বঙ্গের রথকথা, কোথায় কেমন উদযাপন

জগন্নাথদেবের দাদা বলরাম বা বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা এই তিন ভাই বোন মিলে রথযাত্রার দিন রথারোহণ করেন এবং মাসির বাড়ি গিয়ে ন'দিন অবস্থান করেন। ভগবানের নতুন রূপে আবির্ভাব, ইতিহাস ও লোকবিশ্বাস সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে এই রথযাত্রা...

রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কল্পকাহিনি আর পুরাণের মিশেল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর আচার প্রথার বর্ণনা এবং একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। 'রথ' শব্দটির অর্থ কোন প্রকার যানবাহন অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি। আমরা জানি পৌরাণিক কাহিনীতে রথের ব্যবহার হতো যুদ্ধক্ষেত্রে। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সেনা নায়কেরা রথে চড়ে যুদ্ধ করেছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে 'রথ'শব্দের অর্থ কিন্তু ভিন্ন। তাঁদের কাছে রথ একটি কাঠের তৈরি যান যাতে চেপে স্বয়ং ভগবান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করেন। শ্রদ্ধার দিক থেকেও এটির গুরুত্ব অপরিসীম। ভগবানের এই রথে চড়ে আহরোণই 'রথযাত্রা' বলে পরিচিত আমাদের কাছে। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগন্নাথ দেবের রুপে আবির্ভূত। জগন্নাথদেবের দাদা বলরাম বা বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা এই তিন ভাই বোন মিলে রথযাত্রার দিন রথারোহণ করেন এবং মাসির বাড়ি গিয়ে ন'দিন অবস্থান করেন। ভগবানের নতুন রূপে আবির্ভাব, ইতিহাস ও লোকবিশ্বাস সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে।

প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা আয়োজিত হয়ে থাকে। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা হয়। লোকবিশ্বাস জগন্নাথ দেব এই স্নানযাত্রার দিনেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।স্নানযাত্রার দিন ১০৮ ঘড়া জল দিয়ে বলরাম,সুভদ্রা ও জগন্নাথদেব-কে স্নান করানো হয়,এর পরই অসুস্থ হয়ে তিনি একান্ত বাসে থাকেন চৌদ্দ দিন। এই সময় চলে তাঁর ফলাহার, শুকনো খাবার এবং ডাক্তার বদ্যি। নানারকম পথ্য দিয়ে তাঁকে সুস্থ করানো হয়। ১৪ দিন পরে তিনি সাজসজ্জা করে রথে আরোহন করেন এবং মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে তিনটি রথ বার হয়। প্রথম যাত্রা শুরু করেন তাঁর বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র। বলরামের রথের নাম 'তালধ্বজ'। রথটির ১৪-টি চাকা উচ্চতা ৪৪ ফুট, রথের আবরণের রং নীল।

এরপর যাত্রা করেন বোন সুভদ্রা। তাঁর রথের নাম 'দর্পদলন'। রথটির উচ্চতা ৪৩ ফুট। এই রথের মোট ১২ টি চাকা। রথটির ধ্বজায় পদ্ম চিহ্ন আঁকা থাকে, তাই রথটি কে 'পদ্মধজ'ও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রং লাল।

সর্বশেষ রথটি জগন্নাথ দেবের রথ। এই রথটির নাম 'নন্দীঘোষ'। এর পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা আছে।। সেই কারণে এই রথের আরেক নাম 'কপিধ্বজ'।রথটির উচ্চতা ৪৫ ফুট। এতে আছে ১৬ টি চাকা।এর আবরনে রং হলুদ।

তিনটি রথের আবরণীর রং আলাদা হলেও প্রত্যেকটি রথের উপরিভাগ লাল রঙেরই হয়ে থাকে।

ভগবান শ্রী চৈতন্যদেব বাংলায় এসে রথযাত্রার প্রচলন করেন। পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ দেবের আরাধনা করা হয়। পশ্চিমবাংলায় কিছু কিছু স্থানের রথযাত্রা ভারত বিখ্যাত এবং এর মাহাত্ম্য অপরিসীম।

মাহেশ

মাহেশের রথযাত্রা যে কত পুরনো তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের দিক থেকে দেখা যায় যে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ কমলাকর পিপলাই ১৫৩৩ সালে মাহেশে জগন্নাথ দেবের প্রথম সেবায়িত নিযুক্ত হন ; এবং সেই সময়ের কিছু পরেই জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। অনেকের মতে ১৩৯৬ সালে মহেশের রথযাত্রা শুরু। তবে এটা সহজেই অনুমেয় যে, হুগলি জেলার মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। মাহেশের রথ এই বছর ৬২৬ বছরে পদার্পণ করল। মাহেশে আগে ছিল কাঠের রথ। পরবর্তীকালে কলকাতার শ্যাম বাজারের বসু পরিবারে তত্ত্বাবধানে লোহার রথ তৈরি করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল রথটির বারবার পুড়ে যাওয়া। মার্টিন বান কোম্পানির তৈরি এই লোহার রথের বয়স ১৩৭ বছর। এই রথের উচ্চতা ৫০ ফুট, ওজন ১২৫ টন। রথে আছে লোহার তৈরি ১২টি চাকা। এখানে একটি লোকশ্রুতি শোনা যায়, একদা মাহেশের রথের চূড়ায় এক নীলকন্ঠ পাখি এসে বসত। কিন্তু পুরীর রথযাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে উড়ে চলে যেত। তারপরেই মাহেশের রথের চাকা ঘুরত। যদিও সেসব জনশ্রুতি কালের অন্তরালে হারিয়ে গেছে।বর্তমানে আর সেসব কিছুই হয় না।মাহেশের রথ উপলক্ষে সুবিশাল একটি মেলা বসে। বাংলার প্রাচীনতম এই রথের মেলার বর্ণনা আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাধারানী' গল্পেও পেয়ে থাকি।

মায়াপুর

পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম বিখ্যাত রথযাত্রা হলো মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী মায়াপুরের পাশে রাজাপুর নামে একটি গ্রাম ছিল।এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বৎসর আগে এক পুরোহিত স্বপ্নে দেখেন রাজাপুর থেকে মায়াপুরে প্রস্থান করবেন জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা, তারপর সেখান থেকে আবার রথে চড়ে ফিরে আসবেন তাঁরা রাজাপুর গ্রামে। এই প্রথা মতই প্রতিবছর মায়াপুর ও রাজাপুর গ্রামের রথ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এখন ইসকন মন্দিরের তত্ত্বাবধানে রথযাত্রা পালিত হয়। বর্তমানে একটি অস্থায়ী গুন্ডিচা দেবীর মন্দির তৈরি হয় এবং সেখানেই ন'দিন রথে জগন্নাথদেব,বলরাম ও সুভদ্রা অবস্থান করেন। এই রথযাত্রা উপলক্ষে মায়াপুরে ন'দিন ধরে চলে কীর্তন এবং বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান।

গুপ্তিপাড়া

১৭৪৫সালে(মতান্তরে ১৭৪০) গুপ্তিপাড়ায় রথ উৎসবের সূচনা করেন মধুসূদানন্দ। এখানে রথযাত্রার দিন ৪০ কুইন্টাল খাবার বিতরণ করা হয়।বহু কাল ধরে জনগণের উদ্দেশ্যে এই খাবার বিতরণের প্রথাটি প্রচলিত রয়েছে। আসলে ভগবানের উদ্দেশ্যে 'লুট' দেওয়া হয়। গুপ্তিপাড়ার রথের উচ্চতা ৩৬ ফুট ।এই স্থানে শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয় ধর্মের মানুষই বসবাস করেন ।১৮৭৩ সালে গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির থেকে ১৩ চাকার রথ বার হতো। গন্তব্য ছিল জগন্নাথের পিসির বাড়ি।কিন্তু ১৮৭৩ সালে একটি দুর্ঘটনার পর সেই রথের চাকার সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়ায় সুবিশাল একটি মেলা বসে। বহুদূর থেকেও মানুষ গুপ্তিপাড়ায় উপস্থিত হন রথের মেলা দেখবার জন্য। ন'দিন ধরে চলে এখানে উৎসব অনুষ্ঠান।

রাজবলহাট

রাজবলহাট শুধুমাত্র তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত নয়। এখানে আছে শ্বেতকালী প্রতিমা। এছাড়া এখানকার রথযাত্রাও সুবিখ্যাত ।রাজবলহাটের রথে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি থাকে না। এখানে "রাধাকৃষ্ণ" রথের উপর সওয়ার হয়ে বার হন। এটি এখানকার বিশেষত্ব। আরো একটি বিশেষত্ব এই ১২ চাকার বিশাল রথ রশির সাহায্যে টানা হয় না। টানা হয় লোহার শিকলের সাহায্যে।রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। মানুষ আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন।

মহিষাদল

মাহেশের মতোই পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল এর রথযাত্রা সুবিখ্যাত।এই রথযাত্রার ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরনো।১৭৭৬ সালে মহিষাদল-এর জমিদার আনন্দলালের স্ত্রী জানকি দেবী এখানে রথযাত্রা সূচনা করেন। দেওয়ান আনন্দ ঘোষের ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, রথটি যখন তৈরি হয় তখন এটি ছিল চার তলা। ১৭টি চূড়া বিশিষ্ট, ৩৪টি লোহার চাকাযুক্ত একটি সুবিশাল রথ। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৬০০০০সিক্কা।

অন্য একটি সূত্র বলে রানী জানকি নন, মতিলাল পাঁড়ে এই রথযাত্রা উৎসবে সূচনা করেছিলেন। অপুত্র অবস্থায় রাজা আনন্দলাল এবং রানী জানকি দেবী মারা গেলে মতিলাল নিজেকে পোষ্যপুত্র হিসেবে দাবি করেন এবং সিংহাসন দখল করেন। এই নিয়ে মামলা মোকাদ্দমাও হয়। আগের তুলনায় মহিষাদলের রথের জৌলুশ অনেকটাই কমে গিয়েছে, কিন্তু এই উৎসব নিয়ে মানুষের আবেগ উন্মাদনা আজও বিদ্যমান।

আমেদপুর

বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রাম আমেদপুর। এখানে গ্রামের জমিদার বাড়ির কুলো দেবতা "রাধামাধব"। প্রতিবছর এখানে রথযাত্রার দিন "রাধামাধব" রথে চেপে প্রথমে পৌঁছান দুর্গা বাড়ি(মা দুর্গার মন্দির), পরে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন।

এছাড়াও পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। এর মধ্যে এর মধ্যে বিখ্যাত বারুইপুরের রায় চৌধুরী বাড়ির রথ,কালনার রাজবাড়ীর রথ, বর্ধমানের রাজবাড়ীর রথ। ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবের সময় কাল থেকে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা নিয়ে বাঙালির মনে অপরিসীম ভাবাবেগ আছে। এটি হিন্দুদের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়, সঙ্গে চলে যাত্রাপালা। শোনা যায় একসময় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর স্ত্রী "মা-সারদা" দেবী,নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ বিখ্যাত ব্যক্তিরা রথের মেলা পরিদর্শন করতে আসতেন।

More Articles