কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!
Cricket World Cup 2023: কুড়ি বছর পর একটা ক্রিকেট ম্যাচ যদি জিতে যাওয়া যায়, গলির ছেলেরা অন্য রকম ভাববে।
গলির ছেলেরা জানে স্বপ্নভঙ্গের মানে।
ওরা তখন সাইবার ক্যাফে যেত। লাল রঙের কিউবিকল, নাম সিফি। ঘন্টায় দশ টাকার বিনিময়ে ওরা জানতে পেরেছিল, পৃথিবীটা স্রেফ এই এঁদো গলি, রেললাইনের ধারের স্কুল, সাদা কালো ইতিহাস বই নয়। পৃথিবীটা অনেক বড়, উত্তমাশা অন্তরীপ, আছে। বারমুডা ট্রায়ঙ্গল, আছে। স্টেফি গ্রাফ, আছে।
ওরা তখন স্পোর্টসস্টার কিনত, ভয়াবহ কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে টাকা বাঁচিয়ে। না, পড়ার জন্যে নয়। নয়নাভিরামকে দেখার জন্যে। স্পোর্টসস্টারের মাঝের পাতায় দু'কুল ভাসানো একটা ছবি থাকত। দেখা দিতেন তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা সেরেনা বা ভেনাস উইলিয়ামস। কিশোরী মারিয়া শারাপোভা। সময় নষ্টের সময় নেই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ওরা সেই ছবি ছিঁড়ে ঢুকিয়ে রাখত চাঁদমামার ভিতর। চলাচলের পথে পথিক ভাববে বালক চাঁদমামা পড়ছে। বালক আদতে মনোযোগ দিয়ে দেখছে শারাপোভার স্কার্টের ঘের। কানের চামড়া গরম হয়ে যেত। হাঁটু মুড়ে বসতে হতো।
সন্ধে মানে পড়তে বসা। পড়া তেমন হতো না, পাশের ঘরেই হয়তো তারস্বরে টিভি চলছে। ওরা নীরব-সংহার শিখছিল, পকেটমারের ব্লেডমারা প্র্যাকটিস যাকে বলে। পথিক ভাববে ছেলেটা নিবিড় মনোযোগে পড়ছে, কিন্তু আদতে ওরা ঘন ঘন পাতা উল্টে বুক ক্রিকেট প্র্যাকটিস করত। বারবার পাতা উল্টালে, পাতা উল্টানোর একটা ছন্দ তৈরি হয়। কী রকম চাপ সৃষ্টি করলে কত নম্বর পৃষ্ঠা খুলবে ওদের আঙুল জানত। বাড়িতে নেট প্র্যাকটিস। স্কুলে গেলেই ম্যাচ। এই বইটা সবাই মেনে নিলে ছয়-চার পড়বেই।
আরও পড়ুন: পাক ক্রিকেটারের হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজে দিয়েছিল বিশ্বকাপই
ওরা সাইকেল ভালবাসত। ওদের সকলের একটা গোপন সে ছিল। ওরা ভাবত সে টাইটানিকের রোজের মতো সুন্দর, হতভাগারা জানত না মহিলার নাম কেট উইনস্লেট। কেউ কেউ বাংলা মতেই বিশ্বাসী, ভাবত সে কাজল। ক্যাটরিনা কাইফ তখন কোথায়। ওরা কিন্তু সেই তাকে বলেনি কিছুই, বুক ফাটে মুখ ফোটে না। ওরা অপেক্ষা করত ঠাকুমা কখন ঘুমোবে। তখনই ডায়াল হবে ৫৬৮-৯৯৮৫। গলাটা শুনে ওরা রেখে দেবে। চুরি করে গলা শুনে লাভ কী, ওরা ভাবেনি। ওরা ভেবেছে এ আরও সজলঘন হলো।
ওরা উঠোনে ক্রিকেট খেলত। বিকেলে ওরা কেউ সচিন, কেউ সৌরভ, কেউ শেন ওয়ার্ন, কেউ অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, দু'একজন রাহুল দ্রাবিড়। মাঠে হাত-পা ছড়ে যেত, লোপ্পা ক্যাচ মিস হয়ে যেত। বল স্পিন করত না, বড় দাদারা আগে নামত। ওদের কারো কারো মনে হতো আমি কি তবে ঋষিকেশ কানিতকর, আমি কি তবে সুনীল যোশী! একেকদিন ওরা শর্টরান নিতে গিয়ে আউট হওয়া রুখতে গিয়ে মরণঝাঁপ দিত। পিতার নাম হয়তো অজয় সরকার। সন্তান রান নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ঘোষণা করত আমিই রবীন সিং।
ওরা দেখছিল বাবা কাকা-রা মোবাইল কিনছে। সিম পাওয়া কোনো যে সে কথা নয়, সকলে পাবে না। পিতৃদেবের ফোন থেকে অপরাধীর মতো কানারাতে মেসেজ করা শিখে নিল। গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম এই, জরুরি কথা হবে সংকেতে, রাতে। তাই ওরা কোডে বন্ধুকে মেসেজ করত। ওরা সাঁতার কাটতে যেত রবিবার সকাল ন'টায়। ওরা জন্মদিনে বাবার কাছে একটা ব্যাটের আবদার জানাত। নিজের ব্যাট আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। যার ব্যাট আছে তার সব আছে।
সব মিলে ওদের জীবনটা ছিল রোদেলা ফুলবাগিচার মতো। শুধু একটা বিকেল ওদের সমস্ত স্বপ্ন লন্ডভন্ড করে দিল। সে বিকেলে ওরা কেউ খেলেনি। ওরা দেখছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে, মহারাজ এ কী সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে। ওরা জানত ওরা জিতবেই। ওদের স্বপ্নের কাচবয়াম হাত থেকে ফেলে দিল রিকি পন্টিং। ৮৮ বলে ১৪০ রান করে এমন জায়গায় নিয়ে গেল নিজের দলটাকে, গলির ছেলেদের দল গো-হারা হেরে গেল।
এর আগে ওরা কখনও চুপ করে থাকেনি। হাঁসচলার আওয়াজ পাওয়া যেত ওরা জমায়েত করলে। এইবার ওরা চুপ করে গেল। ওরা জানল, স্বপ্নভাঙার মানে। রান তাড়া করে হেরে যাওয়া কাকে বলে। ওরা রাতে কাঁদল। ভেবে দেখল, মারিয়া শারাপোভাকে পাওয়া যাবে না কখনও। মাঠে কেউ আগে নামতে দেবে না। কালেভদ্রে নামলে গা তাক করে জোরে বল করবেই। বুক ক্রিকেটে জীবনে জেতা হবে না। সাইকেলের চেন পড়ে যাবে যখনতখন, পকেটে পয়সা নেই তাই সাইকেল হাঁটিয়ে বাড়ি আনতে হবে। ওরা সিদ্ধান্ত নিল। প্রথম সিদ্ধান্ত, আর খেলাই দেখব না। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, স্পোর্টসস্টার দরকার নেই আর। ধুর, চাঁদমামাও চাই না। ওরা বুঝে নিল, ওরা কখনও জিতবে না। কিন্তু যে হেরে যায় সে কি মরে যায়! সে বাঁচে, এমনি বাঁচে, চুপ করে, দু'দশটা বাজে কথা বলে, পাপে হাত পাকিয়ে। বাঁচে।
বাজারে তখন আসছে রংবাহারি মোবাইল ফোন। ল্যান্ডফোন বিগতযৌবনা। টেপ রেকর্ডার সরে গিয়ে বাড়িগুলিতে ঢুকছে সিডি মেশিন। কালার টিভির আয়তন ছোট হল। ওরা ততদিনে জেনে গিয়েছে, যা কিছু হতে পারে। ওরা এই যা কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করত। পাশ করার জন্যে পড়ত, সময় কাটাতে পড়ত। সফল হতে পড়ত না, কারণ সাফল্য যে অধরামাধুরী ওরা জানত। সাইবার ক্যাফেতে ওরা পর্নোগ্রাফি খুঁজত। আগের মতো ব্যাট নয়, বিদেশি নারীপুরুষের রমণক্রীড়া, বিড়ি- সিগারেট-এগুলিই ওদের টানত। ওরা জানত সে আর আসবে না। ওরা খুঁজে নিয়েছিল একজন যে দূরতম দ্বীপ হবে না, হবে পাশের পাড়া। ওরা দেখল, সিপিএম-ও হেরে যায়।
'সময় যায়, বটপাতায়'। গলির ছেলে স্কুল কলেজ পেরিয়ে যায়। যে যার মতো কাজ করে। কেউ কেউ হারিয়ে য়ায়। কাজ থেকে ফেরার পথে মাঠে কেউ খেলছে দেখলে গতি কমিয়ে আনে সামান্য। কেউ কেউ কাজের খোঁজে অনেক দূর চলে যায়। কেউ বড় অল্প। ফেরাগুলি বদলে গিয়েছে ততদিনে। পাড়াগুলি নেই আর। ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট। ওদের মধ্যে যারা হাতে বোম ফাটাত, ব্যাট করত সারা বিকেল, তারা দুমদাম মরেও যায়। ওরা জেনে যায়, ক্রিজে টিকে থাকাটাই কঠিন কাজ। ওরা প্যাড গ্লাভস ক্লোজ করে টিকে থাকে। ঘাড় গুঁজে যে যার কাজ করে। করতল দিয়ে, পচা খাল দিয়ে বয়ে যায় কুড়িটা বছর। পড়ে থাকে ক্লেদজকুসুম জীবন।
আরও পড়ুন: দ্রাবিড় শিখিয়েছেন: যত্ন করে হারতে শেখাটাও জরুরি
২০০৩-২০২৩, দুই ফাইনালের মাঝে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে গলির ছেলের কৈশোর-যৌবন। অতঃপর, এই কুড়ি বছর পর, আবার এক স্বপ্নের হাতছানি। ওরা মন ফেরাতে চায়নি। ওরা চায় না বেদনাভার। ওরা ভেবেছিল ওদের হৃদয় সেই দোনলা বন্দুক যার কোনো ট্রিগার নেই। কিন্তু ওদেরই কেউ দৈত্যের মতো প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ-
"আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে—
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী
নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে"
ওদেরই কেউ অবিরাম প্রতিধ্বনি শুনছে-
"জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!"
কুড়ি বছর পর একটা ক্রিকেট ম্যাচ যদি জিতে যাওয়া যায়, গলির ছেলেরা অন্য রকম ভাববে। ওরা জানবে, এ পৃথিবীতে আজও আছে কনে দেখা আলো। যে কখনও আসবে না জানা গিয়েছিল কৈশোরে, সে বাঁধবে বাহুডোরে আজ।