমার, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, এমবাপেঁ সহ অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলারদের খেলা, এই প্রশ্ন উঠেই গেছে। অন্তত প্রথমদিনের সম্প্রসারণ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। এবারের বিশ্বকাপ সম্প্রসারণের সমস্ত অধিকার পেয়েছে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আম্বানি সংস্থা। তাঁদের জিও টিভি এবং স্পোর্টস ১৮ চ্যানেলে এই খেলা দেখা যাওয়ার কথা। গতকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক এবং টুইটারে মানুষজন খেলা দেখতে না পেয়ে যেভাবে নিজেদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন, তা দেখে মনে হচ্ছে না, আমরা নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের ‘ডিজিটাল’ ভারতে আছি। প্রত্যেকেই একই অভিযোগ করেছেন, এই এত টাকা দিয়ে প্রতিমাসে জিও সংযোগ নেওয়ার ফল যদি হয় খেলা দেখতে বসে প্রযুক্তিগত অসুবিধায় বিঘ্ন ঘটা, তাহলে এই স্মার্ট ফোন বা স্মার্ট টিভির কীসের প্রয়োজন?
গতকাল গুজরাত নির্বাচনে প্রচার চলাকালীন নরেন্দ্র মোদি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, কংগ্রেসের আমলে এই ডেটার খরচ অনেক বেশি ছিল, এখন মানুষজন মাসে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ করে অফুরন্ত ডেটা ব্যবহার করতে পারেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে এইটুকুর জন্যেই ৫০০০ টাকা দিতে হতো। সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ডেটার কথা না বলে আটার কথা বলা উচিত ছিল না কি? আটা কি এখন বেশি দামি না কি তখন বেশি দামি ছিল? কিন্তু বিশ্বকাপের প্ররিপ্রেক্ষিতে আটা নিয়ে নয়, ডেটা নিয়েই কথা বলা জরুরি। যে জিও এখন সারা ভারতবর্ষে মোবাইল সাম্রাজ্য গড়েছে, যেভাবে সরকারি বিএসএনএলের পরিকাঠামো ব্যবহার করে, নরেন্দ্র মোদি তাঁর স্নেহধন্য আম্বানিকে এই সাম্রাজ্য গড়তে সহায়তা করেছেন, তাঁকে কি এই প্রশ্ন করাটা অনুচিত হবে, যে কীসের এত ‘ডিজিটাল’ ভারতবর্ষের বড়াই তিনি করেন?
আরও পড়ুন- নিরামিষ বিশ্বকাপ! বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কী কী চরম নিষিদ্ধ কাতারে?
বিষয়টা শুধুমাত্র বিশ্বকাপের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত এমনটা নয়। রেশন তোলেন যে ভারতবর্ষের মানুষ, তাঁরাও কিন্তু প্রায়শই একই অভিযোগ করে থাকেন, সংযোগ না থাকার ফলে তাঁরা রেশন পাচ্ছেন না। যদিও আরামকেদারায় বসে স্মার্টটিভিতে ওয়েবসিরিজ দেখতে দেখতে একশ্রেণির কানে সেই আওয়াজ পৌঁছয়নি, আজ যদি অন্তত শুনতে পাই, সেটুকুই লাভ। তাও গতকাল দেখা গেল, কোনও কোনও ব্যক্তি এই প্রযুক্তিগত অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, অথচ সেই অমোঘ প্রশ্নটা করছেন না। এই ‘ডিজিটাল’ ভারতবর্ষই কি আমরা চেয়েছি, যে ভারতে একদিকে রেশন দোকানের উপভোক্তাদের ভোগান্তি হতেই থাকবে আর অন্যদিকে স্মার্ট টিভিতে ওয়েবসিরিজ দেখাই চলতে থাকবে? আজকে দাঁড়িয়ে কি মনে হয় না, যে দূরদর্শনের আমলে আমরা ঘরে বসে খেলা দেখেছি, সেই দিনটাই ভালো ছিল? মারাদোনার হাসিকান্নার সঙ্গে আমাদের একাত্মতা কি আজকের ‘ডিজিটাল’ যুগে আদৌ সম্ভব হতো? অবশ্যই প্রযুক্তিকে আপন করতে হবে, কিন্তু কীসের বিনিময়ে? সেই প্রশ্নটা করার কি সময় আসেনি? বেসরকারি সংস্থাকে সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহার করতে দিয়ে কি দেশের বিকাশ সম্ভব?