তারাপীঠে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়..., মহুয়া-বিতর্কে ফিরে দেখা কালীসাধনার উপাচার
পরিচালক লীনা মা কালীকে ধূমপান করিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তার রেশ চলতে পারে আরও কিছু দূর। তবে তন্ত্রমতে একটা কথা সিদ্ধ যে, মদ, মাংস ছাড়া মা কালীর নৈবেদ্য অসম্পূর্ণ।
'কালী’ ছবির পোস্টারে মা কালীকে ধূমপানরত অবস্থায় দেখিয়েছেন পরিচালক লীনা মনিমেকলেই। ২ জুলাই ট্যুইটারে এই ছবি তিনি পোস্ট করেন। এরপর এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হতে সময় লাগেনি। এদিকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তিনি বলেন, "আমার কাছে মা কালী আমিষ ভক্ষণকারী এবং সুরাপানকারী এক দেবী। কে কীভাবে তাঁর আরাধ্য দেবতার ছবি আঁকবেন, এটা একেবারে তাঁর নিজস্ব বিষয়।" তারাপীঠে দেবী আরাধনা নিয়েও এই প্রসঙ্গে বলেন তিনি। দেখে নেওয়া যাক, তন্ত্রে কীভাবে মা কালীকে পূজা নিবেদন করা হয়।
কালী শব্দটি 'কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। পুরাণ মতে, শিবের অপর এক নাম কাল। আবার অন্য ক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ 'কৃষ্ণ’, অর্থাৎ`কালো’ বা 'ঘোর বর্ণ’। মহাকাব্য মহাভারতে যে ভদ্রকালীর উল্লেখ রয়েছে, তা দেবী দুর্গারই অন্য রূপ। মহাভারতে কালরাত্রি বা কালী নামে অপর এক দেবীর উল্লেখ রয়েছে। পুরাণমতে কালীর আট রূপ- দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালিকা, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। তোড়লতন্ত্র অনুসারে কালী ন'প্রকার। যথা, কৃষ্ণকালী, দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালিকা, চামুণ্ডাকালিকা, শশ্মানকালিকা ও মহাকালী। এই রূপভেদে মা কালীর পুজোর ধরনও আলাদা। তবে মা কালীর পুজো মানেই মদ, মাংসের নৈবেদ্য।
শক্তির আরাধনায় প্রধান আখর পাঁচ `ম’। এমনটা বলেন ব্রহ্মনিষ্ঠ সাধকরা। কিন্তু কী এই পাঁচ ম- যা ছাড়া কালীপুজোই হবে না। নির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে, এই পাঁচ 'ম' হল– মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন। এর মধ্যে মদ্য কি সুরা? এই নিয়ে মতভেদ আছে। অনুকল্পতত্ত্বে মদ বলতে কাঁসার থালায় নারকেলের জল বা তামার পাত্রে দুধের কথা বলা হয়। দিব্যতন্ত্রবলে, মদ নাকি ব্রহ্মরন্দ্রে সহস্রপদ্মস্থ চন্দ্রকলা থেকে নির্গত অমৃতধারা। আসা যাক মাংসের কথায়, প্রশস্ত্রতন্ত্র বলে, ছাগ, মেষ, সজারু, সারস, হাঁস- এগুলো মাংস হিসেবে বিবেচিত প্রাণী। মাছ বলবে বোঝানো হয় তৈলাক্ত বড় মাছকে। এক্ষেত্রে তেলে বা ঘিয়ে ভাজা মাসকলাই, ছোলা এসবকে মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মৈথুন হলো সাধকের সঙ্গে শিবস্বরূপিনী সাধিকার সংযোগ। যোগিনীতন্ত্রে বলা হয়েছে, রক্তকরবী লিঙ্গপুষ্প আর অপরাজিতা যোনিপুষ্প- এই দুইয়ের সম্মিলনই পঞ্চমতত্ত্বের অনুকল্প।
আরও পড়ুন: কালীর ধূমপান! কেন বারবার ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে দানা বাঁধছে বিতর্ক?
কালীপুজোয় মদ এবং মাংস- উভয়েরই ব্যবহার রয়েছে। তবে শাস্ত্রে কখনও কালীপুজোতে মদ খাওয়ার কথা বলা হয়নি। বাংলায় মা কালীকে শ্যামাকালী কিংবা দক্ষিণাকালী হিসেবে পুজো করা হয়। মা কালীর বাঁহাতে রয়েছে খড়গ এবং নরমুণ্ড- যা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। ডান হাতে রয়েছে বর এবং অভয় মুদ্রা। মা কালীর গায়ের রং ঘন নীল। গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের হার। কোমরে রয়েছে নরহস্তের কটিবাস। আর তাঁর বাঁপায়ের নিচে শায়িত শিব। পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, তাল, খেজুর-সহ একাধিক গাছ থেকে যে রস নিসৃত হয় সেইটিকে মদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকারের মতে, কালীর অন্য রূপ চামুণ্ডা আদতে মহাভারতের বিন্ধ্য অঞ্চলের অরণ্যচারী উপজাতি সমাজে পূজিতা হতেন। তারা দেবী চামুণ্ডাকে পশু, নরবলি দিয়ে মদ উৎসর্গ করতেন পুজোতে। ঋষি বশিষ্ট বাংলায় মদ-সহকারে তন্ত্রসিদ্ধ দেবী চামুণ্ডার পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন। কয়েক বছর ধরে দেবীর উপাসনা করে সিদ্ধিলাভ করতে পারছিলেন না ঋষি বশিষ্ট। অবশেষে বিষ্ণুর নির্দেশে চিনে যান তিনি। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুনের সমাহারে তন্ত্রমতে দেবীর আরাধনা করা হয়।
কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু তথা বাঙালিদের কাছে এই দেবী বিশেষভাবে শক্তির দেবী রূপে পূজিতা হন। এছাড়াও বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা হয়। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপুজো করে থাকে। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বেশি জনপ্রিয়। ঘরে যে মাতৃরূপের আরাধনা হয়, তা ভয়াল রূপ নয়, বরং মায়ের শান্ত রূপের আরাধনা করা হয়।
ডাকাতির সঙ্গে এক সময় কালীপুজোর বিশেষ যোগ ছিল। রঘু ডাকাত যেমন ল্যাটামাছ পোড়া দিতে মায়ের ভোগ দিত, তেমন তারাপীঠে কালীপুজোয় মা তারার ভোগে দেওয়া হয় শোলমাছ পোড়া। কালীপুজোয় দক্ষিণেশ্বরে মা ভরতারিণীকে পাঁচ রকম মাছের ভোগ নিবেদন করা হয়। পোনা, পার্শে, কই, চিংড়ি, কাতলা- যেটা যেমন পাওয়া যায়। কালীঘাটের ভোগে থাকে তিন রকম মাছ- রুই, ইলিশ, চিংড়ি এবং কচি পাঁঠার মাংস। তারাপীঠে শোল মাছ পোড়া তো বটেই, আরও কয়েকরকম মাছের সঙ্গে বলির পাঁঠার মাংস, কারণবারি, অর্থাৎ মদ নিবেদন করা হয়।
এই ভোগের ধরন বলে দিচ্ছে, কালীপুজোয় আমিষ মোটেই দোষের নয়। আর সেই জন্য বাড়িতে পুজো হোক না হোক, দুর্গাপুজোর অষ্টমী, সরস্বতী পুজো, লক্ষ্মীপুজোতে চরম আমিষভোজী বাঙালিকে যে খিচুড়ি আর লাবড়া খেয়ে কাটাতে হয়, তাঁদের কাছে কালীপুজো এক মোচ্ছব।
মহুয়া মৈত্র আলাদা করে তারাপীঠের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে কীভাবে পুজো হয়?
বীরভূমের তারাপীঠ সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠস্থান। সারা বছর তারা মা-রূপে পূজা পেলেও কালীপুজোর দিন মা কালী রূপে তাঁকে পূজা করা হয়। অমাবস্যা তিথি মেনে গভীর রাতে নিশিপুজো হয় তারাপীঠে। কালীকে স্নান করিয়ে নতুন বেনারসি পরানো হয়। দুই বেলা অন্নভোগ দেওয়া হয়। বিশেষ দিনে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, তিন রকমের তরকারি, মন্দিরের বলির মাংস, পোড়ানো শোল মাছ, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। সন্ধ্যাবেলায় আরতিতে লুচি, মিষ্টি নিবেদন করা হয় মা কালীকে।
পরিচালক লীনা মা কালীকে ধূমপান করিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তার রেশ চলতে পারে আরও কিছু দূর। তবে তন্ত্রমতে একটা কথা সিদ্ধ যে, মদ, মাংস ছাড়া মা কালীর নৈবেদ্য অসম্পূর্ণ।