"সিনেমা না হলে গান্ধিকে কেউ চিনত না"! মোদিকে কেন এর পরেও ছুড়ে ফেলবে না মানুষ?

Narendra Modi: আমরা দেখতে ভুলে যাই, নরেন্দ্র মোদির আশেপাশে যাঁরা ঘুরছেন, তাঁদের বেশিরভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা মহিলাদের যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত।

নরেন্দ্র মোদি কলকাতায় এলেন। প্রচার করা হলো, বাঙালির মনে নাকি মোদি বিরাজ করছেন। তারপর তিনি একটি মূলধারার গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন। বেশিরভাগ বাঙালি কাছে পৌঁছে গেল সেই আগে থেকে তৈরি করে রাখা প্রশ্নোত্তর। শুনলেন যারা হয়তো বা কেউ কেউ বিশ্বাসও করলেন সেই মিথ্যে ভাষণ। অনেকেই মনে করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছেন, তাহলে তিনি নিশ্চিত একজন সৎ মানুষ। সেই মানুষেরা অবলীলায় ভুলে গেলেন, এখনকার যিনি বাংলার বিরোধী দলনেতা, সেই শুভেন্দু অধিকারী চার বছর আগেও বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির মাপকাঠিতে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাই ছিলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রীও জানেন, মানুষের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিতে তাঁর একের পর এক বলে যাওয়া মিথ্যে কথা ধরা থাকে না। কোনও সংবাদমাধ্যমেরই এতটুকু সাহস নেই, তৈরি করা প্রশ্নের বাইরে তাঁকে কোনও প্রশ্ন করার। তাই তিনি কখনও অর্ধসত্য, কখনো ডাহা মিথ্যে বলে পার পেয়ে যান। তিনি জানেন, বিচারব্যবস্থা তাঁর কিংবা তাঁর দলের বিরুদ্ধে খুব বেশি কঠোর হবে না। অথচ বিরোধীরা বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চাইছে বলে অভিযোগ করে যান তিনি এবং কেউ তাঁর বিরোধিতা করে না।

অনেকেই বলেন, গত দশ বছরে ভারতের বেশ কিছু স্বশাসিত সংস্থার মাথায় বসানো হয়েছে বেশ কিছু বিজেপি কিংবা আরএসএসের নেতাকেই, তা সে নির্বাচন কমিশন হোক বা ভারতের বিচারব্যবস্থা। তাঁদের মত, সংবিধান না বদল করেই ভেতর থেকে যদি এই সংস্থাগুলোর মাথায়, নিজেদের পছন্দমতো মানুষদের বসানো যায়, তাহলে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নরেন্দ্র মোদিও তা বিলক্ষণ জানেন বলেই, বিভিন্ন উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে তিনি এবং তাঁর দল রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কাজ করে। এই ঘটনা বিশেষ করে ঘটেছে বাংলার ক্ষেত্রে। প্রাথমিকভাবে গত কয়েকবছরে, বাংলার তৃণমূল সরকারের নানান কর্মকাণ্ড নিয়ে মামলা করানোর কাজ যে সচেতনভাবে করানো হয়েছে, তা অনেকেরই জানা। কখনও শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, কখনও ইমামভাতা সংক্রান্ত বিতর্ক, আবার কখনও অনগ্রসর বা অতি অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের প্রশ্নে মামলা হয়েছে। নানা সময়েই দেখা গেছে, এই মামলাগুলো করেছে বিজেপি এবং আরএসএসের মদতপুষ্ট কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন। তারপরে সেই মামলার শুনানি চলাকালীন গণমাধ্যমের সাহায্যে সমাজে এই বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করানো হয়েছে যাতে মানুষের মনে বাংলার নির্বাচিত সরকার এবং তাঁদের তৈরি নীতির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়। তারপরে এমন রায় দেওয়া হয়েছে যাতে কখনও সরকারি নীতি বাতিল হয় আবার কখনও শিক্ষামন্ত্রী এবং তাঁর আশেপাশে দায়িত্বশীল পদে থাকা মানুষকে জেলে যেতে হয়।

আরও পড়ুন- কাঁটা উপড়ে ফেলতে দক্ষ মোদি! ক্ষমতায় আসতে কাকে কাকে পথ থেকে সরিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি?

তাহলে কি তৃণমূল দল এবং সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত নয়? যে বিপুল বিপুল টাকা উদ্ধার হয়েছে, মানুষই তার সাক্ষী। তবে এও সত্য যে মাঝে মাঝেই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে বিচারপতিরা পক্ষপাত করেছেন। যে বিচারপতি শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত রায় দিয়েছিলেন, তিনিই যখন সময়ের আগে অবসর নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে প্রার্থী হন, তখন এমন সন্দেহ অমূলক নয়। বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাস, যখন ভরা এজলাসে বসে তাঁর অবসর গ্রহণের দিন বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে আরএসএস করেছেন এবং অবসরের পরে আবার আরএসএসে ফিরে যেতে চান, তখন প্রশ্ন জাগে আদালতের এই বিচারপতিদের খুব সচেতনভাবেই বসানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে রাজশেখর মান্থা, অমৃতা সিনহার মতো বিচারপতিরা বিজেপির নেতা মন্ত্রীদের রক্ষাকবচও দেন, যাতে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত না হয়। বিজেপি নেতাদের গ্রেফতারিতে স্থগিতাদেশও দেন। বিচারব্যবস্থা কিছুটা হলেও পক্ষপাতদুষ্ট, মনে হয় না কি?

নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি কীভাবে এই রায়গুলো ধরে রাজনৈতিক ফায়দা লোটে? এই দশ বছরে, দেশের বেশ কিছু আদালত কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধেও রায় দিয়েছে। গুজরাত দাঙ্গার সময়ে ধর্ষিতা এবং অত্যাচারিত হওয়া বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্তি দেওয়া প্রসঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নাগরত্নার কাছে তিরস্কৃত হয় বিজেপি এবং তাদের আবার জেলে যেতে হয়। গুজরাতের মরবি ব্রিজের দুর্ঘটনার জন্য নির্মাণকারী সংস্থার জবাবদিহি চাওয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের গ্রেফতারিকেই বেআইনি বলে, নির্বাচনী বন্ড বন্ধ করারও রায় দেয়। তবে তা নিয়ে কোনও কথা বলেন না প্রধানমন্ত্রী।

আরও পড়ুন- বিজেপি হারছে? এই মুহূর্তে কী বলছে সাট্টা বাজারের হিসেব?

অথচ প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অনগ্রসর বা অতি অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের প্রশ্নে কলকাতা হাই কোর্টের রায় নিয়ে দেশ জুড়ে প্রচার করে বেড়ান। সন্দেশখালির প্রসঙ্গ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ তোলেন। নরেন্দ্র মোদি যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁরাই প্রথম সব ধরনের সংরক্ষণ তুলে দেবেন। এখন সমস্তটাই মিথ্যাভাষণ। তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর চোখ একবারও শুভেন্দু অধিকারীর দিকে বা উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের দিকে পড়ে না। এই তাপস রায়ের বাড়িতেই ইডি হানা হয়েছিল, তারপরেই তিনি ঘটা করে বিজেপিতে যোগ দিয়ে নিজের পাপস্খলন করেছেন।

আসলে সমস্যাটা আমাদের মতো নির্বাচকদের। আমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যমেই বিশ্বাস করি। আমরা দেখতে ভুলে যাই, নরেন্দ্র মোদির আশেপাশে যাঁরা ঘুরছেন, তাঁদের বেশিরভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা মহিলাদের যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত। আমরা মনে করি, বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ এবং গণমাধ্যমে সমস্ত সত্যি খবর দেখানো হয়। আমরা আসলে ঠকে শিখি না, ঠেকে শেখার চেষ্টা করি আর মোদির গ্যারান্টিতে মোহিত হয়ে যাই। সেই জন্যই যখন মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে মোদি বলেন, ১৯৮২ সালে ‘গান্ধী’ সিনেমা মুক্তির আগে ভারতের মানুষজন মহাত্মা গান্ধীকে চিনতেন না, আমরা তখনও রাগতে ভুলে যাই, আক্রোশে নরেন্দ্র মোদিকে প্রত্যাখান করি না।

More Articles