বিজেপির প্রচারে গিয়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা! দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা তারকার!
Soundarya Helicopter Crash: হেলিকপ্টার ক্র্যাশে আসলে চারজন নয়, মারা গিয়েছিল পাঁচজন। মারা গিয়েছিল সৌন্দর্যার অনাগত সন্তানও।
ভারতবর্ষে এমন একজনই অভিনেত্রী ছিলেন যিনি ভারতের পাঁচটি বড় ইন্ডাস্ট্রির অর্থাৎ বলিউড, তামিল, তেলগু, কন্নড় এবং মালয়লাম সিনেমার সবচেয়ে বড় সুপারস্টারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি শ্রীদেবী নন। এই অভিনেত্রীর নাম জানেন না অনেকেই। অথচ তাঁর বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে মৃত্যু সবটাই ছিল আস্ত এক সিনেমা। তিনি সৌন্দর্য (Soundaraya)। ডাক্তারির ছাত্রী হয়েও সিনেমার জগতে চলে এসেছিলেন সৌন্দর্যা। আর সিনেমার পর্দা থেকে সোজা চলে এলেন রাজনীতির আঙিনাতে। আজকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেই দেখা যায় চলচ্চিত্রের সুপারস্টারদের দিয়ে নির্বাচনী প্রচার করাতে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন সিনেমার তারকারা। এই রীতি ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বহু বছর ধরেই চলে আসছে। সৌন্দর্যাকেও এই একই ‘স্টার ফ্যাক্টরের’ কারণে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিল বিজেপি।
২০০৪ সাল, দেশে তখন ভোটের আমেজ। বিজেপি এবং কংগ্রেস দুই দলই সিনেমার সুপারস্টার এবং সমাজের বিশিষ্টজনদের নিজেদের দিকে টানতে সচেষ্ট। সেই বছর অন্ধ্রপ্রদেশে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন ছিল একইসঙ্গে। অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল তেলগু দেশম পার্টি সেইসময় এনডিএ জোটের অন্যতম শরিক। টিডিপি সুপ্রিমো তথা অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু তখন নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক যুদ্ধ লড়ছেন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার (Anti Incumbency) লড়াই! সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসের মুখ ওয়াই রাজশেখর রেড্ডি (YRS)। রাজশেখর রেড্ডি এই সময় একটি পদযাত্রা করেন গোটা অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়ে। এই পদযাত্রার ফলে গোটা রাজ্য জুড়ে চন্দ্রবাবু বিরোধী স্রোত বইতে থাকে। এবার চন্দ্রবাবুর বৈতরণী পার করাতে উদ্যত হয় বিজেপি। বাজপেয়ী ক্যাবিনেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং অন্ধ্রপ্রদেশের নেতা, ভেঙ্কাইয়া নাইডুর উপর দায়িত্ব বর্তায় অন্ধ্রপ্রদেশ ‘ম্যানেজ’ করার। ভেঙ্কাইয়া নাইডু প্ল্যান করেন স্টার ক্যাম্পেইনিংয়ের অর্থাৎ তারকাকে দিয়ে প্রচারের। এই সময় তিনি যোগাযোগ করেন তাঁর পূর্ব পরিচিত এবং দক্ষিণি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বড় নায়িকা সৌন্দর্যার সঙ্গে। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিজেপিতে যোগ দেন সৌন্দর্যা।
জোর কদমে চলতে থাকে নির্বাচনী প্রচার। ১৭ এপ্রিল ২০০৪, সৌন্দর্যার প্রচার করতে যাওয়ার কথা ছিল করিমপুরে। সেদিন দুপুর দুটো নাগাদ যোগ্যুর ফ্লায়িং ক্লাব থেকে হেলিকপ্টারে চাপেন অভিনেত্রী। হেলিকপ্টারে উপস্থিত ছিলেন চারজন- পাইলট জয় ফিলিপ, সৌন্দর্যা, সৌন্দর্যার ভাই তথা ম্যানেজার অমরনাথ এবং স্থানীয় বিজেপি নেতা জি রমেশ। শেষনাগ-১৮০ হেলিকপ্টারটি মাটি থেকে বড়জোর ১০০ মিটার উঠেছিল। পাইলট ফিলিপ বুঝতে পারেন হেলিকপ্টার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, হেলিকপ্টারটি সোজা গিয়ে ক্র্যাশ করে নিকটবর্তী গান্ধী কৃষি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের ময়দানে। ক্র্যাশের তীব্র শব্দ পেয়ে আশপাশ থেকে ছুটে আসেন মানুষ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিস্ফোরণ হয়। কয়েকজন দূরে ছিটকে গিয়ে পড়েন। তৎক্ষণাৎ পুলিশ এবং দমকলে খবর দেওয়া হয়। দমকল এসে আগুন নেভায় এবং চারটি দেহ উদ্ধার করে। দেহগুলি এতটাই ঝলসে গিয়েছিল যে শনাক্ত করাও মুশকিল হয়ে পড়ে কোনটি কার দেহ। সৌন্দর্যার এমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই শোকের পাহাড় ভেঙে পরে অনুরাগী এবং সহকর্মীদের মাথায়। কেউই মানতে পারছিলেন না তাঁদের প্রিয় অভিনেত্রীর এমন করুণ পরিণতি। কিন্তু হেলিকপ্টার ক্র্যাশে আসলে চারজন নয়, মারা গিয়েছিল পাঁচজন। মারা গিয়েছিল সৌন্দর্যার অনাগত সন্তানও। সেই সময় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সৌন্দর্যা! ২০০১ সালে আমেরিকার এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেছিলেন এই অভিনেত্রী। ৩ বছর পর খুশির খবর আসতে চলেছিল পরিবারে, কিন্তু তা এসে পৌঁছনোর আগেই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেন সৌন্দর্যা।
আরও পড়ুন- এমার্জেন্সির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! আজীবনের জন্য এই অভিনেত্রীর গলার স্বর কেড়ে নিয়েছিলেন ইন্দিরা!
জানলে অবাক হতে হয়, এত বড় অভিনেত্রী হওয়া সত্ত্বেও লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জগতে আসার কথাই ছিল না সৌন্দর্যার। কথা ছিল না রাজনীতিরও। তাহলে কীভাবে এসবের সূত্রপাত? শুরু করা যাক শুরু থেকেই। ১৮ জুলাই ১৯৭২ সাল। তেলুগু ইন্ডাস্ট্রির নামজাদা অভিনেতা তথা প্রযোজক কে এস সত্যনারায়ণের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৌন্দর্যা। সৌন্দর্যা ছিল ‘স্টেজ নেম’, আসল নাম ছিল সৌম্যা সত্যনারায়ণ। ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন তিনি, ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবেন। দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে যান সৌম্যা। বেশ চলছিল ডাক্তারির পড়াশোনা। ২০ বছরের সৌম্যা তখন বাড়িতে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছেন। এই সময় কে এস সত্যনারায়ণের কাছে আসেন তাঁর এক পুরনো বন্ধু। নিজের পরবর্তী সিনেমায় সৌম্যাকে নায়িকা হিসেবে নিতে চান তিনি। প্রস্তাব শুনে তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেন সৌম্যা কিন্তু শেষমেশ বাবার অনুরোধে রাজি হয়ে যান। একপ্রকার গরমের ছুটি কাটানোর উপায় হিসেবেই অভিনয়কে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় সৌম্যার প্রথম ছবি ‘গন্ধর্ব’, যা বক্স-অফিসে ব্লকবাস্টার হয়। এই ছবির পরেই পাকাপাকিভাবে সিনেমার দুনিয়ায় চলে আসেন সৌম্যা। দেখতে ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী, তাই তাঁর নতুন নাম হয় ‘সৌন্দর্যা’। পৃথিবীতে ক'জন মানুষই বা পারেন নিজের নামের প্রতি এমন সুবিচার করতে?
আরও পড়ুন- ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার…
যাই হোক, গন্ধর্ব ব্লকবাস্টার হওয়ার পরে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলে সৌন্দর্যার অভিনয় জীবন। নাগার্জুন, ভেঙ্কটেশ, অর্জুন শারজা থেকে শুরু করে চিরঞ্জিবী, মোহনলাল, কমল হাসান, রজনীকান্তের বিপরীতেও অভিনয় করেছেন সৌন্দর্যা। সৌন্দর্যার দ্বিতীয় সিনেমা ছিল ‘পবিত্র বন্ধন’। এই সিনেমাটি পরবর্তীকালে বলিউডে রিমেক হয় ‘হাম আপকে দিল মে রেহতে হ্যায়’। রজনীকান্তের সঙ্গে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল ‘পদয়াপ্পা’, যা পরবর্তীকালে বলিউডে রিমেক হয়ে তৈরি হয় ‘ভুল-ভুলাইয়া’। ১৯৯৯ সালে অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে ‘সূর্যবংশম’ ছবিতে সৌন্দর্যার বলিউডে অভিষেক হয়। সারাজীবনে কেবলমাত্র ওই একটি বলিউড ছবিতেই অভিনয় করেছেন সৌন্দর্যা। নিজের জীবনের শেষ ছবি ‘আপ্তামিত্র’-তে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার মোহনলালের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন সৌন্দর্যা। ২০০৪ সালের অগাস্ট মাসে মুক্তি পায় সেটি। কিন্তু ততদিনে সৌন্দর্যা পাড়ি দিয়েছেন সেই লোকে যেখানে হিট-ফ্লপের অঙ্ক অর্থহীন।