প্রণবহীন পুজোয় কেমন আছে মিরাটির 'মুখার্জি ভবন', স্মৃতিচারণে পুত্র অভিজিৎ
Pranab Mukherjee: প্রণব মুখোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে সমস্ত কাজের মধ্যেই এই ভোগের ক্ষেত্রেও তদারকিতে মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনি। আর এবার?
পল্টু। ছোট্ট বালক। বিস্তৃত ক্ষেত, কাশফুলে ডোবা দিগন্তের হাতছানিতে আলপথ বেয়ে স্কুলে যেত রোজ। আজ সেই ছ’কিলোমিটার পথেই জড়িয়ে গিয়েছে শিকড়, জড়িয়েছে একের পর ইতিহাস আর কথকতা। বিতর্ক আর জ্ঞানের মিশেলে সেকালের সেই বালকই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন অনন্য। তিনিই হয়ে উঠেছেন মৌলিক। আজ দুর্গা উৎসবের আবহে সেই তিনিই ফিরে আসছেন অন্যভাবে। খ্যাতির তীব্র গতিপথে তিনিই যেন বলে যাচ্ছেন এক উৎসবের কথা, এক পুজোময় আবহে ভালো থাকার কথা। বলছি, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা।
মুখার্জি ভবন। কামদা কিঙ্কর মুখার্জী সরণি। মিরাটি। বীরভূম; এই বাড়ির একদা অন্যতম বাসিন্দা তিনি। যে সদস্যের আবহে এই বাড়ির পুজো ক্রমেই বিশ্বজনীনতা লাভ করেছিল, যার ইতিহাস বিবর্তিত হয়েছিল দেশ জুড়ে। এই পুজোয় এক অন্য প্রণবকে খুঁজে পেত আপামর বাঙালি। আর আজ! কেমন আছে সবটা? খোঁজ নিয়েছে কি বাঙালি? কী হচ্ছে সেখানে, কী হবে এবার পুজোয়, কেমন আছে প্রণব-হীন ‘মুখার্জি ভবনে’র পুজো?
১৮৯৫ সাল। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অব্যাহত। সবেমাত্র হালে জল পাচ্ছেন বিপ্লবীরা। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতের ছত্রে ছত্রে বিরচিত হচ্ছে মুক্তির জয়গাঁথা। ঠিক এর সঙ্গেই সামগ্রিক ভালো থাকার রসদ, উৎসব আর সামন্ততান্ত্রিক উদযাপনের আবহে বাড়ছে দুর্গাপুজো। তখনও দুর্গার সর্বজনীনতা প্রকাশিত হয়নি তেমনভাবে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, বীরভূমের তৎকালীন প্রতিপত্তিশালী জঙ্গল মুখোপাধ্যায় শুরু করলেন দুর্গাপুজো। যদিও পুজো চললেও মুখার্জি ভিটেয় জাঁকজমকসহ দুর্গাপুজো শুরু হল কয়েক বছর পর থেকে। যার ব্যাপ্তি বাড়ল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা কামদা কিংকর মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তাঁর বাবা জঙ্গল মুখোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই বাড়ির উঠোনে বিচুলির চালা বেঁধে পুজো বাড়ল ক্রমশ। এই পুজো-ইতিহাসে অন্যতম স্থান, এর রীতির যা হিন্দু ধর্ম বা সনাতনী পথ তো বটেই সামগ্রিকভাবে সকলের জন্য এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল।
মূলত গ্রামের সব মানুষের অংশগ্রহণের আবহে প্রকাশিত হত জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক উৎসবের। এই ধারা আজও বিবর্তিত হয়। সকলের জন্য পুজো, সকলের জন্য প্রসাদ; এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেন মুখার্জি ভবনের মুরুব্বিরা। সপ্তমী থেকে নবমী-নিশি। তিন বেলা হাজার মানুষের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা হয় আজও। একাধিক ধরনের নাড়ু তৈরির রেওয়াজ রয়েছে এখানে। মূলত, মুড়ি-মুড়কি আর গুড় সহযোগে খইয়ের পদের পাশাপাশি মায়ের ভোগে থাকে সিরির, খইয়ের ও নারকেল দিয়ে দু’রকমের নাড়ু। সপ্তমী, অষ্টমী নিরামিষ। নবমী আর দশমীর ভোগে আজও মাছের ব্যবস্থা রাখেন মুখার্জি ভবনের সদস্যরা।
প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময়কালে অথবা তিনি মন্ত্রী, রাজনৈতিক তারকা হওয়ার সময় একাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, প্রোটোকলের জাঁকজমক আর একাধিক বিখ্যাত মনীষীদের আগমনে এই পুজো নতুন মাত্রা লাভ করলেও এর রেওয়াজ কোনওদিন স্তিমিত হয়নি। বহু আলোচিত হয়েছে এর চণ্ডীপাঠ-পর্বের কথা। বরাবর পুজোর সৃষ্টিকর্তাদের ইচ্ছাতে পুরোহিত নন, পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যই তাঁর সহযোগী হিসেবে থাকবেন, এমন বলা হয়েছিল। যিনি অষ্টমীর মহাপুজো, যজ্ঞ-সঙ্গত দেবেন, এমনকী চণ্ডীপাঠ করবেন। দিনের পর দিন যে কাজ প্রণব করে গিয়েছেন। বাড়ির কাছের কাঁদর নদীর ঘাটে জল আনতে যাওয়া, নবপত্রিকা স্নান থেকে শুরু করে, সব ক্ষেত্রেই তাঁকে দেখা গিয়েছে। যদিও ২০২০ সালের পর বদলেছে পরিস্থিতি। মুখার্জি ভবনের দুর্গাপুজোর বাকি সব আবহ ঠিক থাকলেও, কোনও রীতির অন্যথা না হলেও প্রণবহীন পুজোয় খানিকটা বদল অবশ্যই হয়েছে। কেন?
আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা
এই বিষয়ে ইন্সক্রিপ্টকে বিস্তারিত জানিয়েছেন প্রণব-পুত্র, প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এবারও পুজো হবে আগের মতোই। সর্বক্ষেত্রের মানুষ আসবেন। পুজোর সমস্ত আচার পালন একই থাকবে, যা বছরের পর বছর ধরে চলছে এই পুজোয়। পরিবার, গ্রাম, আত্মীয়-সকলে মিলিত হবেন ফের।” কিন্তু বাবা-হীন দুর্গাপুজোয় কি কিছু বদলেছে আদৌ? “বাবা নেই। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পুজোর উত্থান ঘটান, তাতে তাঁদের ইচ্ছামতো একটি প্রথা ছিল বহুকাল আগে থেকেই। তা হল, পুরোহিতের সঙ্গে একজন পরিবারের সদস্য থাকবেন। তিনি সহযোগী হবেন পুরোহিতের। তন্ত্রধারক হবেন। অষ্টমীর দিন চণ্ডীপাঠ করবেন। বাবা থাকতে তিনিই সবটা করতেন। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পরে, আমাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সিদ্ধান্তে সেই কাজ এখন শুধুমাত্র পুরোহিত করেন। অর্থাৎ বাকি ক্ষেত্রে আমরা থাকি। সমস্ত আচার পালনে আমাদের দিক থেকে একই রয়েছে সব। তবে চণ্ডীপাঠ বাবার পরে এখন পুরোহিত করেন, পরিবারের কোনও সদস্য করেন না। সেটাই চলছে। কারণ, আমি চণ্ডীপাঠ খুব একটা ভাল পারি না,” স্মৃতিচারণ করেন অভিজিৎ।
২০২০-এর পর থেকে পুজো আসলেই আরও খারাপ লাগে ওঁদের। উৎসবের আবহেই মিরাটি বেদনায় বুঁদ হয় আবার। যে দুঃখ আজীবনের, তারই মাত্রা বাড়ে ফের। প্রণব-স্মৃতি হিল্লোল তোলে মুখার্জি ভবনের কোণায় কোণায়। তবুও পুজো হয়। সব চলতেই থাকে জোরকদমে। পিতামহ, পিতার দেখানো পথেই সমস্ত কাজে মুখ্য ভূমিকা নেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। নবপত্রিকা স্নান থেকে শুরু করে কাঁদর ঘাটের জল, ভোগ বিতরণ থেকে অতিথি আপ্যায়ন- সর্বত্রই অংশ নেন প্রণবের একমাত্র পুত্র।
প্রসঙ্গত, মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় ভোগ এক অন্যরকম ভূমিকা পালন করে আসছে বরাবর। প্রণব-সময়ে বা তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরের পুজোর ক্ষেত্রেও তার খুব একটা অন্যথা হয়নি। প্রণব মুখোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে সমস্ত কাজের মধ্যেই এই ভোগের ক্ষেত্রেও তদারকিতে মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনি। আর এবার? “এবারও একইভাবে ভোগের ব্যবস্থা হয়েছে। সকলের জন্য প্রসাদ থাকবে। যে কেউ আসতে পারেন। পুজোর চারদিন প্রসাদ বিতরণ চলবে। বহু মানুষের সমাগম ঘটে আমাদের বাড়ির পুজোয়, সেটাই হবে এবারও। যদিও করোনার সময়ে এই প্রসাদ বিতরণে একটু সময় লেগেছিল, ফাঁকা ফাঁকা বসানো, বিধি মানার জন্য সতর্ক ছিলাম আমরা। আশাকরি, এবার আর সেই সমস্যা হবে না,” বললেন অভিজিৎ।
আরও পড়ুন-ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই
পুজো হচ্ছে। স্মৃতি আর ইতিহাসের সরণি বেয়ে পুজোর উৎসব পৌঁছেছে মিরাটির প্রণব-গৃহে। ছোট্ট পল্টুর আলপথের ইতিহাসের বিবর্তনে যে পুজো বারবার শিরোনামে এসেছে, আলোকিত হয়েছে মুহূর্তেই, সেই পুজোয় খামতি নেই এবছরও। আচার, অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মাতৃবন্দনার মিলনের ক্ষেত্র বিরচিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত সকলেই। তবুও প্রাণের পুজোয় প্রণব নেই, প্রোটোকলের তোয়াক্কা নেই আর। শুধুই আছে পুজো আর উৎসব। যা প্রণব-স্মৃতির ধারক বললেও হয়তো খুব একটা ভুল হবে না!
রাজনৈতিক জীবন। কংগ্রেস-যাপন। ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহ। রাজীব-বিদ্রোহ। নতুন দল তৈরি। রাজীব-মৃত্যু। বিরোধী দলনেতা। সাংসদ জীবন। দিল্লির অলিন্দ। বিদেশমন্ত্রক। অর্থ সামলানো। ছোটখাটো বাঙালি এই মানুষটির জীবন ছিল ঘটনাবহুল। দেশের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে প্রণবের পদ-যাপন অভিনব। অনেকেই বলেন, ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক আঙিনায় তাঁর মতো বহুবিধ প্রতিভা বিরল। যার পরিপূর্ণতা ঘটে ২০১২ সালে। দেশের এক নম্বর নাগরিক হন, পরবর্তীতে ভারতরত্ন প্রণব। স্ত্রী-বিয়োগে বিধ্বস্ত প্রবীণ মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনের আঘাত রপ্ত হয়নি কর্মের ক্ষেত্রে। দিল্লি আর কলকাতাকে গুলিয়ে যাননি তিনি। প্রত্যেক মুহূর্তে কঠিন প্রত্যয় আর এযাবৎকালের প্রেক্ষিতে একাধিক রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। বঙ্গের রাজনীতি, বাম-বিরোধিতা আবার কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের আমলে বামদলকে কাছে টানা। একাধিক ক্ষেত্রের সংকটমোচনেও আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর। গান্ধী পরিবারের প্রভাবের কংগ্রেসের সঙ্গে 'দ্বিতীয়' তকমা জুটেছে তাঁর নামের সঙ্গেই। মনমোহন সিং জমানার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও তিনিই থেকেছেন অনন্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছেও প্রণব মুখোপাধ্যায় হয়েছেন প্রণবদা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নরেন্দ্র মোদি- একাধিক বিতর্ক আর টানাপড়েনের মধ্যেও প্রণব থেকেছেন অভিনব। ব্যক্তিত্ব আর জ্ঞানী রাজনীতিকের উপাধি জুটেছে সহজেই। সনিয়া-আবহে খানিকটা কংগ্রেস-বিচ্ছেদের মধ্যেই প্রণব হয়েছেন রাষ্ট্রপতি। আজীবনের বিরোধী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (RSS) নাগপুরে পা পড়েছে তাঁর। তবুও তিনি থেকেছেন অবিচল। এক বাঙালি, ভারতীয় সেরা ব্যক্তিত্ব, যাঁর কাছে সমস্ত কাজের মধ্যেও এই পুজো থেকেছে মৌলিক। যেখানে সাদা বস্ত্রের পবিত্রলগ্নে প্রণব-মুখে উচ্চারিত হয়েছে, যা দেবী সর্বভূতেষু...। আর সেখানেই আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মুখার্জি ভবন’। মিরাটির দুর্গাপুজো জড়িয়ে নিয়েছে এক ইতিহাস, যা ব্যতিব্যস্ত করেছে এক অমোঘ আকর্ষণকে। প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিভেদ আর বিদ্বেষও, যেখানে প্রণবের ভূমিকা ব্যতীত ঠিক আর কী ছিল, বহুবার মাথা খুঁটেও মনে করতে পারছেন না প্রায় কেউই।