এই বিশেষ পদ্ধতিতে বাগান করলে পাওয়া যাবে মানসিক শান্তি, বাড়বে স্মৃতিশক্তি

ভারতে হিলিং গার্ডেন সম্পর্কে মানুষের বিশেষ ধারণা না থাকলেও, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশগুলিতে কিন্তু অনেক বছর ধরেই এই বাগানের বেশ প্রচলন রয়েছে।

সম্প্রতি কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কারিয়াভাট্টম’ ক্যাম্পাসের দু’তলায় মাত্র ৫০ বর্গফুট জায়গায় একটি সুন্দর বাগান তৈরির কথা সামনে এসেছে। লাইব্রেরির পাশে এই ছোট্ট বাগানটি বানিয়েছেন রেশমা পিয়ার। তিনি বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে বাড়ির অভ্যন্তরীণ বায়ু পরিশোধনের ওপর গবেষণা করছেন এবং সেই সূত্রেই ক্যাম্পাসের স্বল্প পরিসরে তৈরি করেছেন এই সবুজ ক্ষেত্রটি। এই ধরনের বাগানকে বলা হয়ে থাকে ‘হিলিং গার্ডেন’।

রেশমা জানান, তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন, এমন বহু ইনডোর প্ল্যান্ট রয়েছে, যা এয়ার ফিল্টারের মতো কাজ করে বাড়ির ভেতর জমে থাকা দূষিত গ্যাস এবং ফর্মালডিহাইড দূর করতে সক্ষম। এর ফলে একদিকে যেমন অন্দরের দূষণ কমে, তেমনই আবার অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। রেশমা আরও বলেন, আমাদের দেহের ২০ শতাংশ অক্সিজেন মস্তিষ্কের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে‌। তাই ঘরের চারদিকের বায়ু যদি দূষণমুক্ত থাকে, তবে তা সামগ্রিকভাবে শরীর এবং মস্তিস্ক, উভয়ের জন্যই উপকারী।

ভারতে হিলিং গার্ডেন সম্পর্কে মানুষের বিশেষ ধারণা না থাকলেও, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশগুলিতে কিন্তু অনেক বছর ধরেই এই বাগানের বেশ প্রচলন রয়েছে। এই হিলিং গার্ডেন যে শুধুমাত্র অন্দরের বায়ু পরিশোধনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তা একেবারেই নয়। বায়ু শোধনের পাশাপাশি এই বাগানের বিশাল এক থেরাপেটিক গুরুত্ব রয়েছে। এই বাগান শারীরিক নিরাময়ের সঙ্গে সঙ্গেই মানসিক নিরাময়েও সমানভাবে কাজ করে। চাপ কিংবা উদ্বেগ কমানোর পাশাপাশি ‘হিলিং গার্ডেন’ মানুষকে মুক্তচিন্তার অবকাশ দেয়, এছাড়াও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা নেয় এবং নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর উন্নত করে, যা নিউরোট্রান্সমিশনকে তরান্বিত করতে সাহায্য করে আর সেই কারণেই বিদেশের হাসপাতাল, নার্সিং হোম, মনোবিদ অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে প্রায়শই এই ধরনের একটি বাগানের দেখা মেলে।

আরও পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসৈকতে বসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করতে পারেন আপনিও!

বর্তমান সময়ে শহরমুখী মানুষেরা অভাব এবং স্বভাব – দুই কারণে বাসস্থান বলতে ফ্ল্যাটকেই বেছে নেওয়া হয়। বাগান করার জন্য তাদের কাছে উপায় বলতে রয়েছে একচিলতে ব্যালকনি। চাইলেই কিন্তু নিজের ফ্ল্যাট বাড়িতে এরকম একটি ‘হিলিং গার্ডেন’ প্রস্তুত করা যেতে পারে। তবে একটি আদর্শ ‘হিলিং গার্ডেন’-এ গাছপালার পাশাপাশি আরও কিছু উপকরণের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

‘ব্লু মাইন্ড’ থিওরি অনুসারে, জলের শব্দ মানসিক চাপ কমাতে সক্ষম, তাই আপনি যদি এইরকম একটি বাগান নির্মাণে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তবে, ছোট্ট একটা ঝরনার ব্যবস্থাও কিন্তু করতেই হবে। বাগানের কোনও এক স্থানে একটি ‘উইন্ডচ্যাম’ ঝোলাতে পারেন, কারণ এই ধরনের মৃদু শব্দ মনকে শান্ত করতে সহায়ক।

বাগানের কিছুটা অংশে অথবা জায়গা কম থাকলে গোটা বাগানজুড়েই নুড়ি পাথর বিছিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে যখন কোনও মানুষ হেঁটে বাগানে প্রবেশ করবেন অথবা পাথরে পা রেখে বাগানে বসবেন, তখন তিনি একটি আকুপাংচার পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হবেন, যা তার নিউরো-সিস্টেমকে উন্নত করবে। এই পদ্ধতিকে আবার আর্থিং বা গ্রাউন্ডিং বলা হয়। এর ফলে মানুষের শরীর এবং পৃথিবীর মধ্যে এক সংযোগের সৃষ্টি হয় যা ঘুমের উন্নতি ঘটায়, নানা অঙ্গের ব্যথা কমায়, রক্তের সান্দ্রতা হ্রাস করে এবং কার্টিসল ছন্দকে বজায় রাখে।

যে গাছ ছাড়া এই বাগান একেবারেই অপূর্ণ, এবার জেনে নেওয়া যাক সেই গাছের কথাই।

বাঁশ গাছ
ঘর সাজানোর জন্য এই বাঁশ গাছ এখন কম-বেশি সব মানুষের ঘরেই দেখা যায়। বিজ্ঞান বলছে, এই বাঁশ গাছ বাতাসের দূষিত কণা টোলুইন, টক্সিন বেঞ্জিন এবং ফর্মালডিহাইডকে শোষণ করে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা প্রচুর গুণ বৃদ্ধি করে।

স্পাইডার প্ল্যান্ট
এই গাছটি খুব কম আলোতেই সালোকসংশ্লেষ করতে পারে, তাই যে কোনও পরিস্থিতিতেই অক্সিজেন সরবরাহ অব্যহত থাকে। এছাড়াও, বাতাস থেকে স্টাইরিন কিংবা গ্যাসোলিনের মতো টক্সিন শুষে নিতেও সক্ষম এই স্পাইডার প্ল্যান্ট।

স্নেক প্ল্যান্ট
নাসা দ্বারা স্বীকৃত এই গাছ দিনের বেলা তো বটেই, রাত্রিবেলাতেও অক্সিজেন ছড়াতে সক্ষম হয়। স্নেক প্ল্যান্ট যেমন ঘরে জায়গাও কম নেয় তেমনই আবার এর পরিচর্যাও তেমন করতে হয় না বললেই চলে। শোওয়ার ঘরে রাখার জন্য এই গাছ একেবারে আদর্শ। অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়াও বাতাস থেকে ট্রাইক্লোরোথাইলিন ও ফর্মালডিহাইড শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।

অ্যালোভেরা
বাংলার ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা গাছের অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা অন্যান্য সকল ইনডোর প্ল্যান্টের থেকে বহুমাত্রায় বেশি। ঘরের ভেতরের কার্বন-মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং ফর্মালডিহাইডের মতো টক্সিন শোষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ঘৃতকুমারী, এমনকী, একসঙ্গে ন'টি বায়ু শোধনকারী যন্ত্রের ন্যায় কাজ করতেও সক্ষম এই গাছ।

মানি প্ল্যান্ট
প্রায় সকলের ঘরেই কম-বেশি এই গাছটির দেখা মেলে। ফেনশুই মতে মানি প্ল্যান্ট নাকি ঘরে থাকা শুভ। এছাড়াও, এই ছোট্ট লতানো গাছটি কিন্তু ঘরের কোণে থেকেও দারুণ এয়ার-ক্লিনারের কাজ করে। বাড়িতে দূষিত গ্যাস, বেঞ্জিন, ফর্মালডিহাইড এবং ইথালিনের মতো গ্যাসগুলিকে শোষণে সাহায্য করে থাকে।

আরেকা পাম গাছ
এই গাছটিও ঘরের দূষিত বায়ু পরিশোধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে আপনার যদি বাড়িতে বড় বাগান করার মতো জায়গা থাকে, তাহালে শুধু ইনডোর প্ল্যান্টেই আটকে না থেকে, আকারে বড় বেশ কিছু গাছ দিয়েও নিজের মতো করে নিরাময় বাগানটি নির্মাণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে যে গাছগুলি আপনার বাড়ির চারপাশের বায়ু পরিশোধনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকবে তার কথাও বলা রইল‌।

অশোক গাছ
যাদের বাড়িতে বড় বাগান করার মতো যথেষ্ট জায়গা রয়েছে, তাঁরা কিন্তু পাঁচিলের এককোণে অথবা বাগানের ঠিক মাঝে অশোক গাছ লাগিয়ে ফেলতে পারে। আকারে খানিকটা বড় হলেও, বসন্তকালে গাছ যখন ভরে থাকবে লাল অশোক ফুলে, তখন আপনার বাগানের শোভা কিন্তু বাড়বে বই কমবে না।

পিপল গাছ
পিপল গাছ সকালবেলা অক্সিজেন ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে আবার রাত্রিবেলাও খানিক পরিমাণে অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষম। প্রাচীনকাল থেকেই হাঁপানি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়বেটিস অথবা রক্তের বিভিন্ন সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভের জন্য মানুষ পিপল গাছের ব্যবহার করে আসছে। আবার পিপল পাতায় রয়েছে ভিটামিন-কে। এই গাছের পাতা দিয়ে সযবৎ বানিয়ে খালি পেটে পান করলে তা শরীর ঠান্ডা করে। বাতাসে চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হওয়ার কারণে শুধু নিজের বাগানেই নয়, আপনার আশপাশের বিভিন্ন স্থানে এই পিপল গাছ রোপণ করলে তা সার্বিকভাবে পরিবেশের উন্নতি ঘটাবে।

নিম গাছ
বনফুলের গল্প যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের আর নতুন করে নিমগাছের গুণাগুণ বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এই গাছের পাতার আকার অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ার কারণে অক্সিজেন ত্যাগে এই গাছ অধিক পরিমাণে সক্ষম। এই গাছ আবার গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই বাড়ির চারপাশে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পেতে বাগানে একটা নিমগাছ লাগাতে ভুলবেন না যেন। এই তালিকায় আরও রয়েছে বট, অশ্বত্থ, জামুন, অর্জুন কি‌ংবা বেলের মতো গাছগুলি। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগ গাছই বাড়ির বাগানে লাগানো সম্ভবপর নয়। তবে সুযোগ পেলে এই গাছগুলি আপনার আশপাশের কোনও বড় ফাঁকা জায়গায় লাগিয়ে দিতে পারেন।

শেষে বলার, নিজের সাধমতো বাগান তৈরি করলেই শুধু হবে না, সাধ্যমতো তার পরিচর্যাও করতে হবে।

More Articles