গালিবকে শূন্য হাতেই ফিরিয়েছিল পুরোনো কলকাতা, কেমন ছিল সেই শহর

কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় পথ হাঁটছেন এক নিঃসঙ্গ কবি। চোখে ভরে দেখছেন তিলোত্তমা কলকাতাকে। কোলাহল মুখর কলকাতার সেই ছবি তিনি ধরে রাখছেন তাঁর শায়েরমালা 'সফর-এ- কলকাত্তাহ'-তে। হেদুয়া শহর কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা। তার উল্টো পারেই বেথুন কলেজ। ঠিক তার পিছনদিকে যে রাস্তা ঘুরে গিয়ে মিশেছে রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে সেই জায়গাটিরই তখন স্থানীয় পরিচিতি শিমলে বাজার নামে। ওই রাস্তার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক মহামহিম কবির করুণ নিঃসঙ্গ কাহিনি। নাম, মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান। গোটা দুনিয়া অবশ্য চেনে মির্জা গালিব নামে। বর্তমানের বেথুন রো-র ১৩৩ নম্বর হাভেলিতে উঠেছিলেন মির্জা গালিব। মাত্র ১৮ মাস কলকাতায় ছিলেন গালিব। কেমন কেটেছে সেই দেড়টা বছর?

১৮২৮ সাল। দিল্লি থেকে কলকাতায় আসছেন গালিব। কখনও পায়ে হেঁটে কখনও বা ঘোড়ায় চড়ে আবার কখনও বজরা বা নৌকায়। তাঁর অভিপ্রায়,  ইংরেজ বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ। কারণ ততদিনে মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত। দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গেও ইংরেজদের সম্পর্ক ভালো নয়। কিন্তু বাদশা গুণী মানুষের কদর করতেন। তাঁর সভা আলো করে থাকতেন গালিব। কিন্তু একসময় ইংরেজদের সন্দেহের তালিকায় উঠে এল তাঁর নাম। বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে বন্ধ হল তাঁর পেনশন। কিছুই করতে পারলেন না দিল্লির বাদশা তাঁর প্রিয় কবির জন্যে। কারণ তিনিও ততদিনে ইংরেজ সরকারেরই আরেক পেনশনভোগীতে পরিণত হয়েছেন। গালিব পড়লেন চূড়ান্ত অর্থকষ্টে। পেনশনের বিষয়ে কথা বলতেই গালিবের কলকাতাযাত্রা।

তখন কলকাতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর। বড়োলাট হলেন লর্ড আমহার্স্ট। গালিবের পিতামহ ছিলেন সইনিক।গালিবের বাবা চাকরি করতেন লখনউ এর নবাব আসফ-উদ- দুল্লার দরবারে। পাঁচ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর গালিবের পরিবারের দায়িত্ব নেন কাকা নাসরুল্লাহ বেগ। তাঁর মৃত্যুর পর গালিবের পরিবারের জন্য সরকার দশ হাজার টাকার ভাতার ব্যবস্থা করে যদি ও পরে তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে।

কেমন ছিল পুরনো কলকাতা? সফর-এ-কলকাত্তাহ তে বিষদে কলকাতার বর্ণনা করছেন গালিব। তাঁর বিখ্যাত আলফাজে লিখছেন, “কলকাত্তেকা জো জিকর কিয়া তুনে হম নশি/এক তীর মেরে সিনে মে মারা কে হায় হায়!” কলকাতা তাঁর মন জয় করে নিয়েছে ততদিনে। তাঁর লেখায় গালিব উল্লেখ করছেন এক বিরাট গোল তালাও এর কথা। আজকের মানচিত্র মেলালে দেখা যাবে সেই বিরাট তালাই হল হেদুয়ার পুকুরটি যার আজকের নাম আজাদ-হিন্দ-বাগ। গালিবের লেখায় উঠে আসে কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন রাস্তা চিতপুরের কথাও।

শুধু কলকাতার বিবরণ নয়, কলকাতার কাব্যসমাজের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন গালিব।কলকাতার তৎকালীন কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন গালিব। যদিও সেই আলাপ গালিবকে খুব খুশি করেনি।এক তর্ক সভায় গালিব উর্দু ও ফার্সি ভাষায় কিছু শায়রি পাঠ করেন।সেখানে একটি শায়রি নিয়েই তর্ক শুরু হয় গালিব ও মির্জা কাতিলের শিষ্যদের মধ্যে।হাফিজের কবিতার অনুষঙ্গ টেনে গালিব সেদিন বোঝাতে চেয়েছিলেন তাঁর শায়রি ব্যাকরণের নিয়ম ভাঙেনি। আঘাত পেয়েছিলেন গালিব। তাও অকুণ্ঠ চিত্তে কলকাতার জয়গান করেছেন মহাকবি। গালিবের কথায় কলকাতার মত মন জয় করা জমিন তামাম দুনিয়ায় নেই।

কলকাতার মানুষও আপন করে নিয়েছিলেন কবিকে। শিমলেপাড়ার মানুষ তাঁকে ডাকতেন বাবা বলে।কলকাতার তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল গালিবের। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বিশেষ সখ্য।মিত্র বাড়িতে আজ ও সযত্নে রক্ষিত হয়েছে গালিব-রাজেন্দ্রলালের বন্ধুত্বের স্মৃতি।

যদি ও কলকাতা গালিবকে খালি হাতেই ফিরিয়েছিল। পেনশন তো দূরে থাক, দেখা মেলেনি বড়লাটের। হতভাগ্য মনে গালিব ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লি। কিন্তু তাঁর শায়েরমালা আজও পুরনো কলকাতার সেই গল্প বুকে ধরে রেখেছে পরম মমতায়।  

More Articles