বৈচিত্রের জন্মাষ্টমী, যে ভাবে আজও কৃষ্ণপ্রেমে মাতে বৃন্দাবন থেকে বাংলা
সকল প্রেমের আধার তিনি, তিনি শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর ভাবধারার লীলা আমাদের বঙ্গদেশে মেঠো পথে, ধুলোতে-বাতাসে মিশে আছে। দ্বাপর যুগে যদি কৃষ্ণলীলার মত্ততায় প্রেমসাধনার সূত্রপাত হয়, তবে কলিযুগে তার বিকাশ ঘটে চৈতন্যদেবের মুক্তিসাধনায়। পৃথিবীর সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বিতরণের এই কর্মকাণ্ড কীভাবে ধীরে ধীরে ধর্মীয় ব্যঞ্জনার উৎসবে পরিণত হল, তা আমরা জানিনা। তবে আরাধনার মত্ততা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে, অন্তরআত্মার শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করি প্রতিবারই।
সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র, যাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিটি মানুষ, নিজেদের ঘরের অন্দরে, আদর-যতনে রেখে পুত্র স্নেহে লালন-পালন করে। তাকে বড় করে তোলার প্রতিটি পর্ব, তার সঙ্গে নিয়ে যাপন করা প্রতিটি দিন; মাতৃ চেতনার প্রকাশ ঘটায় আমাদের মনে। কৃষ্ণ আমাদের ঘরে ঘরে মাতৃ জঠরে জন্ম নেওয়া সন্তান। তাই তাঁর জন্মদিন আমাদের পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের জন্মদিন পালনের মতোই আড়ম্বরপূর্ণ।
বাংলায় জন্মাষ্টমীর উৎসব ভিন্ন স্থানে ভিন্ন নামে পরিচিত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রের আবির্ভাব যখন প্রাধান্য পায়, তখনই আমরা পালন করি জন্মাষ্টমী। তাই জন্মাষ্টমীকে 'অষ্টমী রোহিণী'ও বলা হয়। এর পাশাপাশি জন্মাষ্টমী পরিচিত কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী ও শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী হিসেবেও। শাস্ত্রীয় বিবরণ, জ্যোতিষী গণনা এবং লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ৩২২৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১শে জুলাই মথুরা নগরীতে কংসের কারাগারে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের ভূমিষ্ঠ হওয়াকে কেন্দ্র করে, তার পূর্বের ও পরবর্তী সময়ের ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর কথা আমরা অনেকেই জানি। তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে যে যাতনা, লড়াই, বিপর্যয় ও একাগ্রতার পরিচয় আমরা পাই, তা আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি শূণ্য আধারকে পূর্ণ করে তোলে এবং জীবনদর্শনকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আর সে কারণেই আজ শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা বৃন্দাবন, মথুরা, গোকুল কিংবা দ্বারকার সীমারেখা পেরিয়ে বিশ্বের মুষ্টিমেয় দেশে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে উত্তর উত্তর।
ঘোর অমানিশার ভেতর দিয়ে যিনি জন্মেছেন, তাঁর গায়ের রং নিয়ে আমাদের অনেকেরই নানা বিতর্কিত মতামত আছে। তবে শ্যাম অর্থে শ্যামলাভ যদি বোঝানো হয়, তবে তা ধূসর, পীত, কালো আর নীলের ঘনসন্নাবস্থান। তবু, কোথাও তাঁকে দেখা যায় কুচকুচে কালচে দেহে বাঁশি হাতে, কোথাও আবার ঘন নীলের মহিমায়। বাংলা ছাড়াও ভারতবর্ষের মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, ওড়িশা সহ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রী কৃষ্ণের আরাধনা করতে দেখা যায়।
বাংলায় যেমন জন্মাষ্টমীকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কিছু আচার-আচরণ মেনে চলা হয়, তেমনই মুম্বই ও নাগপুরে জন্মাষ্টমীর পরের দিন পালন করা হয় 'দহি হান্ডি'। এই রীতি অনুযায়ী প্রথমে ভর্তি হাঁড়ি ফাটানো হয়, তারপর সেই হাঁড়ি থেকে বের করে নেওয়া প্রসাদ, বিতরণ করা হয় সকলের মধ্যে। ভারতের বাইরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব পালন করা হয় বাংলাদেশ, নেপাল, ফিজি দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি স্থানে এবং পাশ্চাত্য দেশের কয়েকটি অঞ্চলেও।
বঙ্গদেশে জন্মাষ্টমী পালনের বিবিধ রীতিনীতির মধ্যে একপ্রকার পারিবারিক আতিথেয়তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। বলা হয় আজকের দিনে গোপালের বিগ্রহকে নতুন বস্ত্র পরিয়ে মাখন-মিছরি সহযোগে তাঁকে ৫৬ রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। এর মধ্যে উল্লখযোগ্য পদগুলি হলো ননী, মাখন, তালের বড়া, ক্ষীর, মালপোয়া, মোহনভোগ, নারকেল নাড়ু, বাসন্তী পোলা, লুচি এবং সুজি।
সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই অসংখ্য প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে সাড়ম্বরে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। আজ বলব কলকাতার খুব কাছে গঙ্গা তীরবর্তী উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরের নবাবগঞ্জের গোপীনাথ জিউর মন্দিরের কথা। মন্দিরটি স্থাপন করেন ১৮৪৫ সালে শ্রীধর মন্ডল। এই মন্দিরে রাধাগোবিন্দের সেবার পাশাপাশি ঝুলন, রাস ও দোল উৎসবও উদযাপন করা হয়। ১৯০৬ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সপরিবারে মন্দিরটি পরিদর্শনে আসেন লর্ড মিন্টো। একসময় এখানে ঝুলনে বিশাল মেলাও বসত। তার পাশাপাশি খেলাধুলা ও যাত্রাপালায় বিশেষ করে, কৃষ্ণনগরের বিশিষ্ট শিল্পীরা এসে তাঁদের ছন্দে, কথায় ও গানে রামায়ণ এবং মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী ফুটিয়ে তুলতেন দর্শকদের সামনে। এছাড়া, বৃন্দাবনের আদলে এখানে গোষ্ঠ উৎসবও পালন করা হয়।
এই মন্দিরটির গঠনশৈলীতে এখনও প্রাচীন স্থাপত্যরীতি নজরে পড়বে। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের উপরিভাগের রঙিন নকশা, উঠোনের সামনে কাঠের শক্ত বেদী, ঠাকুরদালানের চকমেলানো মেঝে, দালানের এক কোণে রাখা পরপর তিনটি সিংহাসন এবং সর্বোপরি মন্দিরের আনাচে-কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা মাটির তৈরি সং মন্দিরের আভিজাত্য বজায় রেখেছে এখনও।
তাই জন্মাষ্টমী শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আজও যেমন বেঁচে আছে বাংলার স্থাপত্য, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি, তেমনই বহু মানুষের অন্নসংস্থানও হয় এই উৎসবের সৌজন্যেই।