স্বপ্নাদেশে দেখা দিল অপরূপ কিশোরী, বা‌ংলায় যেভাবে শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজো

কৃষ্ণনগরের সকল জগদ্ধাত্রী ঠাকুর বিশালাকায়, কিন্তু রাজবাড়ির প্রতিমা আকারে অনেক ছোট।

ইতিহাস, মিথ, ঐতিহ্য- সবকিছু মিলেমিশে যায় উৎসবের সঙ্গে। আঠারো শতকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে যে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয়েছিল, তা আজও গোটা বাংলায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অনেককিছু, কিন্তু সেইসব মাথায় নিয়েও আজও বেঁচে আছে ইতিহাস। সাধারণত জগদ্ধাত্রীর যেরূপ দেবীমূর্তি আমরা দেখি, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মূর্তিতে কিন্তু ভিন্নতা দেখা যায়।

 

ইতিহাস অনুযায়ী ১৭৫৪, মতান্তরে ১৭৫৬ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁ, ভিন্ন মতে নবাব সিরাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করেছিলেন। গবেষকদের মতে, প্রথমবার আলিবর্দি খাঁ-র হাতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বন্দি হয়েছিলেন। যদিও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরপুরুষ মণীশচন্দ্র রায়ের মতে রাজকর বকেয়া রাখার অজুহাতে সিরাজ তাঁকে বন্দি করেন। তাঁর কথায়, সেই সময় ফারসিতে লেখা রাজসভার কার্যাবলি ও অন্যান্য ঘটনার বিবরণ এখনও তাঁদের পারিবারিক সূত্রে রক্ষিত রয়েছে। সেই বিবরণ অনুযায়ী ১৭৫৬ সালে, অর্থাৎ সিরাজের রাজত্বকালে কৃষ্ণচন্দ্র বন্দি হন। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় তাঁর 'কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত্রম' গ্রন্থে লিখেছেন, সিরাজের দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে এসে পরামর্শ চান। কৃষ্ণচন্দ্রের উপস্থিতিতেই সিরাজকে গদিচ্যুত করে মিরজাফরকে সিংহাসন বসানোর ষড়যন্ত্র হয়। সুতরাং, কৃষ্ণচন্দ্র এবং সিরাজের মধ্যে দ্বৈরথের সম্ভাবনা একেবারেই বাতিল করে দেওয়া যায় না। এর ফলে পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, পলাশির যুদ্ধে কৃষ্ণচন্দ্র ক্লাইভকে সমর্থন করেছিলেন এবং তাঁর সহায়তাও করেছিলেন। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং তাঁর প্রতি ক্ষোভের কারণেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বলে ঐতিহাসিকরা মতামত পোষণ করেন।

 

আরেকটি মত অনুযায়ী, ১৭৬৩, বা মতান্তরে ১৭৬৪ সালে মিরকাশিমের আমলে কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিতীয়বার বন্দি হন। ইংরেজদের সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর যোগাযোগ আছে, এই সন্দেহে মিরকাশিম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গের দুর্গে বন্দি করে রাখেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। কিছু কিছু গবেষকের মতে, সেখান থেকে ফেরার সময় রুকুনপুর ঘাটের কাছে নৌকোর মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি দেবীদর্শন এবং স্বপ্নাদেশ পান।

 

আরও পড়ুন: জগন্নাথের রান্নাঘরে বয়ে যাচ্ছে দুই নদী, এখনও কেন অলৌকিক দেবতার হেঁশেল?

 

দুই ভিন্ন মতামতের কারণেই ঠিক কোন সময় কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। তবে একথা সত্য যে, নবাবের কারাগার থেকে দুর্গাপুজোর নবমী তিথিতে মহারাজা মুক্তি পান। মুর্শিদাবাদের নবাব 'কর' না দেবার অভিযোগে তাঁকে বন্দী করে রেখেছিলেন এবং নবাব জানতেন পুজোর সময় রাজাকে আটকে রাখলে দ্রুত 'কর' আদায় হবে। হলোও তাই,রাজা কে মুক্ত করতে দ্রুত ৯(নয়) লক্ষ টাকা উঠে এলো। প্রয়োজনের তাগিদে আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুবান্ধব সকলেই হাত বাড়িয়ে দিল, কারণ পুজোতে তারা তাদের মহারাজের উপস্থিতি চান।

 

এরপর একদম নবমীর দিন শেষ বেলায় কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পেলেন।অধীর আগ্রহে এই দিনটার দিকে তাকিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। বিসর্জনের আগে একবার অন্তত দেবীর মুখদর্শন করতে চান তিনি। বিসর্জনের সময় হয়ে আসছে,ঢাক-ঢোলের শব্দ প্রজাদের কোলাহল কানে আসছে তাঁর। রাজবাড়ির কাছে এসে পৌঁছলেন কৃষ্ণচন্দ্র, ততক্ষণে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে দেবীপ্রতিমাকে। ডুবে যাচ্ছে মাতৃমূর্তি। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌঁছতে পৌঁছতে দেবী মাতার চোখটুকুও ডুবে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মহারাজা। মা-কে তাঁর পুজো করা হয়নি, তিনি অঞ্জলি দিতে পারলেন না, সবটুকুই মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু একবার চোখের দেখা দেখতে পারলেন না দেবীকে। জলস্পর্শ করলেন না তিনি। সেদিন রাজবাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছেন, এমন সময় স্বপ্নে এক অপরূপ সুন্দরী কিশোরী মূর্তি দেখতে পেলেন। তাঁর আভায় চতুর্দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ক্রমে সেই মূর্তিটি মিলিয়ে গেল, তাঁর জায়গায় দেখা দিল রক্তাম্বুজা চতুর্ভূজা দেবী মূর্তি। দেবী মূর্তি রাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বললেন, কুমারী রূপে ঠিক এক মাস পরে তিনি আবার আসবেন মহারাজার কাছে। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী- এই তিনদিন তাঁর পুজো করার আদেশ দিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। ঘুম ভেঙে চমকে উঠে বসলেন মহারাজা। কে এই দিব্যদর্শন কন্যা? তিনি ছুটে গেলেন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশংকর মৈত্রর কাছে। স্বপ্নে দেখা দেবী মায়ের বিবরণ শুনে তিনি বললেন, এই দেবী চণ্ডীর আরেক রূপ। এর পূজা করো। তোমার দুর্গাপূজা না করার কষ্ট দূর হয়ে যাবে। অনুগতরাও তাঁকে পরামর্শ দিলেন, কিছুদিন এখন রাজবাড়ি থেকে দূরে থাকতে। কারণ নবাব যদি খবর পান, রাজা ফিরে এসে পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাহলে হয়তো ফের বিপদ হতে পারে। তখন রাজবাড়িতে আর ঢুকলেনই না মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সেখান থেকেই তিনি সোজা চলে গেলেন চন্দননগরে, তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু জমিদার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর প্রাসাদে।

 

এদিকে কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র এবং গোপাল ভাঁড় পুজোর আয়োজন করতে লাগলেন। নবমীর দিন গোপনে রাজবাড়িতে ফিরে এসে সোজা পুজোর ঘরে ঢুকলেন মহারাজা। পুজো শেষে অঞ্জলি দিলেন, মাতৃমূর্তি দেখে রাজার ক্ষোভ প্রশমিত হলো, মন শান্ত হলো, সকল দুঃখ দূরীভূত হল। সেই দিন থেকে শুরু হল বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজা। স্বপ্নে দেখা মহারাজার বিবরণ অনুযায়ী দেবীমূর্তি তৈরি হয়েছিল। দেবীমূর্তি সিংহের ওপর দু'দিকে পা দিয়ে বসে, চারটি হাতে ধরা আছে শঙ্খ, চক্র, তির ও ধনুক। সিংহের মুখটি ঘোড়ার আদলে তৈরি। বলা হয়, হিরণ্যকশিপুকে শ্রীকৃষ্ণ বধ করেছিলেন এইরূপ মূর্তি ধরে। এটি আসলে নৃসিংহ মূর্তি। কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, তাঁর দুর্গা মাতা আবার অন্য রূপ ধরে ফিরে এসেছেন তাঁর কাছে। এই কারণেই দুর্গামাতার মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিকেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে বলা হয় 'রাজরাজেশ্বরী'।

Krishna nagar place

জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীতে একই দিনে ক্রমান্বয়ে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো হয় রাজবাড়ীতে। এর কারণ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবমীর দিন একই সঙ্গে তিনদিনের পুজোর অঞ্জলি দিয়েছিলেন। সেই প্রথা এখনও একইভাবে পালিত হয়ে চলেছে। পুজোর সময় ঠাকুরঘর থেকে নারায়ণ শিলা নামিয়ে আনা হয় ঠাকুরদালানে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর নিজস্ব উপাসনার জন্য একটি জগদ্ধাত্রীর মূর্তি ছিল, সেটি রাখা হতো গোবিন্দবাড়িতে। দেশভাগের সময় কৃষ্ণনগর বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন এই মূর্তিটি দুষ্কৃতীরা ভেঙে প্রায় নষ্ট করে দিয়েছিল। মহারানি জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং মহারাজা শ্রীসৌরীশচন্দ্র মহাশয়ের উদ্যোগে আবার কৃষ্ণনগরের সংযুক্তি ঘটে এই দেশের সঙ্গে, তখন ভাঙা মূর্তিটি ফেরত পায় রাজপরিবার।

 

একই দিনে তিনবার পুজো হওয়ার কারণে ভোগের মধ্যেও রকমফের থাকে। ভোগে থাকে খিচুড়ি, পোলাও ৯ রকম ভাজা, তরকারি, তিনরকম মাছ, চাটনি,পায়েস, সুজি, মিষ্টি ইত্যাদি। যেমন, সপ্তমীপুজোর সময় দেবীকে পায়েস, মিষ্টি, দুধ, ছানা, ফল, বাদাম, কিসমিস, কাজু, মেওয়া ইত্যাদি দেওয়া হয়। অষ্টমীর পুজোর সময় দেওয়া হয় খিচুড়ি, তরকারি, মিষ্টি, চাটনি ও পায়েস। নবমীপুজোতে দেওয়া হয় পোলাও ও নানারকম তরকারি। এছাড়া অষ্টমী ও নবমীতে দেওয়া হয় তিনরকম মাছ।

 

কৃষ্ণনগরের সকল জগদ্ধাত্রী ঠাকুর বিশালাকায়, কিন্তু রাজবাড়ির প্রতিমা আকারে অনেক ছোট। এর কারণ, স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র যে মাতৃমূর্তির দর্শন পেয়েছিলেন, তিনি ছিলেন কুমারী বালিকার মতো।

 

জনশ্রুতি আছে, বহুকাল আগেই কৃষ্ণনগরের মালোপাড়ায় পুজোর অনুদান দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছিল মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের স্ত্রী বামাকালীর উদ্যোগে। সেই সময় ১৫ টাকা অনুদান দেওয়া হতো, সেই প্রথা এখনও চলে আসছে। বিসর্জনের সময় সমস্ত ঠাকুর রাজবাড়ি চকের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় অনেককিছু, কিন্তু ইতিহাস কথা বলে। ঠিক তেমনই কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির সামনে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের ইতিহাস এখনও থমকে দাঁড়িয়ে আছে।

 

 

 

More Articles