জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ দিয়েই প্রতারণা! কীভাবে ফাঁস হলো UGC-NET প্রশ্নপত্র?

Telegram App UGC-NET: শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস না, প্রায় ৫০,০০০ টাকার বিনিময়ে 'ওএমআর শিট' সংশোধন করার টোপও দেওয়া হয়।

১৮ জুন ছিল UGC-NET। বিনীত পাণ্ডে দিল্লির এক শিক্ষক। মূলত ইংরেজি ভাষা পড়ান। সহকারী অধ্যাপক, পিএইচডি স্কলার এবং জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য ইউজিসি-নেটের প্রশিক্ষণ দেন পরীক্ষার্থীদের। পরীক্ষা হওয়ার ঠিক চার দিন আগে, ১৪ জুন বিনীত পাণ্ডে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি স্ক্রিনশট পান। ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে গিয়ে YouTube ব্যবহার করেন বিনীত। সেই স্টাডি মেটেরিয়াল গ্রুপে শেয়ার হয় ঠিকই। কিন্তু তাঁর পড়ুয়ারা যে স্ক্রিনশটগুলি দেখায় সেগুলি আসলে মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম-এ সাবস্ক্রাইব করা বিভিন্ন চ্যানেল থেকে পাওয়া। ওই বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেলে যারা সাবস্ক্রাইব করেছে তাঁদের দাবি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সেখানে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওই চ্যানেলগুলিতে তাড়াতাড়ি প্রশ্নপত্র কিনতে বলা হয় পড়ুয়াদের। একটি QR কোডও দেওয়া হয় যার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীরা টাকা পাঠাতে পারবেন।

এই স্ক্রিনশটগুলি দেখা মাত্র বিনীত পাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে একটি ইমেল করেন। মেলে বিস্তারিত লেখেন, ইউজিসি নেট পেপার-১ ফাঁস হচ্ছে। সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পাঠানো স্ক্রিনশট, ফোন নম্বর এবং QR কোডও জুড়ে দেন। তবে সেই মেলের কোনও সাড়া মেলেনি।

১৮ জুন পরীক্ষা হওয়ার পরেই কেন্দ্র সরকার ঘোষণা করে যে, পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে কারণ তা স্বচ্ছভাবে হয়নি। এর পরেই শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ঘোষণা করেন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র টেলিগ্রামে ফাঁস হয়েছে। টেলিগ্রাম অ্যাপে কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলো?

আরও পড়ুন- ২৪ জন কর্মী নিয়ে নিট-নেটের মতো পরীক্ষা পরিচালনা! NTA-এর ভয়াবহ গাফিলতি ফাঁস

চিকিৎসক এবং মধ্যপ্রদেশের রাইট-টু-ইনফরমেশন কর্মী বিবেক পাণ্ডে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে NEET মেডিকেল এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিয়ে কাজ করছেন৷ স্ক্রোল ডট ইন-কে তিনি বলছেন, প্রশ্নপত্র আগেও ফাঁস হয়েছে। তবে এত বড় পরিসরে কখনও ঘটেনি এবং এই প্রথম টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাজটা করার চেষ্টা হয়েছে। যারা দেশের কোচিং এবং পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন, মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ব্যাপকভাবে প্রচার করে।

টেলিগ্রাম চালু হয় ২০১৩ সালে। ভারতীয় পরীক্ষা-কোচিং কোম্পানিগুলি ব্যাপকভাবে এই অ্যাপটি পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করতে থাকে। ২০২০-র শেষের দিকে এবং ২০২১-এর শুরুতে টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী বাড়ে৷ একটি সূত্র বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপগুলির মধ্যে নবম স্থানে ছিল এই অ্যাপ। জানুয়ারিতেই সর্বাধিক ডাউনলোড করা অ্যাপ হয়ে ওঠে টেলিগ্রাম৷ ৬৩ মিলিয়নেরও বেশি ডাউনলোডের ২৪% ছিল ভারতেই, অন্য যেকোনও দেশের চেয়ে ঢের বেশি। কোভিড-১৯ মহামারী পর্বে যখন দেশে অনলাইন শিক্ষা শুরু হয় ভারতে এই অ্যাপের ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়।

দিল্লির এক NEET পরীক্ষার্থী সোনাল চৌধুরী ২০২১ সালে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে টেলিগ্রাম অ্যাপ ব্যবহার শুরু করেন। কোভিড মহামারীকালে লকডাউন চলাকালীন তিনি অ্যাপটি ব্যবহার শুরু করেন। টেলিগ্রামে সব কিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অনলাইন কোচিং প্ল্যাটফর্মগুলি প্রত্যেকের জন্য লাইভ ক্লাস, রেকর্ডিং, নানা নোটস আপলোড করে। সেগুলি পড়ুয়াদের কাজে আসে। শুধু নিট বা নেট নয়, সিভিল সার্ভিসের অনেক দামী বই, বা স্টাডি মেটেরিয়াল যা সহজে মেলে না তা টেলিগ্রামে নানা চ্যানেলে বিনামূল্যে মেলে।

আরও পড়ুন- কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাতিল UGC-NET! যে ভয়াবহ শিক্ষা দুর্নীতির ইঙ্গিত দিচ্ছে মোদি ৩.০

এমনই এক পরীক্ষার্থী আকাশ পাওয়ার বলছেন, টেলিগ্রামে নিজের নাম বা ফোন নম্বরও প্রকাশ করতে হয় না। টেলিগ্রামে 'সিক্রেট চ্যাট' সম্ভব, চ্যাটের হিস্ট্রি মুছে ফেলা সহজ। আসলে এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়েই বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি ছাত্রছাত্রীদের প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করছে। মোটা টাকায় প্রশ্নপত্র কিনতে বাধ্য করেছে। হোয়াটসঅ্যাপে কাজটা কঠিন। টেলিগ্রামের মাধ্যমে কারও আইপি অ্যাড্রেস বা নম্বর খুঁজে পাওয়া সাইবার সেলের কাছেও কঠিন। হোয়াটসঅ্যাপের কোনও গ্রুপে এত লোকও থাকতে পারে না, সর্বোচ্চ ১০২৪ জন সম্ভব। টেলিগ্রামে একটি গ্রুপে ২ লাখ সদস্য জুড়তে পারেন। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা কিছু চ্যানেলের গ্রুপে এক লাখেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে, যে কারণে এত দ্রুত প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস না, প্রায় ৫০,০০০ টাকার বিনিময়ে 'ওএমআর শিট' সংশোধন করার টোপও দেওয়া হয়। বহু পরীক্ষার্থীকে এভাবে টাকা নষ্ট করেছে। টাকা পাঠানোর পরেই ওই অ্যাকাউন্টটি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। বিনীত পাণ্ডে তো ইমেল করেছিলেন। ইউজিসি কর্ণপাতও করেনি। পরীক্ষা বাতিলের পর সরকার এখনও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে বিশদ জানায়নি। পরীক্ষা আর হবে কিনা তাও জানায়নি। পরীক্ষা হলে আবার টাকা দিয়ে ফর্ম পূরণ করতে হবে কিনা তাও জানা নেই। দেশের সাইবার সেল, আইটি সেলও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ইমেল না দেখা বা অসতর্ক থেকে কি আসলে দুর্নীতির চক্রকেই জায়গা করে দেওয়া হলো না? রাজ্যের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও কি মৃত্যুর পথে?

More Articles