বাংলা থেকে সরবে না আরজি কর মামলা, সপ্তম শুনানিতে যে যে বড় সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টে
Supreme Court Hearing on RG Kar Case: এটাই ছিল প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে আরজি কর মামলার শেষ শুনানি। ১০ নভেম্বর অবসর নিচ্ছেন তিনি। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চেই হবে মামলার পরের শুনানি।
গত দু'দিনে একাধিক বার পিছিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি। প্রাথমিক ভাবে নির্ধারিত দিন ছিল মঙ্গলবার। তবে সেখান থেকে ঠেলতে ঠেলতে বৃহস্পতিবার শেষমেশ এসে ঠেকে শুনানির দিন। গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। সারাদেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও মেলে সেই প্রমাণ। সেই ঘটনায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল গোটা রাজ্য, কলকাতা জুড়ে লাগাতার চলে বিক্ষোভমিছিল-প্রতিবাদ। ঘটনার প্রতিবাদে কর্মবিরতি ও আন্দোলনের ডাক দেন জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন। চলে অনশনও। সেই মামলায় স্বতপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলারই বৃহস্পতিবার ছিল সপ্তম শুনানি।
এদিন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়াল, বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চের সামনে জাতীয় টাস্ক ফোর্স নিয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রের। আরজি করের ঘটনার পর চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ১১ সদস্যের জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। টাস্ক ফোর্সের মূল লক্ষ্য হবে— চিকিৎসা পরিষেবায় যুক্ত নারী-পুরুষদের উপরে হিংসার ঘটনা রোধ এবং লিঙ্গ-বৈষম্য দূর করা, হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা। তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের পরামর্শ চেয়েছিল আদালত। সিভিক ভলিন্টিয়ার দিয়ে হাসপাতালের নিরাপত্তা সামলানো, এমনকী সেই সিভিক ভলিন্টিয়ার নিয়োগে রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের মতো একাধিক অভিযোগ তুলে আগের দিনের শুনানিতে রাজ্যের কাছে ছ’টি প্রশ্ন তুলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। সে ব্যাপারে রাজ্যের কাছে হলফনামাও চায় শীর্ষ আদালত। সেই হলফনামাও জমা দেওয়ার কথা ছিল এদিনই।
আরও পড়ুন: সিভিক ভলিন্টিয়ার নিয়ে ফের প্রশ্নের মুখে রাজ্য, আরজি কর-শুনানিতে যে যে নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
আগের শুনানিতে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল, হাসপাতালে রোগীকল্যাণ সমিতি পুনর্গঠন করছে তারা। সেই সঙ্গে হাসপাতালের কাজকর্মে আরও স্বচ্ছতা আনতে ‘সার্বিক হাসপাতাল পরিচালন ব্যবস্থা’ (ইন্টিগ্রেটেড হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) চালু করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছিল। সেই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে— অনলাইনে ওপিডি টিকিট বুকিং, ই-প্রেসক্রিপশন, অনলাইন রেফারাল সিস্টেম। সেই প্রক্রিয়া কত দূর এগোল, তা-ও বৃহস্পতিবারের শুনানিতে জানানোর কথা ছিল সুপ্রিম কোর্টে। পাশাপাশি স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল সিবিআইয়েরও। সেই মতোই এদিন তদন্ত শুরু হতে না হতেই বিচারপতিদের সামনে স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। সেই রিপোর্ট পড়ার পর বিচারপতিদের বেঞ্চ সিবিআইকে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতিদের বেঞ্চ। চার সপ্তাহ পরে পরবর্তী রিপোর্ট জমা দিতে হবে সিবিআইকে। এর প্রেক্ষিতে রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল জানান, দ্রুত যাতে তদন্ত শেষ হয়, তা নিশ্চিত করা হোক। চার্জ গঠন হয়েছে। রাজ্য চায়, আসল দোষী যাতে শাস্তি পায়। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS)-এর চিকিৎসকদের আইনজীবীও তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে এদিন প্রশ্ন তোলেন। ৯০ দিন ধরে তদন্ত চলছে, কিন্তু কিছু হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর পাল্টা প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, "নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে নিম্ন আদালতের। যদি তথ্যপ্রমাণ দেখে তাঁদের মনে হয়, তেমন নির্দেশ দিতে পারেন তাঁরা।"
একই সঙ্গে এদিন কথা মতোই শীর্ষ আদালতে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিয়েছে ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্সও। ওই রিপোর্ট সব রাজ্যের মুখ্য সচিবকে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। মুখ্যসচিবেরা ওই রিপোর্ট দেখে কোনও পরামর্শ থাকলে দিতে পারবেন বলেও জানানো হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ সওয়াল করেন, ‘‘বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রতিনিধিদের এই টাস্ক ফোর্সে রাখা না হলে জাতীয় টাস্ক ফোর্স যে কারণে গঠিত হয়েছে, সেই কাজ সঠিক ভাবে হবে না।’’ তার পরেই প্রধান বিচারপতি জানান, জাতীয় টাস্ক ফোর্সের এই রিপোর্ট মুখ্যসচিব সব বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠাবেন। এদিন তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে না বলে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ তোলেন আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। তার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি জানান, ‘‘চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্রায়াল বিচারকের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে পুনরায় তদন্ত নিয়ে নির্দেশ দেওয়ার, তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার।’’
এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে শুনানি করার আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সরব হন জনস্বার্থ মামলাকারীদের তরফের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। তাঁর দাবি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন। তবে তাঁর এই বক্তব্যের পরেই প্রধান বিচারপতি কার্যত ধমক দিয়ে তাঁকে বলেন,‘আপনি কার হয়ে সওয়াল করছেন? শুনে মনে হচ্ছে, কোর্টে এখন ক্যান্টিনের মতো গল্প চলছে।’’ কার্যত রাজ্যের বাইরে শুনানির আবেদন এদিন খারিজ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাইরে শুনানির প্রশ্নই নেই।
আরও পড়ুন:আরজি কর কাণ্ডে আদালতে নিজের বক্তব্য জানাতে পারবে ধৃত সঞ্জয়? কী বলছে ভারতের আইন?
তবে বৃহস্পতিবার শুনানি খুব বেশি এগোয়নি সুপ্রিম কোর্টে। রাজ্যের তরফে সিভিক ভলিন্টিয়ার সংক্রান্ত যে হলফনামা জমা করার কথা ছিল রাজ্যের, তা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে জমা পড়েছিল তিন দিন আগেই। তবে বিষয়টি উত্থাপিত হলেও তা নিয়ে শুনানি হল না বৃহস্পতিবার। সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়ে আমাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিপোর্ট জমা পড়েছে। বৃহস্পতিবার এই বেঞ্চে অন্য মামলাও রয়েছে। তাই পরবর্তী দিন এই নিয়ে শুনানি হবে।’’
সম্ভবত এটাই ছিল প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে আরজি কর মামলার শেষ শুনানি। সব ঠিক থাকলে আগামী ১০ নভেম্বরই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিতে চলেছেন তিনি। তাঁর জায়গায় প্রধান বিচারপতির পদে বসতে চলেছেন বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। তাঁর ডিভিশন বেঞ্চেই হতে চলেছে আরজিকর মামলার পরবর্তী শুনানি। এদিকে নিম্ন আদালতে ১১ নভেম্বর থেকে এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই আরজি কর মামলায় চার্জ গঠন করেছে সিবিআই। সেই সংক্রান্ত রিপোর্টও জমা পড়েছিল এদিন সুপ্রিম কোর্টে। ওই একই দিনে সুপ্রিম কোর্টেও এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ ১১ নভেম্বরই সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার অষ্টম শুনানি বলে জানিয়েছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।