হেঁটেছিলেন গান্ধী-সুভাষের বিপরীতে! যৌনতা নিয়ে কেন পাপবোধ ছিল না নেহরুর?
Nehru and Vasantasena: ভোগের এই শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী বর্তমান ভারত। অবদমিত পিতৃতান্ত্রিক হাম্বারব ভালোবাসার কিচ্ছু্টি জানে না।
ভারতবর্ষের প্রথম ‘প্রধানমন্ত্রী’ জহরলাল নেহেরুর বড় প্রিয় ছিল শূদ্রকের নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’। 'প্রধানমন্ত্রী'- এই বিশেষণটি তুলে রাখা যাক। বরং বলা যাক জীবনজিজ্ঞাসু, ভারতের ইতিহাস সন্ধানী জহরলালের প্রিয় ‘প্রকরণ’ শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক। তাঁর বই ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’-য় নাটকটি নিয়ে আলোচনা আছে। গত শতকের আটের দশকে শ্যাম বেনেগাল দূরদর্শনের জন্য নেহেরুর বইয়ের দৃশ্যরূপ হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন ‘ভারত এক খোঁজ’– সেখানেও বেনেগালের একটি এপিসোডের প্রায় পুরোটা জুড়ে ছিল এই নাটকের অভিনীত রূপ। শূদ্রকের নাটকে অপার্থিব ধর্মবাসনা নেই। আছে উজ্জয়িনী নগরীর অপশাসকের পতনের রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত। আর আছে এক দানশীল বণিক ও তার প্রেমিকার কথা। শ্রোতা-দর্শক-পাঠক এ নাটকে বণিক চারুদত্ত আর তার প্রণয়িনী বসন্তসেনার কথাই মনে রাখে। এ এক গভীর প্রেমকথা যা আন্দোলিত করেছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে। চলচ্চিত্র নামের নতুন শিল্পরূপটি নানা সময়ে ধারণ করেছিল শূদ্রকের এই প্রেমকথা। গিরিশ করনাডের ‘উৎসব’ ১৯৮৪-তে মুক্তি পেয়েছিল। রেখা সেখানে বসন্তসেনার ভূমিকায় অপ্রতিরোধ্য। তবে গিরিশই শূদ্রকের নাটকের প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটালেন তা নয়। স্বাধীনতার আগেই এই নাটক থেকে অন্তত সাতটি ছবি তৈরি হয়েছিল। প্রথম চলচ্চিত্ররূপ ১৯২০-তে, তখনও ছবিতে কথা ফোটেনি। ছবির নাম ‘মৃচ্ছকটিক’ – শূদ্রকের নাটকের নাম আর সুচেত সিংয়ের সিনেমার নাম একই। তবে স্বাধীনতার আগে নির্মিত বাকি ছবিগুলিতে নাম আর ‘মৃচ্ছকটিক’ নয় – সব ক'টি ছবির নামই ‘বসন্তসেনা’। স্বাধীনা পরিশীলিত রমণীয় বসন্তসেনা। দাদাসাহেব ফালকের ‘বসন্তসেনা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৯-এ। সমাজসচেতন মুক্তমনা কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের ‘বসন্তসেনা’ ১৯৩১-এ আত্মপ্রকাশ করে। ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই ‘বসন্তসেনা’-র সমাদর।
কালিদাসের শকুন্তলার মতো শূদ্রকের বসন্তসেনা সরলা তপোবনবাসিনী নন। তিনি নগরবধূ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ সুকুমার সেন তাঁর কালিদাস বিষয়ক গল্পের টীকায় খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, বেশে থাকতেন যাঁরা তাঁরাই বেশ্যা। বেশ্যা শব্দটি কালিদাসের কালে নিন্দাসূচক ছিল না। নানা কলায় তাঁদের পটুত্ব। নৃত্য, গীত, বাক্, নান্দনিকতা এসবের অনুশীলনে তাঁরা রূপ ও ব্যক্তিত্বকে শাণিত করে তুলতেন। তাঁরা জানতেন কাকে বলে বাহ্যসুখ আর কাকে বলে যথার্থ প্রেম। বসন্তসেনাও জানতেন। বাহ্যসুখ প্রদানও কিন্তু চাইলেই তিনি করতেন না, বসন্তসেনা এক অর্থে স্বাধীনা। এ নাটকে রাজশ্যালক দুর্বিনীত অনাগরিক অভব্য শকার বসন্তসেনাকে চেয়েও পায়নি। এই বসন্তসেনা কামদেবের উৎসবে ভদ্র, শীলিত, দানশীল চারুদত্তকে দেখে প্রেমে পড়েছেন – যাকে বলে প্রেম। তাঁর প্রেমে পড়েছেন চারুদত্তও। শরীর-মনের সেই প্রেমানুভূতি যাপনের অভিলাষী তাঁরা।
আরও পড়ুন- বিয়ের মরীচিকায় ধরা দেয়নি শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রেম
নেহেরু তাঁর আত্মজীবনীতে (An Autobiography) অকপটে লিখেছিলেন বিলেতে বড় হয়ে ওঠার পর্বে জীবন-ভালোবাসা ও যৌনতা সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা। গান্ধী ও সুভাষের ভাবনার থেকে জীবন-প্রেম-যৌনতা সম্পর্কে নেহেরুর ভাবাদর্শ পৃথক। গান্ধী ও সুভাষ প্রেম-যৌনতাকে পাপ হিসেবে দেখেছেন। এই পাপবোধ থেকে সুভাষ পরবর্তীকালে বাইরে আসতে পেরেছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতে সে কথা কবুল করেছেন। নেহেরু কিন্তু প্রেম-যৌনতার ক্ষেত্রে পাপবোধ তাড়িত নন। লিখেছিলেন, তাত্ত্বিকভাবে যৌনতা বিষয়ে বিলেতে বন্ধুদের সঙ্গে সাহসী আলোচনা করতেন তিনি। ইভান ব্লক, হ্যাভলক এলিস ছিল তাঁদের পাঠ্য। ওস্কার ওয়াইল্ড আর ওয়ালটার পেটার পড়ে নেহেরু জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করতেন তাকে বলেছেন, ‘a vague kind of cyrenaicism’। গ্রিক জীবনদর্শনের নামে নিজের জীবনভাবনাকে চিহ্নিত করেছিলেন শিক্ষিত ভারতীয় ভদ্রযুবা জহরলাল। এই জীবনদর্শন বর্তমান-মুহূর্তজীবী আনন্দে বিশ্বাসী। যৌনতা-বিষয়ে পাপবোধের ঊর্ধ্বে যেতে চেয়েছিলেন যুবা নেহেরু। তবে একথাও স্বীকার করেছেন, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে প্রেম-যৌনতা-ভালোবাসাকে তখন যেভাবেই দেখুন না কেন, বন্ধুদের সঙ্গে যত সাহসী তাত্ত্বিক কথাই বলুন না কেন, বাস্তবে তিনি তখনও বেশ লাজুক। এই মিতবাক লজ্জা তাঁর কেটে গিয়েছিল, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি শীলিত রুচিবোধের অধিকারী হয়েছিলেন। ভালোবাসা ও সৌন্দর্যবোধের শীলিত পৌরুষ নেহেরুকে ঘিরে বিকশিত। জনমানসে নেহেরু কল্পনার সঙ্গে তা যুক্ত হয়েছিল। আলিয়া ভাট অভিনীত হাল আমলের সিনেমা ‘গাঙ্গুবাঈ’-তে নেহেরু আর গাঙ্গুর কথোপকথনের দৃশ্য কল্পনা করতে দ্বিধা করেননি পরিচালক। হালের যৌনপল্লীকে সেকালের বেশের মূল্যবোধে বিচার করার প্রসঙ্গ এসেছে ছবিতে। যুক্ত হয়েছে রাজনীতির প্রসঙ্গ। গাঙ্গু ক্রমে স্বাধীনা, রাজনীতি-প্রাজ্ঞা হয়ে উঠেছে। তার জীবনযাপনের যে ছবি চোখে পড়ে সেখানে সমৃদ্ধির ছোঁয়া, যৌন-নৈতিকতার সংকীর্ণতাকে ভুলে গাঙ্গুর ঘরবাড়িকে দেখলে টের পাওয়া যাবে রাজসিক উপভোগ্যতার শ্রীময়স্পর্শ। শূদ্রকের নাটকে বসন্তসেনার বিভিন্ন-মহলের সমৃদ্ধচিত্র রয়েছে। ভোগ-উপভোগের রাজসিকতা ও রুচির পরিচয়বাহী বসন্তসেনার আবাস। আদি ভারতে যে ভোগের নির্দ্বিধ রাজসিকতা ছিল তা কেবল ইতিহাসবিদেরা স্বীকার করেন না, বিবেকানন্দের মতো সন্ন্যাসীও স্বীকার করেছিলেন। বিবেকানন্দ শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে উৎকৃষ্ট ভোগের উদাহরণ হিসেবে কালিদাস ও জয়দেবের কাব্যের কথা বলেছিলেন। সেই উৎকৃষ্ট ভোগ উনিশ শতকের অবদমিত বচ্ছর-বিয়োনি পিতৃতান্ত্রিক মধ্যবিত্ততার থেকে একেবারেই আলাদা।
শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে বসন্তসেনা চারুদত্তের গুণমুগ্ধ। সেকালের বেশবাসী রমণী হিসেবে বসন্তসেনা জানেন বাক্-রূপ বৈদগ্ধ্য, একটা পর্যায় অবধি স্পর্শের রমণীয় উদযাপনও তাঁর অধিগত। শীলিত পুরুষকে এই পরিষেবা চাইলে তিনি প্রদান করেন। তবে ইচ্ছে না হলে কেবল অর্থজন্য তিনি প্রদান করবেন না তা। রাজশ্যালক শকার নানাভাবে বসন্তসেনাকে ভোগ করতে চেয়ে ব্যর্থ, কারণ ভোগের শুচিশীলনের অধিকারী নন শকার। বস্তুত পক্ষে চারুদত্তের পাশে শকারকে খুবই হীনপ্রভ লাগে, শূদ্রকের উদ্দেশ্যও তাই। বসন্তসেনা জনপদবধূ হিসেবে তাঁর রমণীয়ত্ব ও বৈদগ্ধ্যকে প্রদর্শনযোগ্য কলা বলে মনে করেন। এসব কিন্তু ‘প্রেম’ নয়। তবে প্রেম কী? সে অনুভব তাঁর চিত্তে জাগিয়ে তুলেছেন চারুদত্ত। বসন্তসেনার সহচরী মদনিকা বলেছে চারুদত্তের সম্পদহীনতার কথা। বসন্তসেনার কাছে এই সম্পদহীনতা তুচ্ছ, চারুদত্তের সম্পদ শেষ হয়েছে তাঁর দানশীলতার জন্য। পুকুরের জল অনবরত সেচন করলে সেই জলাধার তো জলশূন্য হয়ে যায়। সেজন্য জলাধারের স্নিগ্ধ-অতীতের কথা বিস্মৃত হওয়া অনুচিত।
আরও পড়ুন- বিমলাকে ‘শিক্ষা’ দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ
বসন্তসেনা চারুদত্তের সঙ্গে যে প্রেমযাপন করেছেন সেই প্রেমযাপনের জন্য কিন্তু চারুদত্তকে কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুত করেননি। চারুদত্তের পুত্র রোহসেনের প্রতি বসন্তসেনার মাতৃবৎসলতা প্রকাশ পেয়েছে। তার মাটির খেলনাগাড়িটিকে স্বর্ণালঙ্কারে ভরে দিয়েছেন তিনি। বসন্তসেনা জানেন এই অলংকার চারুদত্তের প্রয়োজনে লাগতে পারে। বসন্তসেনা চারুদত্তের পত্নীর প্রতিও সদয়। ভালোবাসা ও সামাজিক কর্তব্য দু'য়ের মধ্যে শূদ্রক সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছেন। বসন্তসেনার ভালোবাসা উদভ্রান্ত স্বার্থপর নয়, মানবিক। একগামী বৈবাহিকতার ‘কঠোর’ আদর্শে চারুদত্ত-বসন্তসেনার প্রণয়কে বোঝার উপায় নেই। শূদ্রক যখন তাঁর নাটক লিখছেন তখন একগামী বৈবাহিকতার আদর্শ ভারতবর্ষে প্রচলিত হয়নি। পিতৃতন্ত্র যেভাবে পুরুষের লালসা-পরিপূরণের জন্য মেয়েদের বঞ্চিত করে সেই পিতৃতান্ত্রিক লালসাও শূদ্রকের কাছে পরিত্যজ্য। এই নাটকে শকার চরিত্রটি কেবল তার অশিক্ষা ও অনভিজাত্যের জন্য হাস্যের উপাদানই হয়ে ওঠে না, পিতৃতন্ত্রের বিবমিষাময় অধিকারবোধের ব্যর্থতাকেও নির্দেশ করে। শূদ্রক প্রেমের নাটকে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রসঙ্গও এনেছেন। প্রেমিক হওয়ার জন্য যেমন যোগ্যতা লাগে, তেমনি শাসক হওয়ার জন্যও যোগ্যতা লাগে। এই নাটকে অযোগ্য-প্রেমিক ও অযোগ্য-শাসকের পরাভব ঘটেছে।
নেহেরু ব্যক্তিগত জীবনে বিলেতে থাকার সময় পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের রচনা পড়ে অতীত-ভবিষ্যৎ ভাবনাবিহীন বর্তমানতার যে সুখবোধকে পরিণত বয়সে ‘a vague kind of cyrenaicism’ বলে নির্দেশ করেছিলেন তার থেকে মৃচ্ছকটিকের এই প্রেম-যাপন গোত্রে পৃথক। বঙ্কিমচন্দ্র মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করতেন আদি-ভারতের আদর্শ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর সাহিত্যে ক্রমে বদলে গেল। প্রাগাধুনিক পর্বের বাংলাসাহিত্য বঙ্কিমের খুব প্রিয় ছিল না। ধর্মমঙ্গলকাব্যে যৌনবাসনাজাত অপরাধের চিত্র আছে। এক রমণী নায়ক লাউসেনকে পাওয়ার বাসনায় নিজপুত্রকে কুয়োয় ফেলে দেয়। যৌনবাসনা ভালোবাসার উপাদান, কিন্তু তাড়িত যৌনবাসনা ভালোবাসা নয়। যৌনবাসনাকে ভালোবাসার স্তরে নিয়ে গিয়ে উদযাপন করতে শুচিশীলন লাগে। ভালোবাসার সেই শুচিশীলন চারুদত্ত ও বসন্তসেনার ছিল। ভালোবাসা চিরস্থায়ী হতেও পারে আবার নাও পারে। ভালোবাসার মুহূর্তযাপনের চিত্রে মৃচ্ছকটিক বিলসিত। কামদেবের মন্দিরে বসন্তসেনা ও চারুদত্ত পরস্পরকে দেখছেন। সেই মুহূর্তের অলৌকিক আনন্দ অকর্তব্য, বাসনার চাপল্য ও চাহিদার প্রাবল্যে বিনষ্ট করেননি তাঁরা। ভোগের এই শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী বর্তমান ভারত। অবদমিত পিতৃতান্ত্রিক হাম্বারব ভালোবাসার কিচ্ছু্টি জানে না।