এমার্জেন্সির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! আজীবনের জন্য এই অভিনেত্রীর গলার স্বর কেড়ে নিয়েছিলেন ইন্দিরা!
Indira Gandhi and Snehalata Reddy: শোনা যায়, স্নেহলতা প্রতি রাতে চিৎকার করে করে কাঁদতেন এবং বলতেন যে তিনি নির্দোষ।
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন। ভারতবর্ষে সূর্যোদয় হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আকাশ ভরে গিয়েছিল অন্ধকারে। চোখ খুলতেই দেশের মানুষ প্রথমে যা কানে শুনলেন, তা হলো 'এমার্জেন্সি'। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আকাশবাণীতে ঘোষণা করলেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। অন্যান্য সকলের মতোই এই খবর কানে গিয়েছিল ওড়িশার গোপালপুরে ঘুরতে যাওয়া এক ভদ্রলোকেরও। এমার্জেন্সির খবর পেতেই নিজের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে ফেরার হয়ে যান তিনি। স্থানীয় পুলিশ এবং গোয়েন্দারা অনেক চেষ্টা করেও কোনও খোঁজ পেলেন না তাঁর। ভদ্রলোক পালিয়ে গেলেন বরোদায়। সেখানে পৌঁছে তিনি যোগাযোগ করলেন সাংবাদিক কীর্তি ভট, বিক্রম রাও এবং সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী বীরেন জে. শাহের (পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল) সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তারা একটি পরিকল্পনা করলেন। অহিংস নয়, সহিংস প্রতিবাদ। তবে কোনও প্রাণহানি যেন না হয়, সেই দিকেও খেয়াল রেখেছিলেন তারা। কয়েকদিন পর সারা দেশের সব সংবাদপত্রের শিরোনামে চলে এল বরোদা ডায়নামাইট বিস্ফোরণের খবর। একইসঙ্গে শিরোনামে চলে এলেন এই ব্যক্তিটি, অর্থাৎ জর্জ ফার্নান্ডেজ। সেই সময় সমাজবাদী নেতা হিসেবে জর্জের জনপ্রিয়তা থাকলেও, বরোদা ডায়নামাইট বিস্ফোরণের পর সারা দেশের মানুষের কাছে হিরো হয়ে ওঠেন তিনি।
ঠিক একইভাবে জর্জ হিরো হয়ে যান এক কন্নড় অভিনেত্রীর চোখেও। এর আগে সমাজবাদী মনোভাবাপন্ন তো তিনি ছিলেনই, জর্জের এই ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে পথে নেমে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরোধিতা করা শুরু করেন তিনি। হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না যে এর মাশুল তাঁকে দিতে হবে নিজের প্রাণ দিয়ে। কথা হচ্ছে ৭০-এর দশকের জনপ্রিয় কন্নড় অভিনেত্রী স্নেহলতা রেড্ডিকে নিয়ে। সেই সময় কন্নড় সিনেমা এবং থিয়েটার জগতের অন্যতম তারকা ছিলেন স্নেহলতা। সিনেমার থেকেও থিয়েটারে বেশি উৎসাহী ছিলেন স্নেহলতা। দর্শক তাঁকে মনে রাখেন ‘সংস্কার’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার-সহ একাধিক পুরস্কার জিতেছিলেন। এই সিনেমাটির নির্মাতা ছিলেন তাঁর স্বামী পট্টভি। সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা সত্ত্বেও, অন্যান্য নায়িকাদের মতো কখনই আরামে আয়েশে জীবন কাটাতে চাননি স্নেহলতা। সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য লড়ে গিয়েছেন সারা জীবন। তরুণ বয়সে ড. রাম মনোহর লোহিয়ার সমাজবাদী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন স্নেহলতা। জর্জ ফার্নান্ডেজের সঙ্গে প্রথমে পরিচয় না থাকলেও বরোদা ডায়নামাইট ঘটনার পর তাঁদের যোগাযোগ হয়। স্নেহলতা এবং তাঁর স্বামী পট্টভি দু'জনেই জর্জের ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে যান। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, এই বন্ধুত্বই তাদের জীবন ছারখার করে দেয়।
আরও পড়ুন- সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?
জর্জের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার কারণে মাঝেমধ্যেই পুলিশের হানা পড়ত স্নেহলতার বাড়িতে। এর আগে বার দু'য়েক তাঁর কন্যা নন্দনাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। তবে ২৭ এপ্রিল, ১৯৭৬-এ পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে যায়। সেদিন বিকেলে সিনেমার জন্য লোকেশন দেখতে যাওয়ার কথা ছিল পট্টভি এবং স্নেহলতার। বিকেল বিকেল বেরিয়ে পরদিন সকালে আবার ফিরে আসা হবে, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু সেদিন বিকেল চারটে নাগাদ পুলিশ চলে আসে বাড়িতে। নন্দনাকে তৃতীয়বারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ থানা থেকে ফোন করে বাড়িতে জানানো হয়, জিজ্ঞেসাবাদ করা হয়ে গেছে। আরও কিছু নিয়মমাফিক কাজ হয়ে গেলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে নন্দনাকে। পুলিশের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে লোকেশন দেখতে বেরিয়ে পড়েন পট্টভি এবং স্নেহলতা। বাড়িতে রেখে যান পুত্র কোণারককে। কিন্তু রাত ন'টা বেজে যাওয়া সত্ত্বেও নন্দনা বাড়ি ফেরেনা। রাত আরেকটু বাড়লে আবার পুলিশ হানা দেয় তাঁদের বাড়িতে। আর কাউকে না পেয়ে কোণারককেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সন্তানদের গ্রেফতারির খবর কানে যেতেই মাদ্রাজ থেকে বেঙ্গালুরু চলে আসেন রেড্ডি দম্পতি।
বেঙ্গালুরু আসতেই তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। সেই রাতে থানায় নিয়ে গিয়ে স্রেফ জাগিয়ে রাখা হয় তাঁদের। পরদিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল, দু'জনকে আলাদা ঘরে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত স্নেহলতা জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর আগেই জানিয়ে দেন, তাঁর পরিবারকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিবর্তে তিনি জর্জ এবং অন্যান্য নেতাদের সম্পর্কে যা জানেন সব পুলিশকে বলবেন। পুলিশ স্নেহলতার পুরো পরিবারকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দেয়। আসলে স্নেহলতার কাছে বলার মতো কিছুই ছিল না। কিন্তু পুলিশ এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করে যাতে মনে হয়, বরোদা ডায়নামাইট কেসে স্নেহলতাও যুক্ত। জিজ্ঞাসাবাদের সময়, ক্লান্ত স্নেহলতা এমন কিছু বয়ান দিয়ে বসেন, যা তাঁর বিপদ বাড়িয়ে দেয়। পুলিশের তরফে অবশ্য পরিবারকে বলা হয়েছিল, এক সপ্তাহের মধ্যেই স্নেহলতাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ৩০ এপ্রিল রাত্রিবেলা পট্টভি থানায় যান স্নেহলতার জন্য খাবার নিয়ে। গিয়ে দেখেন লকআপ ফাঁকা। তিনি সেখানে বসেই সারারাত অপেক্ষা করেন পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কেউ না আসায়, বাধ্য হয়ে পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। ১ মে দুপুরবেলা রেড্ডি পরিবার জানতে পারে, স্নেহলতাকে বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবারকে না জানিয়ে কীভাবে একজনকে জেলে নিয়ে যাওয়া হল তা ভেবে পান না তারা। স্ত্রীর জামিনের জন্য উকিল নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ছোটেন পট্টভি। সেখানে গিয়ে তিনি যা শোনেন তাতে মাথায় বাজ পড়ে। ম্যাজিস্ট্রেট জানান, স্নেহলতার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় বোম এবং ডায়নামাইটের যোগান দেওয়ার মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু এই মামলা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।আসলে স্নেহলতাকে জেলবন্দি করে রাখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো মামলা চালানো হয়।
স্নেহলতাকে বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গিয়ে যে অভব্য আচরণ করা হয় তা অকল্পনীয়! জেলে নিয়ে গিয়ে একপ্রকার বিবস্ত্র করে তাঁকে তল্লাশি করা হয়। ওই জেলের সবচেয়ে নোংরা এবং সংকীর্ণ কুঠুরি বরাদ্দ করা হয় স্নেহলতার জন্য। মে মাসের ওই গরমে পাখা তো দূর, সামান্য জানালাও ছিল না ওই সেলে। টয়লেটের নামে ওই কুঠুরির মধ্যে ছিল কেবলমাত্র একটি ছোট্ট গর্ত। ওইরকম জায়গায় দিন কাটানোর থেকে মৃত্যুও ভালো! শোনা যায়, স্নেহলতা প্রতি রাতে চিৎকার করে করে কাঁদতেন এবং বলতেন যে তিনি নির্দোষ। ঘটনাচক্রে তাঁর পাশের সেলেই সেই সময় বন্দি ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।
আরও পড়ুন- ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
পরবর্তীকালে, স্নেহলতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাজপেয়ী বলেছিলেন, “ওঁর উপর যা অত্যাচার করা হয়েছিল তা অকল্পনীয়! প্রতি রাতে আমরা ওঁর চিৎকার শুনতে পেতাম। জেল থেকে বেরিয়েও বহু রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। ওই চিৎকার মনে পড়তো।” ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হন জর্জ ফার্নান্ডেজ। পুলিশের কাছে স্নেহলতার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ ছিল না। জর্জের বিরুদ্ধে যে চার্জশিট পেশ করা হয় তাতেও স্নেহলতার নাম ছিল না। কোনও দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় স্নেহলতাকে আদালত নির্দোষ বলে ঘোষণা করে। আদালত নির্দোষ বললেও জেল থেকে তিনি ছাড়া পাননি, কেননা সেই সময় গোটা দেশের সরকারিতন্ত্র একযোগে রাগ ইন্দিরা গাইছে। স্নেহলতা ছাড়া পেয়ে যেতে পারেন, এমন পরিস্থিতি তৈরি হতেই তাঁর উপর MISA চার্জ করা হয়। ব্যস! এরপরই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে যায়।
এই ঘটনার পরে স্পষ্ট হয়ে যায়, স্নেহলতার জেল থেকে ছাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই সময় কন্নড় ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় সুপারস্টার ড. রাজকুমার নিজে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যান স্নেহলতার মুক্তির আর্জি নিয়ে। কিন্তু সঞ্জয় গান্ধীর বদান্নতায় সেই বৈঠক ভেস্তে যায়। আর জেল থেকে বেরোতে পারবেন না বুঝতে পেরে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলেন স্নেহলতা। চিৎকার করে করে কাঁদার ফলে একটা সময় গলার স্বর খোয়ান তিনি। শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। তাতেও কর্তৃপক্ষের হুঁশ আসে না। অবশেষে স্নেহলতা মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গেলে তাঁকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান স্নেহলতা। কিন্তু ততদিনে শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, গলায় স্বর নেই, ফুসফুস এবং লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ৫ দিন পর অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন স্নেহলতা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, স্নেহলতার কন্যা নন্দনাও নিজের মায়ের মতোই দুঃস্থ এবং অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর নিজের জীবন নিয়োজিত করেছেন। ২০১২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাঁর নামও মনোনীত করা হয়েছিল। অপরপক্ষে, স্নেহলতার পুত্র কোণারক রেড্ডি বর্তমানে কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক। জেলে থাকাকালীন নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন স্নেহলতা। ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর, সেই ডায়েরি বই আকারে সংকলিত করা হয় ‘A Prison Diary’ নামে।