এখন সর্বসমক্ষে মৃতার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, কীভাবে করা হয় ময়নাতদন্ত?
RG Kar Post Mortem Report: আগে কেবল দিনের আলোতেই ময়নাতদন্ত করা হতো। ২০২১ সাল থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রক সেই নিয়মে পরিবর্তন আনে।
আরজি করে মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১১ দিন আগে। ১০ দিনের মাথায় নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। দেহ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। আরজি করের চিকিৎসকেরা প্রথম থেকেই অভিযোগ তুলেছিলেন, নানাভাবে এই ঘটনায় জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়েছে ও হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও। কলকাতা পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একজনকে গ্রেফতার করেছিল ঠিকই কিন্তু ধৃত ব্যক্তিই মূল দোষী কিনা তার যথাযথ প্রমাণ এখনও সামনে আনা হয়নি। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খুন ও ধর্ষণকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারেন একাধিক ব্যক্তি। এই সকল প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে। ময়নাতদন্ত ঠিক কখন এবং কীভাবে করা হয়ে থাকে?
অনেকেই জানেন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে, অভিযোগ হলে ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেম করা হয় থাকে। এই প্রক্রিয়া চালানোর মূল কারণ হলো, মৃত্যুর কারণ এবং মৃত্যুর সময় জানা। আবার কোনও ব্যক্তির অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হলেও ময়নাতদন্ত করা হয় থাকে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লিনিকাল পোস্টমর্টেম। বিচার বিভাগীয় নির্দেশেই মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে। অটোপসি, নিক্রোপসি শব্দবন্ধগুলি দিয়েও ময়নাতদন্ত বোঝানো হয়ে থাকে।
মৃত্যুর কারণ জানতে অনেক সময় দেহের অভ্যন্তরীণ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয় থাকে। ধর্ষণের মতো ঘটনার আশঙ্কা করলে সিমেন সংগ্রহ করে ডিএনএ মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আত্মহত্যার মতো অভিযোগে ভিসেরা রিপোর্টের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব হয় ব্যক্তিকে কোনওভাবে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকেন ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসক। শুধুমাত্র সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন- এফআইআরে এত দেরি! অধ্যক্ষ কী করছিলেন? রাজ্যকে যে যে প্রশ্ন করল সুপ্রিম কোর্ট
ময়নাতদন্তের কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যেমন -
মেডিক্যাল : অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানতে এই প্রক্রিয়ায় ময়নাতদন্ত করা হয়।
আকাডেমিক : চিকিৎসা বিষয়ক কলেজগুলিতে পড়াশোনার জন্য এই পদ্ধতিতে ময়নাতদন্ত হয়।
ক্লিনিক্যাল : কোনও ব্যক্তির অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হলে তখন এই প্রক্রিয়ায় কাজ হয়।
ময়নাতদন্তের পদ্ধতিগুলি ধারাবাহিকভাবে একবার দেখা যাক।
ময়নাতদন্ত শুরুর আগের প্রক্রিয়া
১) দেহ শনাক্ত করা।
২) মরদেহের চিকিৎসার ইতিহাস জানতে হবে। যেমন - কোনও রোগ ছিল কিনা, কোনও ওষুধ খেতেন কিনা এসব যাবতীয় তথ্য।
৩) দেহে বাহ্যিক কোনও ক্ষত চিহ্ন রয়েছে কিনা তা দেখতে হয়।
ময়নাতদন্তের পদ্ধতি
১) অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি দেখতে কাঁধ থেকে পেলভিক হাড় পর্যন্ত 'Y' আকৃতিতে চিরে ফেলা হয়।
২) কলার (টিস্যু) নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
৩) প্রতিটি অঙ্গের আলাদ পরীক্ষা করতে হয়। যেমন - মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ইত্যাদি।
৪) এরপর প্রতিটি অঙ্গে আলাদা আলাদা ক্ষতচিহ্ন বা রোগ রয়েছে কিনা তা দেখা হয়। তদন্তের প্রয়োজনে অঙ্গগুলি রেখে দিতে পারেন চিকিৎসক। তা পরিবারকে জানিয়ে রাখতে হয়। ৪ মাস তা সংরক্ষিত করা যেতে পারে।
৫) পরের ধাপে টক্সিকোলজি এবং মাইক্রোবায়োলজির পরীক্ষা করতে তরল নমুনাগুলি সংগ্রহ করতে হয়।
অঙ্গ ভিত্তিক পরীক্ষা
১) মস্তিষ্ক : টিউমার, আলঝাইমার্সের মতো রোগ ছিল কিনা বা আঘাত অথবা স্ট্রোক হয়েছিল কিনা তা পরীক্ষা করা হয়।
২) হার্ট : কোনও হৃদরোগ ছিল কিনা তা দেখা হয়।
৩) ফুসফুস : নিউমনিয়া বা ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজের মতো শ্বাসযন্ত্রের রোগগুলির পরীক্ষা করা হয় থাকে।
৪) লিভার : লিভারের রোগ যেমন সিরোসিস বা হেপাটাইটিস রোগগুলির পরীক্ষা করে দেখা হয়।
৫) কিডনি : কিডনিতে কোনও আঘাত হয়েছে কিনা বা কিডনির কোনও রোগ ছিল কিনা সেসব দেখতে হয়।
আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডে অভিযুক্ত সঞ্জয়ের পলিগ্রাফ টেস্ট! কীভাবে সত্যি-মিথ্যা ধরা পড়ে এই পরীক্ষায়?
কিছু বিশেষ পরীক্ষা
টক্সিকোলজি : বিষ খাওয়ানো হয়েছিল কিনা তার জন্য দেহের তরলের বিশ্লেষণ করা হয়।
মাইক্রোবায়োলজি : সংক্রমক রোগ শনাক্ত করতে তরলের পরীক্ষা করা হয়।
হিস্টোপ্যাথলজি : কোশের কোনও অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা তার জন্য মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
রেডিয়োলজি : অভ্যন্তরীণ কাঠামো যথাযথ রয়েছে কিনা তা জানতে সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে করা হয়ে থাকে।
ময়নাতদন্ত সর্ম্পূণ হওয়ার পর
১) পরিবার বা কর্তৃপক্ষের কাছে মৃতদেহ ফেরানোর আগে দেহের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলির জন্য কাটাছেঁড়া করা অংশগুলি পুনরায় সেলাই করা হয়।
২) পরীক্ষা করে পাওয়া নথির ভিত্তিতে একটি বিস্তারিত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বানানো হয়।
৩) মৃত্যুর কারণ এবং পদ্ধতি সহ একটি ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়।
পরিস্থিতি অনুযায়ী ময়নাতদন্তের পদ্ধতিগুলি পরিবর্তনও হতে পারে। আগে কেবল দিনের আলোতেই ময়নাতদন্ত করা হতো। ২০২১ সাল থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রক সেই নিয়মে পরিবর্তন আনে। এখন রাতেও ময়নাতদন্ত করা যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে আগেও রাতে ময়নাতদন্ত করা যেত।
উল্লেখ্য, মহিলা চিকিৎসকের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, তাঁর শরীরে মোট ২৪ টি ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, গলার হাড় ভাঙা এবং হাড়েও রক্তপাতের চিহ্ন রয়েছে। গলা এবং মুখ চেপে ধরার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে রিপোর্টে। এছাড়া একাধিক নখের আঁচড়, কামড়ের চিহ্ন, যৌনাঙ্গে জোর করে পুরুষাঙ্গ প্রবেশের প্রমাণ মিলেছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন অভিযুক্তর শরীরেও আঘাতের চিহ্ন থাকবে। কিন্তু এতদিন গড়িয়ে যাওয়ার পর সেই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যে সকল ক্ষতচিহ্নের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তা ভয়ঙ্কর। প্রশ্ন উঠছে, কোন রাগের এই বহিঃপ্রকাশ ঘটাল অভিযুক্ত বা অভিযুক্তরা? এর নেপথ্যে কি প্রতিশোধস্পৃহা ছিল?