RSS-এর কৌশল! যে ছকে বারবার মুসলিম ভোট ঘরে আনতে চেয়েছে বিজেপি
Modi Government: গুজরাট হিংসায় মুসলিমের রক্ত লেগে রয়েছে যে নরেন্দ্র মোদির হাতে, সেই মোদিই নিজেকে একজন মুসলমান সমাজের সংস্কারক হিসেবে তুলে ধরার রাজনৈতিক খেলায় মেতে রয়েছেন।
আরএসএসের কিছু রাজনৈতিক চালকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পেরে একটা বড় অংশের সংবাদ মাধ্যম, প্রধানমন্ত্রী মোদির দ্বিতীয় দফায় এমন একটা প্রচার চালাতে শুরু করেছিল, যেন হিন্দুত্ববাদী শিবির তাদের চিরাচরিত মুসলিম বিদ্বেষের পথ থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। মোদির দ্বিতীয় দফায়, ২০২২ সালে হায়দরাবাদে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির কর্মসমিতির একটি বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে দলীয় মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ মোদির এই বক্তব্যকে তাঁর এক ধরনের রাজনৈতিক চারিত্রিক বদল বলে অভিহিত করে। আজন্মলালিত ভয়ংকর মুসলিম-বিদ্বেষের পথ থেকে সরে আসছেন মোদি, এমনই একটা বার্তা দিতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদমাধ্যমের সেই অংশের মাধ্যমে গোটা দেশবাসীর কাছে প্রচার হতে শুরু করে সেই তত্ত্ব। ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, সর্বোপরি ধর্ম আর জাতপাতের পাশা খেলার ওস্তাদ কারিগর হিসাবে মোদির যে পরিচিতি, সেই পরিচিতিটাকে মুছে ফেলে, তাঁর একটা নতুন ধরনের উদার, সম্প্রীতির পক্ষে থাকা রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণে আরএসএসের যে ছকে দেওয়া পরিকল্পনা, এই পরিকল্পনার সঙ্গে একটা বড় অংশের গদি মিডিয়া, নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলে।
আরএসএস যখন এই পরিকল্পনাটা আঁটে, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোট তখন দরজায়। যোগী আদিত্যনাথকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরানোটা সেসময় তাদের কাছে বিশেষ জরুরি। সেই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর বিতর্কিত রাম মন্দির তৈরির কাজে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির আদা-জল খেয়ে নেমে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সম্বল করে ভারতের সংবিধান এবং ইসলামীয় আইনের যাবতীয় পরিকাঠামোকে অস্বীকার করে এই কাজ করে। যে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার উপর ভর করে বিজেপি তার রাজনৈতিক ভিত্তি,আইনসভার আসন সংখ্যার বাড়বাড়ন্ত ঘটাচ্ছে, সেটাই যেন নতুন জায়গা পেল।
আরও পড়ুন: ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাসে কটূক্তিতে সেরা মোদিই! উত্তরসূরিকে নিয়ে যা বললেন মনমোহন
মোদি দ্বিতীয়বার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হিন্দুত্ববাদী শিবিরের হাত ধরে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা পরিণত হল সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে। এই ট্রান্সফরমেশন স্বাভাবিকভাবেই গোটা দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। কিন্তু তেমন ভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠল না তাদের দিক থেকে। হয়তো বা পারলেন না তাঁরা। প্রশাসনকে কব্জা করে পরিস্থিতিকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করাল হিন্দুত্ববাদী শক্তি যে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হল— বিতর্কিত মন্দির নির্মাণের প্রতিবাদ করা প্রকারান্তরে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের বিরোধিতা। একমাত্র বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি মৃদুমন্দ প্রতিবাদ করলেন। তার বাইরে ভোট-রাজনীতিকে মাথায় রেখে অন্য কোনো অ-বিজেপি রাজনৈতিক দল দেশের সহ-নাগরিক মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অধিকার, যেটি কিনা ভারতের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত, তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার প্রতিবাদে সোচ্চার হতেও ভুলে গেলেন।
ভারতের মুসলিম সমাজকে ঘিরে আরএসএসের এই যে রাজনৈতিক অবস্থান, সেটাকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, এবং মোদির আমল থেকেই তার এর নতুন কৌশল শুরু হয়। গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি এই কাজে আত্মনিয়োগ করে। 'মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ' নামক আরএসএসের যে শাখা সংগঠনটি কাজ করে, সেই সংগঠনের একটা বড় অংশের নেতা,কর্মী জন্মসূত্রে মুসলিম নয়। একেবারে আরএসএসের চরম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক যে কিনা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাকেই মুসলিমের ছদ্মবেশে মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চে নিয়োগ করেছে আরএসএস। এই সংগঠনে একজনও মুসলিম নেই এমনটা নয়। কিন্তু সংগঠনটি কর্মীদের বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে আরএসএসের সমস্ত ধরনের প্রশিক্ষণ (যার মধ্যে সামরিক আদলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও রয়েছে) পাওয়া জন্মসূত্রে হিন্দু লোকজন।
এই সংগঠনের মাধ্যমেই মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর একটা মুসলিমপ্রেমী ভাবমূর্তি মুসলিম সমাজের মধ্যে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে আরএসএস। গুজরাত গণহত্যার সময়ে মোদির যে ভয়াবহ মুসলিম-বিরোধী ভূমিকা, কর্মকাণ্ড— সেগুলিকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য একদিকে আরএসএস সামাজিক প্রযুক্তি চালাচ্ছে। তার একটি পথ হল, মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, যাঁদের সাধারণভাবে পাসমন্দা অর্থাৎ অনগ্রসর মুসলিম বলা হয়, তাঁদের কাছে মোদি নিজেকে মুসলিম সমাজ জীবনের সংস্কারক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। গোটা ভারতে এই সময়ে একমাত্র ফ্রন্টলাইন পত্রিকাই অনগ্রসর মুসলিমদের ঘিরে যথার্থ আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছিল।
সেই অংশের মুসলিমদের উন্নতির জন্য, বিশেষত তাঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকারের নাকি রাতের ঘুম উড়েছে— এমন একটি মিথ্যে প্রচারের মধ্যে দিয়ে মুসলিম সমাজে নরেন্দ্র মোদির ভয়াবহ হিংসাত্মক মুসলিম-বিরোধী রূপটাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হল। চেষ্টা করা হল তাঁর একটা লিবারেল ইমেজ তৈরি করার, যার জন্য নতুন ধরনের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রক্রিয়া গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির শুরু করে দেয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে একদিকে ভয়, অন্যদিকে বিভ্রান্তিকর পরিবেশকে তারা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিল, যে বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা, সেই সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অবলম্বন করে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরে বিতর্কিত মন্দির নির্মাণ, মসজিদ স্থানান্তর (যা কিনা ইসলামদের রীতিনীতি কোনো ভাবেই অনুমোদন করে না), এই সমস্ত ঘটনাতেই চুপ করে রইল মুসলিম সমাজ। তবে তা সমর্থন ছিল না কিন্তু কোনও মতেই। আসলে একটা ভয়ংকর ভয়, নিরাপত্তাহীনতা,নিজেদের জানমাল টিকিয়ে রাখবার তাগিদ— তাঁদেরকে চুপ করে থাকতে বাধ্য করল।
আর সে সময় মুসলিম সমাজের এই চুপ করে থাকাটাকে বিজেপি সরকার বা তাদের মস্তিষ্ক আরএসএস-সহ তাদের নানা ধরনের শাখা সংগঠন এমন ভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার করল, যাতে মনে হয় এই সমস্ত ঘটনাসমূহকেই ভারতের মুসলিম সমাজ সমর্থন করছে। কিন্তু তার স্বপক্ষে আজ পর্যন্ত কোনওরকম ক্ষেত্রসমীক্ষা তারা হাজির করতে পারেনি। দ্বিতীয় দফায় মোদি ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির একটা অংশের নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে মুসলিম সমাজের কিছু কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নানা ধরনের বৈঠক হয়। যদিও সেই সব বৈঠকের প্রভাব মুসলিম সমাজের উপরে তেমন পড়ে না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মিডিয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপি এমন একটা প্রচার চালাতে শুরু করে, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয় যে মুসলিম সমাজ ঘিরে বিজেপি অতীতে যে চরম নেতিবাচক অবস্থান বা মানসিকতা নিয়ে চলত, সেখানে বোধহয় বরফ গলতে শুরু করেছে। বিজেপি তাদের অতীতের অবস্থান থেকে ধীরগতিতে হলেও সরে আসতে শুরু করেছে। যার ফলে মুসলিম সমাজও বিজেপিকে ঘিরে যে ভয়ংকর শক্ত অবস্থানে থাকত, সেটাও সরতে শুরু করে।
এই গোটা কাজটি হিন্দুত্ববাদী শিবির করেছিল উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনকে (২০২২) সামনে রেখে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কিন্তু ২০২২ সালে হায়দরাবাদে বিজেপির দলীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মুসলিম সমাজ সম্পর্কে নতুন চিত্রনাট্য অনুযায়ী প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দুর্দান্ত অভিনয় মোদির। হিন্দুত্ববাদী শিবিরের গবেষণার জন্য যে নিজস্ব টিম রয়েছে,তার মাধ্যমেই বিজেপি বুঝতে পেরেছিল, মুসলিম সমাজ নানা আর্থ-সামাজিক কারণে এখন এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে,বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও শব্দ উচ্চারণ করবার মতো মানসিক অবস্থায় নেই তাঁরা।
মনে রাখা দরকার তার কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে দিল্লি গণহত্যা। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়েছে, তার স্মৃতি তখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে টাটকা। গুজরাট গণহত্যার থেকেও হিংসাত্মক অথচ ঠান্ডা মাথার অত্যাচার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির ঘটাল মুসলিম সমাজের উপর। যার ফলে মুসলিম সমাজকে আরও নতুনভাবে বিভ্রান্ত করতে শুরু করল হিন্দুত্ববাদী শক্তি। আর সেই বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবেই মুসলিম সমাজের সবথেকে পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নয়নের জন্য তারা একটা আলংকারিক কৌশল অবলম্বন করল।
এরই মাঝে মুসলিম সমাজে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ঘিরে নতুন করে একটা রাজনীতি শুরু করে দিল হিন্দুত্ববাদী শিবির। মুসলিম সমাজের ভিতরে আধুনিক শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি প্রসার যে জায়গায় পৌঁছেছে,তাতে তাঁদের সমাজের অভিজাত অংশের মধ্যে তো বটেই, একেবারে গরিব, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ সেভাবে না পাওয়া অংশের মুসলিমদের মধ্যেও এখন সচেতনতা জায়গাটা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে, যার ফলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রায় অবলুপ্ত। এই জায়গাটিকেই নিজেদের মুসলিম সমাজের সংস্কারক হিসেবে চিহ্নিত করলেন হিন্দুত্ববাদী শিবির।
গুজরাট হিংসায় মুসলিমের রক্ত লেগে রয়েছে যে নরেন্দ্র মোদির হাতে, সেই মোদিই নিজেকে একজন মুসলিম সমাজের সংস্কারক হিসেবে তুলে ধরার রাজনৈতিক খেলায় মেতে রয়েছেন। কার্যত মুসলিম সমাজে, বিশেষত মুসলিম মহিলাদের মধ্যে এমন একটা ভাবধারা তৈরি করার চেষ্টা চলছে,যেন তাঁদের জীবনে একটা আলোকবর্তিকা নিয়ে আসছেন নরেন্দ্র মোদি। এই যে কৌশলটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল, মুসলিম সমাজ কিন্তু সেই কৌশলে আদৌ বিভ্রান্ত হয়নি। তাঁরা কিন্তু নরেন্দ্র মোদির মুখ আর মুখোশ খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন। উচ্চবিত্তের, মধ্যবিত্তের সামাজিক পরিকাঠামোর মধ্যে থাকা মুসলিম সমাজ কিন্তু শুরুতেই বোঝেন এ আসলে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের চালাকি। বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পরবর্তী সময় থেকে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়েছে, তা বুঝতে মুসলিমদের অসুবিধা হয় না। কোর্টের রায়কে সম্বল করে, মসজিদের জমি আত্মসাতের পর থেকে গরীব,অর্থনৈতিক,সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে তাঁদের ঘরের মা-বোনেরা ভালো মতোই বুঝে গিয়েছে; কী ধরনের রাজনৈতিক প্রতারণা নরেন্দ্র মোদি বা গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির তাঁদের সঙ্গে করছে। গোটা দেশে আঠারো থেকে কুড়ি কোটি অনগ্রসর (ওবিসি) মুসলিম আছেন, যাঁদের অবস্থা অর্থনৈতিকভাবে,সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত করুণ। গুজরাট গণহত্যার পরবর্তী সময়ে দু'টি ইউপিএ সরকারের শাসনকালে আরএসএস কেন্দ্রে একক বলিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপিকে ফেরাতে, মুসলিম সমাজের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের আচার-আচরণের ক্ষেত্রে একটা অদলবদল আনতে শুরু করে।
অটল বিহারী বাজপেয়ী এনডিএ নামক নীতিবিহীন,সুবিধাবাদী জোটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার টিকিয়ে রাখলেও, হিন্দুত্ববাদী শিবির নিয়েছিল সরাসরি মুসলিম হত্যা-রাজনীতির পথ। পাশাপাশি দু'টি ইউপিএ সরকারের আমলে সেই হত্যার রাজনীতিকে একটু হলেও আড়াল করার পথে হাঁটতে শুরু করে আরএসএস। মুসলিম সমাজ সম্পর্কে তাদের তখন প্রথম এবং প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের সরাসরি হত্যা না করে,কীভাবে তাঁদের ভাতে মারা যায় সেই কৌশলের প্রয়োগ আমরা খুব বেশি ভাবে দেখতে পেয়েছি নরেন্দ্র মোদির প্রথম দফায়। কইরানার ঘটনা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি শেখ আখলাখকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি কীভাবে মব লিঞ্চিং হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে সব অংশের মুসলিম যাতে একটা ভয়ের সাম্রাজ্যের নাগরিক হয়ে ওঠে,সেটাই হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুত্ববাদীদের একমাত্র টার্গেট।
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার বিগত নির্বাচনে সেই রাজ্যের মুসলিম সমাজের একটা অংশের ভোট বিজেপির বাক্সে পড়েছে এটা বাস্তব। কিন্তু সেই বাস্তবতার ভিত্তি কী? কেন মুসলিম সমাজের একটা অংশ, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েরা সেই বিজেপিকেই ভোট দিলেন, যারা কিনা আদর্শগতভাবে এবং প্রয়োগগতভাবে চরম মুসলিম বিরোধী? এই প্রশ্নটা কিন্তু কখনও কোনও সংবাদমাধ্যমের তরফে তোলা হয়নি। সমাজ বিজ্ঞানীদের একটি অংশ সেই প্রশ্ন তুললেও, গোটা বিষয়টির মধ্যে যে ভয়ের, সন্ত্রাসের রাজত্ব — ক্ষমতায় আসার আগেই গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে বিজেপি ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল (যোগীর নামাঙ্কিত ঠ্যাঙারে বাহিনীকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়), সেটি কিন্তু একবারও আলোচনায় উঠে আসেনি। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন কিন্তু দিল্লি -উত্তরপ্রদেশলাগোয়া মুজফফরনগরে দাঙ্গা ঘটিয়ে, গোটা দেশে মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র করে, তার ফসল হিসেবেই বিজেপি একক শক্তিতে সরকার গড়ার বিষয়টিকে পাকা করেছিল। তারপরে অল্প কিছু সময় উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ সিং যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির সরকার থাকলেও,সেই সময়ে মুলায়ম সিংয়ের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক সমীকরণ একটা ধোঁয়াশাপূর্ণ জায়গা তৈরি করে। বিশেষ করে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে একাধিক জায়গায় যেভাবে অন্তরঙ্গ স্তরে মুলায়মের কথা বলার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল,তার প্রেক্ষিতে এটা অনুমান করা যায় যে, নামকাওয়াস্তে সমাজবাদী পার্টির সরকার তখন ক্ষমতায় থাকলেও, ভয়ের রাজত্বটাকে এমন ভাবে উত্তরপ্রদেশ জুড়ে কায়েম করা হয়েছিল, যার জেরে মুসলিম সমাজ উত্তরপ্রদেশে নিজেদের নাগরিক অধিকারগুলি আদায় করবার প্রশ্নেই তখন ক্রমশ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়তে শুরু করে।
মোদির নির্বাচন কেন্দ্র বেনারসের উন্নয়ন, বিশেষ করে বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন এলাকার উন্নয়নের নাম করে যেভাবে ছোট ছোট দোকানদারদের গণহারে উচ্ছেদ করা হয়, তাঁদের মধ্যে কেউ নানা রকমের মনিহারি জিনিস বিক্রি করতেন তো কেউ জামাকাপড়। তাঁদের মধ্যে যারা জন্মসূত্রে মুসলিম তাদের উপর নামে বেশি কোপ। দ্বিতীয় দফায় যোগী আদিত্যনাথ যখন বিধানসভার ভোটের সামনে দাঁড়িয়ে, সে সময় উত্তরপ্রদেশ-সহ গোবলয়ের মুসলিম সমাজের মধ্যে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক এবং ত্রাসের ভূগোল সংক্রমিত করে দিতে পেরেছিল হিন্দুত্ববাদী শিবির। রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকার যেভাবে ঠান্ডা মাথায় মুসলিম সমাজের জানমালের নিরাপত্তাকে বড় রকম প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, তাতে মুসলিম সমাজ নিজেদের মর্জিতে ভোট দিতে পারেনি। কারণ ছিল ভয়। ভোটের ফল বিজেপির বিরুদ্ধে গেলে পরিস্থিতি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার আভাস দিয়ে রেখেছিল বিজেপি গোড়াতেই। অথচ সংবাদ মাধ্যম কিন্তু প্রচার করে গেছে, মোদী পাল্টে গিয়েছেন। অর্থাৎ যে মোদী একটা সময় চরম মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন,সেই মোদির মধ্যেই মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য নতুন চিন্তা ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে সেই সমাজের মেয়েরা এখন দু'হাত ভরে ভোট দিচ্ছে বিজেপিকে ।
বিজেপির উত্তরপ্রদেশের বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিমদের ভোট পাওয়ার আসল রহস্যটি যে কি ছিল তা নিয়ে কিন্তু খুব কম সংবাদপত্রেই লেখালেখি হয়েছে। গোটা উত্তর প্রদেশ জুড়ে স্বঘোষিত 'যোগী' আদিত্যনাথকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে, মুসলিম সমাজের উপর যে ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। তাদের জানে না মেরে, ভাতে মারবার যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চালানো হয়েছিল,তার জেরেই ভোটবাক্স ভরেছিল বিজেপির। শ্রদ্ধায় নয়, ভক্তিতে নয়, শুধুমাত্র পিতৃদত্ত প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগারের তাগিদে, মুসলিম সম্প্রদায়, বিশেষ করে সেই সমাজের মেয়েরা বাধ্য হয়েছিল বিজেপিকে ভোট দিতে। কোনও রকম রাজনৈতিক আস্থা থেকে কখনও মুসলিম সমাজ উত্তরপ্রদেশে মৌলবাদী শক্তি বিজেপিকে ভোট দেয়নি। গত কয়েক বছরে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথকে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য কী ধরনের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে, তা নিয়ে গদি মিডিয়া কখনও কিছু লেখেনি। কখনও কখনও তো এমন ভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপিত করা হয়েছে যে, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরেরা যেভাবে হিন্দু সমাজের সংস্কার ঘটিয়েছিলেন, ঠিক সেই ভাবেই নিজে হিন্দু হয়েও মুসলিম সমাজের সংস্কার ঘটাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। স্যার সৈয়দ আহমেদ থেকে শুরু করে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ,তাঁরা যেন মুসলিম সমাজের জন্য কিছুই করেননি! মুসলিম সমাজের আর্থসামাজিক উন্নতির সোপান তৈরি করে দেওয়ার কাজটি স্বাধীনতার এই এত বছর পরে করছেন একমাত্র নরেন্দ্র মোদি। আর তা হচ্ছে বিজেপি দলটির কর্ম তৎপরতায়।
আরও পড়ুন:আরএসএস, বিজেপি নেতা, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে ৬২% সৈনিক স্কুল তুলে দিল বিজেপি!
হিন্দুত্ববাদী শক্তি গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়েই যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেই হিন্দুত্ববাদীরাই আর সমসাময়িকতার চাপে তা বজায় রাখতে পারছে না। মুসলিম সমাজকে হিন্দি বলয় জুড়ে আর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যাচ্ছে না। NRC, CAA ইত্যাদির দাপটে যেভাবে সহ-নাগরিক মুসলিমদের স্বদেশে পরবাসী করে রাখবার আইনি তোড়জোড় শুরু হয়েছে,তার ফলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়েপ আর পড়ে পড়ে মার খাবার জায়গায় নেই। প্রতিবাদকে তাঁরা প্রতিরোধের আগুনে সেঁকে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। রাজনৈতিক হিন্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে অন্যান্য অ-বিজেপি, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে নিয়ে কংগ্রেস যেভাবে অগ্রসর হতে শুরু করেছে, তাতে রাজনীতির একটি নতুন সমীকরণের ছবি উঠে আসছে। আর এই ছবি যত স্পষ্ট হচ্ছে, ততই কিন্তু গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির বুঝতে পারছে, এবার আর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার গত নির্বাচনের মত ভয় দেখিয়ে,ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, একদিকে ভোট লুট, আর একদিকে অদৃশ্য বেয়নটের জোরে মুসলিম ভোটকে আর হিন্দুত্ববাদীদের ঝুলিতে ফেলা যাবে না। সেই কারণেই মুসলিম সমাজের সংস্কারকের ভেক ছেড়ে ফেলে নরেন্দ্র মোদী আবার নিজের পথেই ফিরে এসেছেন। গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির আবার নিজের পথেই ফিরে এসেছে। আবার তারা বিভাজনের রাজনীতিকে সেই আগের মত চড়া সুরে ভোটের আসরে নামিয়ে এনেছে। সাধারণ নাগরিকদের ভোটকে হিন্দু ভোট আর মুসলিম ভোটে, কালনিমির লঙ্কা ভাগের মত ভাগ করে নিয়ে চাইছে ভোটদরিয়া পেরোতে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)