কলকাতা নেই কলকাতাতেই, শেষ কুড়ি বছরে কতটা বদলে গেল শহর
কলকাতার চেহারা কতটা পালটাল? কী কী হারাল শহর থেকে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা নিয়ে একটি কবিতা লিখে গিয়েছিলেন, ‘স্বপ্ন’। কবিতাটির সারমর্ম ছিল যে, কবি একদিন স্বপ্নে দেখছেন, আস্ত কলকাতা শহরটা হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলেছে। সবাই থামতে বললেও কলকাতার তা শোনার সময় নেই।
লক্ষ
লক্ষ লোক বলে, “থামো, থামো”, কোথা
হতে কোথা যাবে, একী পাগলামো”। কলিকাতা
শোনে নাকো চলার খেয়ালে; নৃত্যের নেশা তার স্তম্ভে দেয়ালে
এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে কবিতাটি পড়লে সুন্দর একটি বাস্তবিক মিল আমরা কিন্তু পাই। এবার অনেকেই বলবেন ‘কোথায় কলকাতা হাঁটছে? কলকাতা তো কলকাতাতেই আছে, তাহলে?’ না, সেই ছোটার কোথা হচ্ছে না। এই শহরটা হয়তো আক্ষরিক ছুটছে না, কিন্তু কলকাতাবাসীরা? যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে রিলের রেসে নিজেদের জেতাতে আমরাও তো ছুটছি পাগলের মতো, আর তাই আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে তিলোত্তমাও।
কলকাতা, শহরটার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভালবাসা, সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক অসীম ক্ষমতা। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই শহর, ঘটেছে অনেক পরিবর্তন, এসেছে বিবর্তন। এই শহর দেখেছে স্বাধীনতার সংগ্রাম, দেখেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশভাগের বেদনা, পেয়েছে বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্য, প্রথম মেডিক্যাল কলেজ, লাইব্রেরি, নারী-শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর তো এই তিলোত্তমাতেই। যত দিন যাচ্ছে, হেরিটেজের লিস্ট বাড়ছে। ছোটবেলায় রোজকার জীবনে দেখে আসা কলকাতার অনেককিছুর অনেক স্মৃতি এখন মলিন, আর তাই আজ বরং ঘুরে আসা যাক সেইসব অতীতের চোরাগলিতে।
আরও পড়ুন: কলকাতার বাতাসে বিষ! উদাসীন থেকে কত বড় বিপদ ডেকে আনছে শহরবাসী
ভারতে প্রথম মেট্রো রেল চালু হয় ১৯৮৪ সালে কলকাতায়, আর সেখান থেকেই কলকাতার ধীরে ধীরে আধুনিকীকরণের শুরু। তবে মেট্রো শুরু হলেও পাতাল রেলের এত রমরমা তখন ছিল না। রমরমা ছিল ট্রামের, গোটা শহরটা দিয়ে এঁকেবেঁকে ছিল শুধু ট্রাম যাওয়ার লাইন আর এখন সেখানে ঠিক দুটোমাত্র ট্রামরুট। আগে সাধারণ মানুষ ট্রামে চড়ত যাতায়াতের জন্য আর এখন ট্রামে চড়ে ভ্লগাররা বা নতুন প্রজন্ম, যারা কেবল যাতায়াতের জন্য, নিত্যপ্রয়োজনে কোনওদিন ট্রামে চড়েনি। কিন্তু একবার উঠেই সেলফি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে তাঁদের ট্রামযাত্রা সম্পূর্ণ হয়। ট্রাম চললেও আজকের যুগের গতির সঙ্গে সে টেক্কা দিতে পারে না। তাই সেরম ভিড় ট্রামে আর হয় না এখন। যেখানে একসময় ভিড়ের চোটে উঠতে পারত না লোক, সেখানে ফাঁকা ট্রাম ছুটে চলে শহরের এই মাথা থেকে অন্য মাথা। তাও তো ট্রাম জেল্লা হারিয়েও এই শহরে এখনও বিরাজ করছে, কিন্তু দোতলা বাস? সে তো কবেই মুছে গেছে। শেষ দোতলা বাস কলকাতায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ২০০৫ সালে। এই বাসগুলি কলকাতায় প্রথম চালু হয় ১৯২০ সালে, ব্রিটিশদের হাত ধরে। ওই সময় সারা শহরে চলত এই বাস। তাও আজ আর নেই, তখন এই একতলা বাস ছিল, তবে পরিমাণে খুবই কম। এখন তো একতলা বাসেরই রমরমা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী আবার এই হেরিটেজকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু তা শুধুমাত্র শহর ঘোরার জন্য, সেই বাসে চড়তে গেলে আগে থেকে অনলাইনে টিকিট কাটতে হয়, মানে শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই এই বাসের ব্যবস্থা করা।
ট্রাম বা দোতলা বাসেই শেষ নয়, ছিল কালো-হলুদ ট্যাক্সি। হলুদ ট্যাক্সিও চলত পাশাপাশি, তবে সংখ্যাটা কম। নয়ের দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে কালো-হলুদ ট্যাক্সির দাপট কমতে থাকে, আর বাড়তে থাকে হলুদ ট্যাক্সি। এখন নিয়তির ফেরে হলুদ ট্যাক্সিও শূন্য হওয়ার পথে। কারণ, অ্যাপ ক্যাবের বাড়বাড়ন্ত। তখন রাস্তার কোনায় কোনায় এত গাড়ির লাইন থাকত না, এত ব্যক্তিগত গাড়িও ছিল না সাধারণ মানুষের। থাকার মধ্যে ছিল কিছু প্রাইভেট অ্যাম্বাসাডর, তথাকথিত বড়লোকদের ফিটন গাড়ি আর হাতে টানা রিকশা।এরপর নয়ের দশকে ধীরে ধীরে আসতে থাকে মোটরবাইক, অটোরিকশা, টাটা সুমো ইত্যাদি গাড়ি। আর ততই চাহিদা কমতে থাকে ট্রাম আর ট্যাক্সির।
এখন মুঠোফোনের জমানা। নয়ের দশকে সকলের বাড়িতেই মোটামুটি ল্যান্ডফোন এসে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় তখন ল্যান্ডফোনের বুথ ছিল, এসটিডি বুথ নামেই যাকে আমরা চিনতাম। এখনকার মতো ব্যক্তিগতভাবে সবার হাতে যেহেতু ফোন ছিল না, তাই পরিবারের দু'-তিনজনের একসঙ্গে ফোনের দরকার হলে ছুটতে হতো পাড়ার ফোন বুথে। এরপর নয়ের দশকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে আসতে থাকে হ্যান্ড ফোন, যা আগে শুধু কথা বলায় সীমাবদ্ধ ছিল, তার প্রসার বেড়ে হয় এসএমএস পর্যন্ত। এরপরের ইতিহাস তো সবাই জানে, টাচ স্ক্রিনের আগমন, ইন্টারনেটের বিস্তার আর সূচনা এক নতুন যুগের।
উত্তর কলকাতায় ক্ষেত্রবিশেষে ব্রিটিশ ছাপ আজও স্পষ্ট, সেখানকার বাড়িগুলোতে ছিল ইংরেজি আদলের ছোঁয়া। বদলের ঢেউ সেখানেও লেগেছে, তবে অতটা নয়। আজও উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়ি ঐতিহ্যের প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে নয়ের দশকের শেষের দিক থেকে দক্ষিণ কলকাতায় শুরু হয় ফ্ল্যাটবাড়ির রাজত্ব, যা আজকের কলকাতায় চরম আকার নিয়েছে। যে ক'টা ঐতিহ্যশালী বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাও প্রোমোটারদের নজরে পড়ে ফ্ল্যাট হওয়ার পথে। নেই খোলা ছাদ, বারান্দা, চিলেকোঠার ঘর, ঘুলঘুলি, আর সেই বিখ্যাত কাঠের খড়খড়ি দেওয়া ঝিলিমিলি জানলা। তার বদলে জায়গা করেছে দশ বাই দশ ফুটের ঘর।
পাড়ায় পাড়ায় অনেক বেশি বন্ধন ছিল, ছিল পাড়ার মোরের রক, রকের আড্ডা। ছিল পাড়ায় পাড়ায় নাটকের দল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্বভাবতই সেইসব অনুষ্ঠান ছিল নিতান্তই সাধারণ, কিন্তু আবেগ ছিল ভরপুর। ক্লাব সংস্কৃতি অবশ্য তখনও ছিল, এখনও আছে। তথাকথিত বড়লোকদের জায়গা ছিল তা, এখন সেই ভেদাভেদটা কমে আসছে। পুজো নিয়ে ছিল না এত ব্যবসা, এত থিম-স্পনসরের আড়ম্বর ছিল না, বিশ শতকের গোড়া থেকে এই থিম প্যান্ডেলের প্রচলন শুরু হয়। তখন রেস্তোরাঁ বলতে ছিল রয়্যাল, নিরঞ্জন আগার, নিজাম, গোলবাড়ির কষা মাংস, ফ্লুরিজ ইত্যাদি বিখ্যাত কিছু রেস্টুরেন্ট।
শহর তিলোত্তমা বরাবরই পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে। এই চার দশকে ঘটা যুগের পরিবর্তনের সাক্ষী সে। সবকিছুই কি বদলেছে? না, কিছু জিনিস আজও অমলিন। তার মধ্যে অন্যতম ঘটি-বাঙাল লড়াই, ইলিশ-চিংড়ি, রাজনীতি আর ফুটবলের প্রতি এই শহরের ভালবাসা। চায়ের কাপের ধোঁয়ায় আজও জোরকদমে আলোচনা চলে। চটের থলে নিয়ে বাজারে গিয়ে দরদাম করা থেকে আজকের অনলাইন ডেলিভারি, পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকান থেকে গলিতে গলিতে একটা করে ক্যাফেটেরিয়া, এতকিছুর মাঝেও শহরটা যেটুকু নস্টালজিয়া নিয়ে বেঁচে আছে, সেইটুকু বহন করে ‘City of Joy’ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখুক, এটাই চাওয়ার।