চরকে দিয়ে গোপন তথ্য হাসিল ইজরায়েলের? যেভাবে খুন হলেন হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহ

Hezbollah Chief Hassan Nasrallah Killed: তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হিজবুল্লাহকে নেতৃত্ব দেওয়া নাসরাল্লাহ খুন হলেন ২৭ সেপ্টেম্বর, বেইরুটে ইজরায়েলি বিমান হামলায়।

১৯৯২ সালে ৩২ বছর বয়সে হাসান নাসরাল্লাহ যখন হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি-জেনারেল হন, দলের নেতা এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস আল-মুসাভির হত্যার পর প্রথম যে কাজগুলি নাসরাল্লাহ করেন, তার মধ্যে একটি ছিল উত্তর ইজরায়েলে রকেট হামলার নির্দেশ। তুর্কিতে ইজরায়েলি দূতাবাসে এক গাড়ি বোমা হামলায় একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার হত্যা, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইজরায়েলি দূতাবাসে বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে ২৯ জনের প্রাণ যায়।

প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-কে উৎখাত করতে ১৯৮২ সালে ইজরায়েল লেবানন আক্রমণ করেছিল ঠিকই কিন্তু এই যুদ্ধের ফলেই হিজবুল্লাহর উত্থান ঘটে, যা পিএলও-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯২ সালে ইজরায়েল মুসাভিকে হত্যা করে হিজবুল্লাহকে বিপাকে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু মুসাভির উত্তরসূরি নাসরাল্লাহ যে আক্রমণ শানান তাতে এটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় হিজবুল্লাহর ক্ষমতা বিপুল। রকেট হামলা, দূতাবাসে বোমা হামলা তো হিমশৈলের চূড়া ছিল মাত্র। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হিজবুল্লাহকে নেতৃত্ব দেওয়া নাসরাল্লাহ খুন হলেন ২৭ সেপ্টেম্বর, বেইরুটে ইজরায়েলি বিমান হামলায়।

আরও পড়ুন- ফের নতুন করে হামলা বেইরুটে, পেজার বিস্ফোরণে কেন জড়াচ্ছে ইজরায়েলের Unit 8200-র নাম?

হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, শহিদের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে, নাসরাল্লাহর বড় ছেলে মুহাম্মদ হাদি দক্ষিণ লেবাননের একটি পাহাড়ি গ্রাম মলিকের কাছে ইজরায়েলি অতর্কিত হামলায় নিহত হওয়ার পরে এই নাসরাল্লাহই বলেছিলেন, "আমি একজন শহিদের বাবা হতে পেরে গর্বিত"। বেইরুটের এক শ্রমজীবী শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নাসরাল্লাহর। ইরানে বিপ্লবের সময় সমগ্র অঞ্চলে শিয়া রাজনৈতিক ইসলাম এবং মৌলবাদে বিশ্বাসী যুবকরা নতুন করে জেগে ওঠে। নাসরুল্লাহর বয়স তখন ছিল মাত্র ১৯। লেবাননে গৃহযুদ্ধের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি, ১৯৮২ সালে ইজরায়েলের আগ্রাসনও দেখেছিলেন, যাতে প্রান্তিক শিয়া সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমে আমাল পার্টির অংশ ছিলেন নাসরাল্লাহ। আমালের উগ্রপন্থী অংশগুলি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হিজবুল্লাহ গঠন করলে নাসরুল্লাহ তাদের সঙ্গেই যোগ দেন।

হিজবুল্লাহ, রকেট হামলা এবং অতর্কিত হামলার মাধ্যমে দক্ষিণ লেবাননে নিরাপত্তা অঞ্চল গড়ে তোলে। লেবানন আক্রমণ শুরু করার ১৮ বছর পর, ২০০০ সালে ইজরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালে, হিজবুল্লাহর একটি আন্তঃসীমান্ত অভিযানের পর ইজরায়েল আবার স্থল আক্রমণ এবং ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। এক মাস ধরে যুদ্ধ চলে, যাতে হিজবুল্লাহর ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু ইজরায়েল এত কিছুর পরেও হিজবুল্লাহকে হারাতে বা দক্ষিণ লেবানন থেকে আসা রকেট প্রতিহত করতে ব্যর্থই হয়। হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ডাকে ইজরায়েল।

ইজরায়েলের 'বিলুপ্তি' এবং জেরুজালেমের মুক্তি ছিল হিজবুল্লাহর দু'টি প্রধান ঘোষিত উদ্দেশ্য। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলার পর যখন ইজরায়েল প্রতিশোধ নিতে গাজায় যুদ্ধ শুরু করে তখন হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আবারও ইজরায়েলে রকেট ছুঁড়তে শুরু করে। এই মাসের ইজরায়েল হিজবুল্লাহকে নিকেশ করতে প্রথমে পেজার এবং ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপরে হিজবুল্লাহর সিনিয়র কমান্ডারদের নিয়ে ব্যাপক বিমান হামলার শুরু করে। এই হামলাতেই প্রাণ যায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহর। জানা যাচ্ছে, বিমান হামলায় নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, ইরানের একজন চর ইজরায়েলকে নাসরাল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানিয়েছিল। জানিয়েছিল, নাসরুল্লাহ সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সদস্যের সঙ্গে একটি বৈঠকে যোগ দিতে বেইরুটে দক্ষিণ শহরতলিতে হিজবুল্লাহর ভূগর্ভস্থ সদর দফতরে থাকবেন।

কীভাবে ইজরায়েল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে গুপ্তচরদের ব্যবহার করছে? দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইজরায়েল সাম্প্রতিক যে সাফল্যগুলি পেয়েছে তাতে গোয়েন্দাদের বড় ভূমিকা আছে। ইজরায়েল হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব এবং কৌশল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রচুর গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছে। ইউনিট ৮২০০, ইজরায়েলের সিগন্যাল গোয়েন্দা সংস্থা, হিজবুল্লাহর সেলফোন এবং অন্যান্য যোগাযোগের উপর নজরদারি চালাতে অত্যাধুনিক সাইবার টুল তৈরি করেছে। মূল্যবান তথ্য দ্রুত সৈন্য এবং বিমান বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নতুন দল তৈরি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন- মোসাদের দফতরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হিজবুল্লাহের, যে ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব

ইজরায়েল বিস্ফোরক-বোঝাই পেজার এবং ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণের পরে দুই দিনে ৩৭ জন নিহত হন এবং প্রায় ৩,০০০ মানুষ আহত হন। নাসরাল্লাহ তখন ইজরায়েলকে কঠোর প্রতিশোধ এবং ন্যায্য শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করেন। ইজরায়েল সেলফোন নিয়ন্ত্রণ শুরুর পরে হিজবুল্লাহ সদস্যরা পেজার এবং ওয়াকি-টকির মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেছিল। কিন্তু তাতে রক্ষা হয়নি। মোসাদ বুদাপেস্টে একটি শেল কোম্পানি তৈরি করেছে এবং তাইওয়ানের একটি কোম্পানির লাইসেন্সের অধীনে পেজার তৈরি করেছে। পেজারগুলি লেবাননে পৌঁছনোর ইজরায়েলি কর্মীরা সেগুলির ভেতরে বিস্ফোরক স্থাপন করে দিয়েছিল।

ব্যাপকভাবে গোয়েন্দা নিয়োগ করে ইজরায়েল প্রথম সাফল্য পেয়েছিল ২০০৮ সালে। মোসাদ সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা ইমাদ মুগনিয়াহকে হত্যা করার জন্য সিআইএর সঙ্গে কাজ করেছিল। গত ৩০ জুলাই একটি হামলায় দলের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকর নিহত হন। প্রায় তিন সপ্তাহ পর আরেকটি হামলায় হিজবুল্লাহর এলিট রাদওয়ান ফোর্সের প্রধান ইব্রাহিম আকিল এবং অন্যান্য ১৫ জন কমান্ডার নিহত হন। কয়েকদিন পরে, আরেকটি হামলায় ইব্রাহিম মোহাম্মদ কোবেইসি নিহত হন, তিনি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট সহ হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকটি ইউনিটের নেতৃত্ব দিতেন। এর পরের দিনই হিজবুল্লাহর ড্রোন ইউনিটের প্রধান মহম্মদ সরুর একটি হামলায় নিহত হন।

More Articles