রাষ্ট্র ভুলে যায়, ক্ষমতার গদি উল্টে দিতে জানে উচ্ছেদ হওয়া হকাররা
Indian Railway Hawker Eviction : হাওড়া স্টেশন এবং পশ্চিমবংলা জুড়ে হকার উচ্ছেদও কি রাজনীতির পাশা পাল্টাতে অনুঘটকের ভূমিকা নেবে?
২০২৩-এর ১৬ সেপ্টেম্বর হাওড়া স্টেশন সহ বাংলার ৪০-এর কাছাকাছি স্টেশনকে শপিং মলে পরিণত করার প্রতিবাদে, রেল কাঠামোয় হকারি-দোকানদারি বন্ধ করার প্রতিবাদে এবং রেল রাস্তার পাশের ঝুপড়ি উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানালে হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে রেল পুলিশ হিংস্র হয়ে প্রতিবাদী হকার আর অপেক্ষমান যাত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দমনপীড়ন চালায়। বহু হকার আহত হন, গ্রেফতার হন, যাত্রীরাও ছাড় পাননি। সংবাদমাধ্যম এই খবর বড়ভাবে দেখায়ইনি। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকেই আসলে প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে কর্পোরেট সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া রেলের দেওয়া বিজ্ঞাপনও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলেই মনে হয়। তবে, এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার! হকারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল বাজার দখল করতে ভারতের কর্পোরেটরা মরিয়া। এই কাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা কর্পোরেটদের যথাযোগ্য সঙ্গত করছে – বলপ্রয়োগ করতেও তারা পিছপা নয়। পশ্চিমবঙ্গের স্টেশনগুলো কর্পোরেট-যোগ্য করে গড়ে তুলতে জনগণের বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তার ফল শুধু হাওড়া নয় নিয়মিত জেলাগুলো থেকে হকার আর স্টেশন সংলগ্ন ঝুপড়ি উচ্ছেদ।
তবে শহর স্টেশনের সৌন্দর্যায়নের নামে হকারদের উপর হিংসা চালিয়ে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা হকার সমাজের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা নয়। ১৯৮০-র দশকে এই ঘটনা শিয়ালদায় ঘটেছে, ১৯৯৬-তে কলকাতাজুড়ে হয়েছে, তারপরে বাংলার অন্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে হয়েছে। আজও পশ্চিমবঙ্গের নানান শহুরে অঞ্চল সাজানোর বাহানায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের বাহানায় রাষ্ট্র-কর্পোরেটের ফুটপাথ বা রেল জমির দখলদারি বন্ধ নেই।
হকাররা যে রাজনৈতিকভাবে অসহায় এমন কিন্তু নয়। আজ থেকে দু'দশক আগে হকাররা কলকাতার রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাবের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। ২০০০ এবং ঠিক তার পরের কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে, বৃহত্তর কলকাতার হকাররা কলকাতা পরিচালনায় স্থানীয় সরকার বদলে দেন। দু'টি নির্বাচনেই হকার বিরোধী নীতি নেওয়ার প্রভাব একবার বামফ্রন্ট, পরেরবার তৃণমূল কংগ্রেসকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা।
হকার বাজার দখল করতে কর্পোরেট কত মরিয়া তার এক ছোট্ট অভিজ্ঞতা বলি। কর্পোরেটরা শুধু রাষ্ট্রকে দিয়েই ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ করিয়ে ক্ষান্ত দেয় না, সরাসরি হকার ইউনিয়নকেও তাদের পণ্য বাজারজাত করার প্রস্তাব দিতে বাধে না।
সময়টা ২০০০-এর আশেপাশের। কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে হকার উচ্ছেদ প্রকল্প 'অপারেশন সানশাইন' পেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েক বছর। ১৯৯৬-এর বিপুল উচ্ছেদ, পুলিশ-কর্পোরেশনের জুলুম, ১০০-র কাছাকাছি হকারের আত্মহত্যার মিছিল সত্ত্বেও দীর্ঘ লড়াই, নানান সংগঠনের গণআন্দোলনের প্রভাবে ফুটপাথে টিকিয়ে রাখা গিয়েছিল হকার কাঠামো। তখনও মাঝেমধ্যে কলকাতা কর্পোরেশনের হল্লাগাড়ি আসে, প্রচুর সম্পত্তির ক্ষয় হয় হকারদের। কেস, জরিমানা দু’ চারদিন ব্যবসা বন্ধের বাস্তবতা সহ্য করেই ক্রমশ আন্দোলনে সাফল্য আসছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন পুলিশমন্ত্রী। শ্যামল চক্রবর্তীসহ প্রতি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমর্থনে সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ তৈরি করা গিয়েছিল। ১৯৯৮-৯৯ থেকেই তৈরি হয়েছে পুজো ছাড়। এই নীতিতে পুলিশমন্ত্রী, পরে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছিল নীরব সমর্থন। পুজোর আগের মাস দুয়েক তাঁর দপ্তর চোখ বন্ধ করে থাকায় কলকাতার ফুটপাথে পুলিশি-কর্পোরেশনের জুলুম থেকে নিষ্কৃতি পেতেন হকাররা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা শ্যামবাজার-হাতিবাগান, গড়িয়াহাট এবং আরও অন্য অঞ্চলের হকারদের জীবনে এই ছাড় ছিল অমূল্য।
পুজো ছাড়ের ইতিহাস তৈরি করেছিলেন শ্যামবাজারের সাধারণ মানুষ। ১৯৯৭-এর পুজোর মাস কয়েক আগে হকার-পুলিশ খেলার মাঝে ভর বিকেলে কেনাবেচার মধ্যেই পুলিশ এলাকা কর্ডন করে বেশ কয়েকজন হকারের মালপত্র বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। প্রতিরোধ এল সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে। পুলিশকে তারা ঘিরে ধরে। তাদের বক্তব্য, তাঁদের মতো নিম্নবিত্তের পরিবারগুলিকে প্রশাসন বড় দোকানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেদিন জনপ্রতিরোধে পুলিশকে পিছু হঠতে হয়। সেই থেকে শুরু হলো পুজো ছাড়ের ধারণা। ইউনিয়ন সরকারের সঙ্গে কথা বলল। বামফ্রন্ট সরকারের ছোট শরিকরা বিশেষ করে ক্ষিতি গোস্বামী, আরএসপির শ্রমিক নেতা অশোক ঘোষ বা সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সাহায্যের কথা ভোলা যাবে না, শ্যামলবাবুর নাম আগেই নিয়েছি।
উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় হকার সংগঠনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বাংলাজোড়া উচ্ছেদ বিরোধী যুক্তমঞ্চ। উত্তরের চা বাগান থেকে কলকাতার খালপাড়, খাটাল থেকে নিউটাউন-রাজারহাটে কৃষক উচ্ছেদ- প্রায় প্রত্যেক উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরির সূতিকাগৃহ করে নিয়েছেন বউবাজারের হকার সংগ্রাম কমিটির দপ্তরকে। আমরা যারা সর্বক্ষণের কর্মী, তাঁদের কাজের অন্ত নেই। তারপরে সর্বভারতীয়স্তরে হকার সংগঠনের তোড়জোড়। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত কর্মব্যস্ত রাজনৈতিক দিন। তার মধ্যেই সমীক্ষা ইত্যাদির কাজ চলছে – বৃহত্তর কলকাতায় হকারদের সংখ্যা, হকারদের বাজার, তাদের সামাজিক অবদান ইত্যাদি বুঝতে চাইছি।
এরকম এক তুমুল আন্দোলনের সময় বউবাজারে হকার দপ্তরে এসে হাজির হলেন আন্দোলন কাঠামোয় বেমানান চেহার এক ব্যক্তি। বাংলাভিত্তিক বিশাল ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস কোম্পানির সেলস প্রধান। প্রস্তাব, তাঁর সংস্থা কলকাতার প্রত্যেক অঞ্চলে– বিশেষ করে আপিস পাড়ার প্রত্যেকটি ফুটপাথে একটা করে সুন্দর দোকান তৈরি করে দেবে, হকাররা সেই দোকান থেকে তাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করুন, তাঁরা হকারদের পর্যাপ্ত ছাড় দিতেও রাজি আছেন। স্পষ্ট জানালেন, দাম-দস্তুর সমস্যা হবে না। সংগঠনের সাথীদের নিয়ে বৈঠক ডাকা হলো।
আন্দোলনের সাথী, মিছিলে হাঁটা শুভেন্দু-কেয়া দাশগুপ্তের সহযোগিতায় কলকাতা জুড়ে হকার এবং হকারদের গ্রাহকদের ব্যাপক সমীক্ষা করে আমরা ততদিনে জেনে গিয়েছি হকারদের সামাজিক গুরুত্বের কাঠামোটা এবং হকাররা কী বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। কলকাতার ফুটপাথের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। দেশের ৮০ শতাংশ কৃষিপণ্য হকার বাজারে বিক্রি হয়। আরও পরে, কারিগর সংগঠনের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করার সময়ে দেখছি, বাংলার ৫০ লক্ষ পরম্পরার কারিগরের পণ্য বিক্রি হয় গ্রামের হাট, গঞ্জ এবং ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা রেল, রেল স্টেশন, বাস, বাস স্টেশনের হকার আর ছোট বিক্রেতা মারফৎ। স্বাভাবিকভাবেই মনোমোহনী অর্থনীতিতে কর্পোরেটের বিরুদ্ধে লড়াই করা হকার ইউনিয়নের পক্ষে কর্পোরেটজাত পণ্য বিক্রি করার প্রস্তাব খারিজ করতে দু’ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। এটা যে ব্যতিক্রমী প্রস্তাব ছিল না, সেটা আমরা বুঝলাম এরপরে আরও কয়েকটি এই ধরনের কর্পোরেট প্রস্তাব আসতে থাকায়। এই সময় আমাদের কাছে খবর এল, কলকাতার বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করা কর্পোরেটরাও ফুটপাথে আসতে প্রবল ইচ্ছুক। কেন তারা পারেনি আমরা জানি না।
বড় কর্পোরেট হাউজের হকার বাজার ধরতে আসা থেকে বুঝলাম কেন বামপন্থী জোটকে কলকাতার রাস্তায় বলপ্রয়োগ করে হকার উচ্ছেদ করতে হয়। ২০০০-এর আশেপাশের সময়ে বৃহত্তর কলকাতার ২ লক্ষ ৭৫ হাজার হকার বিপুল ভদ্রবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, যে বাজারে কর্পোরেটদের উপস্থিত প্রায় শূন্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। মনোমহনী অর্থনীতিতে সক্রিয় আগ্রাসী কর্পোরেট এই বাজার ছাড়তে রাজি নয়।
আমি শুধু পাঠকদের কয়েকটা তথ্য মাথায় রাখতে অনুরোধ করছি। কলকাতায় রোজ অন্তত ৩৫ লক্ষ মানুষ আসেন নানান কাজে। তারা আবার দিনের শেষে ফিরে যান জেলায়। কর্পোরেট জানে, শত চেষ্টাতেও এই বিপুল মানুষের তিল পরিমাণ ভগ্নাংশকেও মাত্র একটিবার বসিয়ে খাওয়াবার পরিকাঠামো নেই ছোট বড় মাঝারি সংগঠিত হোটেল রেস্তোরাঁগুলোর। ফলে কলকাতায় আসা অধিকাংশ মানুষের সম্বল ২০ টাকার পেট ভরা পথের খাবার। তাছাড়া আপিস পাড়ার কর্চারীদের অধিকাংশ নির্ভর করেন ফুটপাথের হকার কাঠামোর উপর– সেটা হকার ইউনিয়নের গ্রাহক সমীক্ষাতেই প্রমাণিত। অল ইন্ডিয়া হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের ১৯৯৩-এর সমীক্ষা বলল, শুধু জল ছাড়া (কারণ তখনও হকারি বেআইনি ছিল, তাই কলকাতা কর্পোরেশন হকারদের জলের কল ব্যবহার করতে দিত না) কলকাতার ফুটপাথের খাবার যেমন পুষ্টিকর তেমনই তাজা।
ফুটপাথে যে পণ্য দ্রব্য বিক্রি হয়, সেটা যে কোনও প্রতিষ্ঠিত দোকানের থেকে অন্তত ৫০% সস্তা। কলকাতার বিপুল নিম্নবিত্ত মানুষের ভরসা কলকাতার ফুটপাথ। তাই যে কোনও পরবে কলকাতার মানুষ ফুটপাথে নেমে আসেন অবলীলায়। মাথায় রাখতে হবে, দেশভাগে উদ্বাস্তু বিপুল মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ করে দিয়েছিল শুধু কলকাতা নয় পশ্চিমবঙ্গজোড়া ফুটপাথ অর্থনীতি। আজও কলকাতায় বেশ কয়েকটা হকার বাজার টিকে আছে যেগুলি মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের আমলে তৈরি।
কর্পোরেটেরা এই তথ্য খুব ভাল জানে বলেই তারা গোটা হকার বাজারে দখল করতে মরিয়া। ইউপিএ আমলের শেষের দিকে হকার বিল সংসদে গৃহীত হওয়ায় এবং বহু শহরে হকার ব্যবস্থাপনায় আইন অনুযায়ী টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি হওয়ায় ফুটপাথ থেকে সরাসরি হকার উচ্ছেদ সমস্যার হয়ে গিয়েছে। তাই নরেন্দ্র মোদির বিবেক, থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেক দেবরায়, সঞ্জীব সান্যালেরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকা কেড়ে কর্পোরেটদের পকেট ভরতে মরিয়া।
আগেই বলেছি অতীতে হকারেরা স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই ১৯৯৬-এর অপারেশন সানশাইন ঘটনার পরে ২০০০ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্ট কলকাতা পুরসভার নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। হকার ইউনিয়ন করা মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় হকার বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় পরের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কলকাতা পুরসভার নিয়ন্ত্রণ হারায়। মাথায় রাখতে হবে, হকারদের অধিকাংশ তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হকার বিরোধী হুঙ্কারের মাসুল দিতে হয় দলকে।
কেন্দ্রে মোদি সরকার সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা কেড়ে নিয়ে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত। কলকাতা অতীতে রাজনৈতিকভাবে পথ দেখিয়েছে। আগামী দিনে হাওড়া স্টেশন এবং পশ্চিমবংলা জুড়ে হকার উচ্ছেদও কি রাজনীতির পাশা পাল্টাতে অনুঘটকের ভূমিকা নেবে?