নিরুদ্দেশ মানুষকে খুঁজবে কিউআর লকেট! ২৪-এর তরুণের আবিষ্কার ঘিরে শোরগোল দেশে
QR Lockets for Missing People : QR কোডগুলি স্ক্যান করা হলে, যে ব্যক্তি এটি পরে আছেন তার সম্পর্কে যোগাযোগের বিশদ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সহজেই মিলবে।
বেশ কিছুকাল আগেও খবরের কাগজের পাতায় জ্বলজ্বল করত হারানো-প্রাপ্তির একগুচ্ছ বিজ্ঞাপন, 'সন্ধান চাই' লেখা বিজ্ঞাপন। হালে সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে উঠেছে নিরুদ্দেশ ঘোষণার অস্ত্র। মাধ্যম বদলেছে ঠিকই তবে হারানো মানুষদের সংখ্যা বদলায়নি, নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প আজও একই। মানুষ হারিয়ে যায়, ঠিকানা ভুলে, পথ ভুলে, স্মৃতি ভুলে, দুর্ঘটনায়, দলছুট হয়ে, অপরাধের আঁধারে মানুষ হারিয়ে যায়। কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। পুলিশ কাউকে কাউকে ফেরাতে পারে, কেউ কেউ স্রেফ 'সন্ধান চাই'-এর ছেঁড়া, বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপন হয়েই থেকে যান। এই ডিজিটাল বিশ্বে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে পেতে এক ডিজিটাল সমাধান খুঁজে বের করেছেন অক্ষয় রিডলান। যত্রতত্র মানুষ এখন বারকোড, কিউআর কোড স্ক্যান করেন। নিখোঁজ মানুষদের সন্ধানে এই QR-ব্যবস্থাকেই হাতিয়ার করেছেন তিনি। কিউআর কোডের লকেট, কিউআর কোডের দুল দিয়ে মানুষের হারিয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন অক্ষয়। ডিমেনশিয়া এবং অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত, বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য এই কিউআর লকেট ভীষণ উপকারী বলেই মনে করছেন তিনি৷
মানুষ হারিয়ে যায়, আর মানুষ হারানো পরিবারগুলি কিছুকাল চরম ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যান সকলেই। তবু, হারানো মানুষটির কথা গলার কাছে দলা পাকানো অবস্থায় রয়েই যায়। প্রিয়জনকে খুঁজতে থাকা সেই স্বজনরা, বছরের পর বছর ধরে ভাবতেই থাকেন ফিরবেন সেই আপনজন। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ বলছে, এই ডিজিটাল যুগেও, বিভিন্ন রকমের ট্র্যাকিং ডিভাইস থাকা সত্ত্বেও, ভারতে প্রতি মাসে ৬৪,৮৫১ জন মানুষ নিখোঁজ হন।
এমন কোনও উপায়ই কি নেই যাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের অবস্থান জেনে বা মানুষটি যে হারিয়ে গেছেন তা বুঝতে পেরে সহনাগরিকরাই তাঁদের ঘরে ফিরতে সাহায্য করতে পারেন? এই ভাবনা থেকেই অক্ষয় রিডলানের উদ্ভাবন। ২০১৯ সালে UPSC পরীক্ষা দিয়েছিলেন অক্ষয়। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র পড়তেন পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই। তখনই নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনগুলি নতুন করে ভাবায় তাঁকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০। নিখোঁজ শিশুদের কথা ভেবে ছটফটানি বাড়তেই থাকে অক্ষয়ের। বিশেষ করে একজন অটিস্টিক শিশু, তরুণ গুপ্তের কথা তাঁকে অদ্ভুত যন্ত্রণা দেয়। ১ অক্টোবর, ২০১৯ সালে নিখোঁজ হয়েছিল সেই শিশু। শিশুটিকে সাহায্য করার বদলে একজন আরপিএফ অফিসার তাঁকে ট্রেনে তুলে দেন। সেই শিশু এবং সন্তানহারানো বাবা মায়ের কথা ভেবে স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন অক্ষয়।
View this post on Instagram
বেশিরভাগ মানুষ, যারা হারিয়ে যান, হয় তাদের পরিচয় ভুলে যান বা ঠিকানা। সাধারণত ডিমেনশিয়া, বয়স-সম্পর্কিত অক্ষমতা বা অন্যান্য মানসিক অক্ষমতার মতো অসুস্থতায় ভুগছেন তারা। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুরা এবং অটিজমে আক্রান্তদেরও হারানোর ঝুঁকি বেশি। প্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাধান তৈরির সিদ্ধান্ত নেন অক্ষয়। এই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চেতনা প্রকল্প চালু করেন তিনি। QR ট্যাগ দিয়ে তৈরি লকেট, কানের দুল তৈরি করেন অক্ষয়। এই QR কোডগুলি স্ক্যান করা হলে, যে ব্যক্তি এটি পরে আছেন তার সম্পর্কে যোগাযোগের বিশদ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সহজেই মিলবে। মূলত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সহ দুর্বল রোগীদের সাহায্য করার লক্ষ্যেই এই কিউআর লকেট তৈরি। হারিয়ে যাওয়া মানুষের এই QR লকেট স্ক্যান করলেই তাদের চিকিৎসার অবস্থা, জরুরি যোগাযোগ এবং বাড়ির ঠিকানার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য মিলবে।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) রিপোর্ট বলছে, আনুমানিক ৮.৮ মিলিয়ন ভারতীয়, যারা ষাটোর্ধ্ব তারা ডিমেনশিয়াতে ভুগছেন। ডিমেনশিয়ায় স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, মনে রাখা এবং যুক্তিবোধের ক্ষতি হয়। অ্যালঝাইমার্স রোগ ডিমেনশিয়ার অন্যতম কারণ। ডিমেনশিয়া আক্রান্তদের বা শিশুদের কাছে সাধারণত কোনও ট্র্যাকিং ডিভাইস থাকে না। ফলে একবার হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া ভীষণ সমস্যার হয়ে যায়। এই কিউআর লকেট থাকলে, যদি কোনও ব্যক্তি হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেঙ্গালুরুও পৌঁছে যান, সেখানে কেউ যদি QR স্ক্যান করেন তাহলে একটি বিজ্ঞপ্তি পাবেন। নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ বাড়বে। QR-ভিত্তিক ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেমের প্রতিটি দুল তৈরি করতে অক্ষয়ের ২০০ টাকা খরচ হয়।
অক্ষয় এর আগে, এবছরের গোড়ায় পথকুকুরদের জন্যও এই জাতীয় QR ট্যাগ তৈরি করেছিলেন। বিশেষ QR কোডটিতে প্রাণীটির নাম, লিঙ্গ, অভিভাবকের নাম, ফোন নম্বর এবং টিকা বা স্টেরিলাইজেশনের ইতিহাস সব তথ্যই লেখা থাকত। মানুষ হোক বা পোষ্য বা পথের পশু, হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে ঘরে ফেরানোর জন্য সমস্ত চেষ্টাই করছেন অক্ষয়। আশা, একদিন খবরের কাগজে, লিফলেটে হারিয়ে যাওয়া মুখের সংখ্যা কমে আসবে। মানুষ নিজের বাসাটুকু ফিরে পাবেই।