রোগে অনটনে জেরবার! চাকরি চেয়ে যে অবাক করা চিঠি লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়...

Manik Bandyopadhay Job Application: মানিক বলেছিলেন, ''দেখো দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।''

১৯৩৫ সাল। সেই বছরই 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকা মাসিক সংস্করণের পাশাপাশি সাপ্তাহিক সংস্করণ চালু করল। সম্পাদক দু'জন— সজনীকান্ত দাস ও কিরণকুমার রায়। সাপ্তাহিকপত্রের জন্য প্রয়োজন ছিল একজন সহকারীর৷ এই মর্মে বঙ্গশ্রীর তরফে একটি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এই চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন এমন একজন মানুষ, পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যকেই যিনি সম্পূর্ণ অন্য এক দিশায় এগিয়ে দিয়েছিলেন। গদ্যের দাপটে থতমত খেয়ে গিয়েছিল বাঙালির মূল্যবোধ। 

অন্য অনেকের মতোই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁর চাকরির দরখাস্ত পত্রিকার দফতরে পাঠান। দরখাস্তটি দুষ্প্রাপ্য নয়। ডঃ সরোজ মোহন মিত্রের 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্য' গ্রন্থে আগাগোড়া সেই চাকরির আবেদন মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু এই চিঠিটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এমন কয়েকটি বিষয় যে কারণে আর পাঁচটা সাধারণ চাকরির চিঠির থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল এটি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই চিঠি আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোধ-দর্শনের এক অবাক দলিল।

১৯৩৫ সালে মানিকের বয়স ২৬ বছর। অথচ এর আগে তিনি মোটেও হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজেননি। আর্থিক প্রয়োজন ছিল বটেই, ধীরে ধীরে তা অনটনের আকার নিল। কিন্তু বাঁধা কেরানিগিরিতে মানিকের বরাবর তীব্র অনীহা। আজীবন চাকরি না করে শুধুমাত্র সাহিত্য লিখে সেই উপার্জনে ভাত-কাপড় জুটিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল প্রবল। তাই অসম্পূর্ণ উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরির হাহাকার তাঁকে কুরে খায়নি৷ 

আরও পড়ুন- প্রেম আসলে নিষ্ঠুর, আদিম! মানিক, বনফুল, তারাশঙ্করের না-ভালোবাসার তিন আখ্যান

১৯২৮ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্প 'অতসীমামী' বাংলা সাহিত্য মহলে সাড়া ফেলেছে। খোদ 'বিচিত্রা'-র সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ি এসে সম্মানদক্ষিণা আর পত্রিকার একটি কপি হাতে ধরিয়ে আবার গল্প পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গেছেন। এই সাত বছরে প্রকাশিত একাধিক গল্প নিয়ে প্রথম গল্প সংকলন সদ্য বের হতে চলেছে মানিকের। পাশাপাশি, 'ভারতবর্ষ' ও 'পূর্বাশা'য় দু'টি উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রেসিডেন্সির পাঠ ততদিনে চুকে গিয়েছে। অঙ্কে স্নাতকের পাঠ মুলতবি রেখে মানিক কোনও রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সাহিত্যের ময়দানে নেমে পড়েছেন। ইচ্ছে ছিল, তিরিশের চৌকাঠ না পেরোলে কলম তুলবেন না। কিন্তু প্রথম গল্প প্রকাশের মোহে ততদিনে সেই পণ ভুলেছেন। মানিকের আকস্মিক পরিবর্তন দেখে বন্ধুমহলেও শোরগোল, পরিবারেও অসন্তোষ। কৃতবিদ্য বৈজ্ঞানিক দাদার চিঠিতে কৈফিয়ত তলব— কেন এই অধঃপতন? ঠিক কী কারণে পর পর দু'বার পরীক্ষায় ফেল? জবাবে মানিক জানিয়েছিলেন, পাঠ্যপুস্তক পড়ার সময় নেই। তার বদলে সারা বছর পড়েন রাশিকৃত বিদেশি লেখকের লেখা গল্প ও উপন্যাস। চিঠির শেষে সদর্প ঘোষণা করেন মানিক— "গল্প উপন্যাস লেখা ও পড়া আমি ছাড়তে পারব না। কাজেই কলেজের পড়াই আমায় ছাড়তে হবে। তবে আপনি দেখে নেবেন, কালে এই লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে।" কথাগুলো যখন বলছেন, তখন মানিকের বয়স মোটে বাইশ বছর!

মধ্যবিত্ত পরিবারে সদ্যযুবকের সাহিত্যরচনায় আস্কারা দেওয়ার চল সেদিনও ছিল না, আজও নেই৷ এর জেরেই মানিকের দাদা সুধাংশুকুমার ভাইয়ের সঙ্গে এক প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ক্রমশ পরিবারের বাকিরাও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এই সমবেত, চরম ঔদাসীন্য মা-হারা ছেলের বুকে সেদিন প্রবলভাবে বিঁধেছিল। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও মানিককে খুবই স্নেহ করতেন, সাহিত্য রচনাতেও উৎসাহ জোগাতেন ঠিকই। কিন্তু ততদিনে তিনি সরকারি কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। যৌথ পরিবার সামলানোর দায়ও অনেক। ফলে আর্থিক সংকট উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে।

এত কিছুর পরেও মানিকের অদম্য জেদ কিন্তু এতটুকু টলেনি। সাহিত্য-জীবনের শুরুর দু'বছরেই লিখে ফেলেছেন সাতখানা গল্প ও উপন্যাস। কিন্তু এই অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম আর মানসিক ধকলের শোধ তোলে শরীর। ১৯৩৫ সালেই মানিক মৃগী রোগে আক্রান্ত হন। অতুলচন্দ্র গুপ্তকে লেখা চিঠিতে অকপটে জানান—

"প্রথম দিকে পুতুলনাচের ইতিকথা প্রভৃতি কয়েকখানা বই লিখতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটি শরীর আছে এবং পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিল, তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এক মাস থেকে দু' তিন মাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে।"

এই জটিল পরিস্থিতিতে উপায়ান্তর না দেখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'বঙ্গশ্রী'-র সম্পাদকের কাছে এই দরখাস্তটি পাঠান—

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

সম্প্রতি অবগত হইলাম যে মহাশয়ের পরিচালিত 'বঙ্গশ্রী' নামক মাসিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের পদটি খালি হইয়াছে। উক্ত পদপ্রার্থী হইয়া আমি এই আবেদন প্রেরণ করিলাম। বাংলা পত্রিকা সংক্রান্ত ব্যাপার বলিয়া বাংলাতে আবেদন করিলাম।

১। আমার প্রকৃত নাম শ্রী প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে আমি সাহিত্য সেবা করিয়া থাকি৷ আমার বর্তমান বয়স ২৬ বছর। ঈশ্বরেচ্ছায় ইতিমধ্যে আমি লেখক হিসাবে কিছু সুনাম অর্জন করিয়াছি৷ আমার সম্বন্ধে শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত মন্তব্য এই সঙ্গে পাঠাইলাম।

২। আমি ১৯৩০ (ইং) সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে গণিতে অনার্সসহ বিএসসি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হইয়াছিলাম, অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দিতে পারি নাই৷ তৎপরে সাহিত্যসেবা আরম্ভ করিয়া বিএসসি পরীক্ষা দিলে আমার জীবনের উদ্দেশ্যসাধন বিষয়ে কোনোরূপ সাহায্য হইবে না মনে করিয়া আমি আর কোনোরূপ চেষ্টা করি নাই।

৩। আমি এ পর্যন্ত বহু ছোটোগল্প রচনা করিয়াছি। গল্পগুলি সাহিত্য-বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। বর্তমানে ভারতবর্ষে ও পূর্বাশায় আমার দুইটি উপন্যাস প্রকাশিত হইতেছে। 'জননী' শীর্ষক একটি উপন্যাস গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স শীঘ্রই প্রকাশ করিবেন। ডাকযোগে আমার লেখার নমুনা পাঠাইলাম।

৪। আমি কয়েকমাস নবারুণ নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম। কাগজটির আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় সে কাজ ছাড়িয়া দিতে হয়।

৫। আমি পূর্ববঙ্গে সদ্বংশসম্ভূত। আমার পিতৃদেব অবসরপ্রাপ্ত সাবডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ডঃ সুধাংশুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পুণার মেটিওরলজিস্ট— তিনি কিছুকাল ভারতবর্ষ, ব্রহ্মদেশ ও সিংহলের আবহাওয়া বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল হইয়াছিলেন। তাহার পূর্বে কোনো বাঙালি এই পদ পাই নাই।

৬। আমি ৪/৫ বছর নানা পত্রিকার ঘনিষ্ঠ সংস্রবে থাকিয়াছি।

৭। প্রয়োজন হইলে আমি কলিকাতার বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির প্রশংসাপত্র উপস্থিত করিতে পারিব, যথা আচার্য শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র রায়, শ্রীযুক্ত নলিনীরঞ্জন সরকার।"

আরও পড়ুন- অনুবাদের আকাল, কালজয়ী বাংলা সাহিত‍্য পৌঁছতেই পারল না নোবেলের ধরাছোঁয়ায়

সাতখানা পয়েন্টে পর পর সাজানো বক্তব্য ইংরেজি নয়, বাংলায় লেখা৷ নজর কাড়ে মানিকের আত্মবিশ্বাস আর স্পষ্টচিন্তার প্রকাশ। অস্বস্তিকর প্রসঙ্গকেও সততার সঙ্গে কী অনায়াসে উল্লেখ করেছেন! তবে, এত অবধি দরখাস্তে 'মহত্ত্ব' বলে যদি কিছুই নেই। এই সাত দফা মন্তব্যে কোথাও সেই মানিক নেই যাকে বাঙালি পাঠক খুঁজে মরবেন। আছে এর অন্তিম অনুচ্ছেদে। মানিক তাঁর চাকরির দরখাস্তের অ্যাপ্লিকেশনের ইতি টেনেছেন এই বলে—

''পরিশেষে নিবেদন এই, আমি অবগত আছি শ্রীপরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাঁহার সম্বন্ধে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন। কারণ, শ্রীপরিমল গোস্বামী মহাশয়ের সহিত আমি প্রতিযোগিতা করিতে ইচ্ছুক নহি।''

এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। মানিক 'যুগান্তর' পত্রিকার পূজাসংখ্যায় লেখা জমা দিতে যাচ্ছেন। রাস্তায় বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। বিধ্বস্ত চেহারা দেখে দেবীপদ একপ্রকার জোর করেই বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। বন্ধুর মায়ের হাতের রান্না মানিক পেট পুরে খেলেন৷ তারপর একদিন সদর্পে 'আমি শুধু সাহিত্যিকই হব'— বলে ঘোষণা করা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেরনোর সময় দেবীপদর হাত ধরে অস্ফুটে বলে উঠলেন— ''দেখো দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।''

More Articles