আরজি কর না ব্যক্তিসঙ্কট? মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে, ডাক্তারদের কী মেসেজ করেন চিকিৎসক?
Jhargram Doctor Death আরজি করের ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “নোংরা পৃথিবী, অবিচার, নোংরামি দেখেও অন্ধ হয়ে থাকে সবাই। এ ভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?"
অস্থিরতা তাড়িয়ে মারে। যে অস্থিরতাজাত বোধ থেকে দিশাহীন মানুষের কাছে অস্তিত্ব মুছে ফেলাই হয়তো পথ হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক এই টানাপড়েন নিয়ে অলিতে গলিতে এখন কাউন্সেলিং সেন্টার, প্রতি ৩ জনে ১জনই হয়তো সচেতনতার বাক্য আউড়ে যান। তবু, চরম মুহূর্তে কেউ কেউ চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। ফেরার পথ থাকে না। যেমন, ফিরবেন না দীপ্র। পেশায় চিকিৎসক নিজে। অথচ চরম মানসিক সঙ্কটের সঙ্গে যুঝবার দাওয়াই ছিল তাঁরও অজানাই। ঝাড়গ্রামের রঘুনাথপুরে একটি লজের ভিতর থেকে উদ্ধার হয়েছে দীপ্র ভট্টাচার্যের দেহ। বয়স মাত্র ৩২! বাড়ি বেহালায়। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অ্যানাস্থেশিয়া বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত ছিলেন দীপ্র।
কালীপুজো-দীপাবলির ছুটি কাটিয়ে বৃহস্পতিবার সকালেই বাড়ি থেকে লজে গিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ জানিয়েছে, পরিবারের সদস্যরা এর পর থেকেই আর দীপ্রর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝাড়গ্রামের ওই লজ থেকেই উদ্ধার হয় দীপ্রর দেহ। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট না হলেও, দেহের পাশে একটি সিরিঞ্জ পাওয়া গিয়েছে। একটি ওষুধও পড়েছিল। যে অ্যানাস্থেসিয়ার ওষুধটি পাওয়া গিয়েছে, তার ওভারডোজের ফলেও মৃত্যু হওয়া সম্ভব বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, আত্মঘাতীই হয়েছেন দীপ্র। আর নিজেকে শেষ করার আগে স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন মেসেজ। যে মেসেজ স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোন মানসিক সঙ্কটে ভুগছিলেন এই তরুণ চিকিৎসক।
আরও পড়ুন- আরজি কর মর্গ দুর্নীতি: গভীর রাতে যে সব ভয়াবহ কুকর্ম চলত মর্গে!
পুলিশ জানিয়েছে, দীপ্রর স্ত্রী কলকাতাতেই থাকেন। তিনিও পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী। মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে বেশ কিছু মেসেজ পাঠিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, দীপ্রর মৃত্যুর পর স্ত্রী যেন নতুন জীবন শুরু করেন। মেসেজে ‘পুরনো ঘা’-এর কথা বলেছেন তিনি, যে মানসিক ঘা সম্ভবত শুকোয়নি। স্ত্রীকে পাঠানো মেসেজে আরজি করের প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি। আরজি করের ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “নোংরা পৃথিবী, অবিচার, নোংরামি দেখেও অন্ধ হয়ে থাকে সবাই। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? এ কোন দুনিয়ায় আমরা বাস করছি? ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না, জেগে থাকতে ইচ্ছে করে না, চারিদিকে শুধু অন্ধকার।”
স্ত্রীকে পাঠানো মেসেজের বড় অংশ জুড়েই ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতার কথা বলে গিয়েছেন দীপ্র। জানা গিয়েছে, বৈবাহিক সম্পর্কেও অস্থিরতা আসছিল। অতীতের কিছু তিক্ত স্মৃতি কাটিয়ে ওঠার আগেই সম্ভবত বিয়ে করে নিয়েছিলেন তিনি, যে বিয়ের ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তবে শেষ মেসেজে দীপ্র লিখে গেছেন, তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। কোন পরিস্থিতি? ব্যক্তিসঙ্কটের পাশাপাশি কি মানসিক সঙ্কট বাড়িয়ে ফেলেছিল আরজি করের ঘটনা?
ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের সুপার অনুরূপ পাখিরা জানিয়েছেন, দীপ্র পুজোর ছুটির পর কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে খবর, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ থেকেই স্নাতক স্তরের পড়াশোনা দীপ্রর। পরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। সম্প্রতিই বিয়ে হয় তাঁর। আরজি করের দুর্নীতি আঁচ কি ছাত্র জীবনে পেয়েছিলেন দীপ্র? নতুন করে এই আন্দোলনের ফলে কি মানসিকভাবে আবারও সেই অসহায়তা কোথাও আঘাত দিয়েছিল তাঁকে?
আরও পড়ুন- ওঁর দু’চোখ জোড়া স্বপ্ন রক্ত হয়ে ঝরতে দেখেছি: আরজি কর কাণ্ডে মৃতার মা-বাবা
পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ১৩ মিনিট নাগাদও হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিস্ট চিকিৎসকদের গ্রুপে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেন দীপ্র। সেই পোস্টেও আরজি করের প্রসঙ্গ ওঠে। দীপ্র লিখেছিলেন, বছর দেড়েক আগেও তিনি আরজি করে ছিলেন। আরজি করের চিকিৎসক-অধ্যাপকদের একাংশের বিরুদ্ধে থ্রেট কালচারে মদত দেওয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। মেসেজ দেখেই তাঁর সহকর্মীরা দীপ্রর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। ফোন সুইচ অফ থাকায় যাঁরা জানতেন দীপ্র কোথায় থাকেন, তাঁরা সেখানেই পৌঁছন। হোটেলের ঘরের দরজা ভেঙে দেখা যায় দীপ্রর নিথর দেহ।
স্ত্রীকে যে মেসেজ পাঠিয়েছেন, তাতে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্কটের কথা বলেছেন বেশি। আর ডাক্তারদের গ্রুপে পাঠানো মেসেজে দীপ্র লিখেছিলেন, "থ্রেট কালচারের সমর্থনকারী অধ্যাপকদের লজ্জা হওয়া উচিত। যাঁরা চাকরি বাঁচাতে দুর্নীতিকে সমর্থন করছেন, তাঁদের লজ্জা পাওয়া উচিত”। দীপ্র আরও লিখেছিলেন, "এখনও যাঁরা ডাক্তারি পড়ুয়াদের থ্রেট দিচ্ছেন, তাঁদের লজ্জিত হওয়া উচিত। যারা ভয় দেখায়, স্বজনপোষণে বিশ্বাসী ও তৈলমর্দন করে, তারা সন্দীপ ঘোষের থেকে কম নয়। আমার আত্মা তাদের তাড়া করে বেড়াবে।" যদিও চিকিৎসক মহলের একাংশের দাবি, ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজে কোথাও কোনও থ্রেট কালচার নেই। স্ত্রীকে কোথাও কোনওভাবেই দায়ী করেননি দীপ্র। স্ত্রীকে অনেকবার চেষ্টা করেও ভালো না বাসতে পারার কথা লিখে গেছেন। ব্যক্তিগত আর সামাজিক সঙ্কটের মুখেই কি হারিয়ে গেলেন দীপ্র? যারা সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মানসিক শান্তিকে গুরুত্ব দেওয়া কথা বলেন, কোথাও কি দীপ্রর মৃত্যু সেখানে উত্তর হয়ে থেকে গেল যে, মানসিক সঙ্কট আসলে সমাজবিচ্ছিন্ন নয়?