উদ্বাস্তুদের মানচিত্র কোথায়? কীভাবে বাংলাদেশে ভিটেহারা হয়ে এলেন রোহিঙ্গারা?
Rohingya refugees in Bangladesh: পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থেও ‘রোসাঙ্গ’ শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয়। রোসাঙ্গ শব্দটি স্থানীয় ভাষা ‘রোহাঙ্গ’ বলে উচ্চারিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
এত উদ্বাস্তু! মাথার উপর নীল পলিথিন! এত কান্না! এত মৃত্যু! ঘুমন্ত মনে ভয়ার্ত সাইরেন। এই সময়টা কি উদ্বাস্তুদের শতাব্দী? ভিটে হারানো মানুষের শতাব্দী? মানচিত্র হারিয়ে যাওয়া মানুষের শতাব্দী? কিন্তু এই শতাব্দী বা কেন, বহু যুগ ধরেই তো মানচিত্র হারানো মানুষের মিছিল থামছে না! মানচিত্রে যাদের ঠাঁই নেই, কোন প্রার্থনালয়ে তাদের ঠাঁই হবে? মুখ গুঁজে পড়ে থাকে মানুষ। গোল্ডফিশের জীবন নিয়ে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। পৃথিবী বলে, দিচ্ছি তো সব আর চাই কী? উদ্বাস্তুদের কাছে উত্তর বুঝি বা কখনই থাকে না। লক্ষ-কোটি প্রশ্ন নিয়ে ওরা দিবারাত্রি পাড়ি দেয়। রেশনের লাইনে চাল-ডাল-তেল-নুন কী দেওয়া হলো, বা হলো না, তাতে কী এসে যায়! আপনাকে যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মানচিত্র থেকে বের করে দিয়ে বলা হয়, জীবনধারণের জন্যে সর্বরকম দ্রব্যাদি আপনি পাবেন অন্য দেশে? বিশ্বাস করি, এমত প্রস্তাব কেউ মানবেন না। রিফিউজি লাইনে দাঁড়াতে সম্মত হবেন না। রিফিউজি বা উদ্বাস্তু নিয়ে আখ্যানেই কেবল একটা ফ্যান্টাসি তৈরি করা যায়। ইতিহাসের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। বাস্তবিক জগতে এ শব্দরা কোনও ভবিষ্যত দেখতে পারে না।
ইহুদি থেকে রোহিঙ্গা— জগতের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্বাস্তু হয়ে। ৪৭-এর দেশভাগ, তার আগে বা পরে কত গল্প! ধর্মের রাজনীতি মানচিত্র থেকে মানুষকে আলাদা করে দিল। ভিটে ছেড়ে এপার থেকে হিন্দুরা ওপারে যেতে বাধ্য হলো। ওপার থেকে মুসলিমরা এপারে আসতে বাধ্য হলো। কবি থাকলে ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো’র স্থানে বলতেন, মানুষ তুমি কি ভিটে হারাইয়াছো? ধর্মীয় বা জাতিগত হিংসা ও যুদ্ধ মানুষকে উদ্বাস্তুদের ভেলায় উঠিয়ে দিয়েছে। অতিনিকটের ভিটেহারা জনগোষ্ঠী যারা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পশ্চিম সীমান্তের বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে কক্সবাজার জেলার উখিয়া টেকনাফে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
আরও পড়ুন- প্রায় ৭০ বছর পরিচয়হীন! কলকাতার বুকে একখণ্ড বার্মা কলোনিতে যেভাবে বাঁচেন উদ্বাস্তুরা
কেন ওরা ভেসে এল? ভেসে যায় খড়কুটো। ভেসে যায় কলার ভেলা। ভেসে যায় পানা ফুল। ভেসে যায় ডিঙ্গি নৌকা। সেই ভেসে যাওয়ার দৃশ্য মানুষের মনে এক শৈল্পিক প্রভাব ফেলে। কিন্তু মানুষের লাশ ভেসে যাবে। বানের স্রোতের মতো মানুষ ভাসে, প্রাণ ভাসে। এ কোন শতাব্দীতে আমরা ভেসে এলাম? যেন ভাসানের পালা চলছে। রোহিঙ্গারা কেন ভেসে এল মায়ানমারের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশে? কোন মানচিত্রেই বা এরা ঠাঁই নেবে? ইতিহাসমতে, ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ সাল ছিল আরাকান রাজা থিরি থু ধম্মা বা সিকন্দার শাহের রাজত্বকাল। সেই সময় কবি মরদন লিখেছিলেন, "ভুবনে বিখ্যাত আছে রোসাঙ্গ নগরী/রাবণের যেহেন কনক লঙ্কাপুরী।’
সুতরাং ষোড়শ শতকেও আরাকানে বাংলাভাষি এই রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল বলে ধারণা করা যায়। ১৬৫১ থেকে ১৬৭৩ সাল। আরাকানের রাজা তখন থদো মিংদার। মহাকবি সৈয়দ আলাওলের কাব্য রচনার সময়। কবি তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘বহু মুসলমান সব রোসাঙ্গে বৈসেন্ত/ সদাচারী কুলীন পণ্ডিত গুণবন্ত।’ পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থেও ‘রোসাঙ্গ’ শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয়। রোসাঙ্গ শব্দটি স্থানীয় ভাষা ‘রোহাঙ্গ’ বলে উচ্চারিত হয় বলে ধারণা করা হয়। সাহিত্য ইতিহাসের এক অন্যতম দিক নির্দেশক। আরকান সাহিত্যে রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহার না থাকলেও এই শব্দের আদিরূপ রোহাঙ্গ বা রোসাঙ্গ সহজেই লক্ষ্যণীয়। রোহাঙ্গ বা রোসাঙ্গ ছিল আরাকানের রাজধানী। সেই থেকে ধারণা করা হয়, রোহাঙ্গ বা রোসাঙ্গতে বসবাসকারীদের বলা হতো রোহিঙ্গা। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুথানের পর জেনারেল নে উইন ক্ষমতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করেন।
তৎকালীন বার্মার সরকার নে ইউনের ভাষ্যে, এরা সকলেই পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসী। বিশেষত যারা ১৮২৬ সালের ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধের পর প্রবেশ করেছেন বার্মায়, তারা কোনওপ্রকারেই নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন না। ফলে ১৯৪৮-১৯৫৮, ১৯৬০-১৯৬২ পর্যন্ত যে উ নু সরকার রোহিঙ্গাদেরকেও বার্মায় ১৩৫ টি জনগোষ্ঠীর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল সেটি অকেজো হয়ে পড়ে। মায়ানমারের রাষ্ট্রজনরা বলছেন, ১৯৫০ সালের পূর্বে এই শব্দটির কোনও ব্যবহার ছিল না। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও পরবর্তী বিভিন্ন সময় থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধচলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এই জনগোষ্ঠী বার্মায় ঢুকে পড়ে। ইতিহাস কেবল যুক্তি খোঁজে আর ঘটে যাওয়া ঘটনা লিখে রাখে। তবু, উত্তর মেলে না উদ্বাস্তুদের মানচিত্রের ঠিকানা কোথায়?
আরও পড়ুন- কখনও বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা, কখনও মৃত্যু, গোটা বছর সমুদ্রেই কাটল রোহিঙ্গাদের জীবন
শরণার্থী স্রোতে ভাসতে ভাসতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন বাংলাদেশে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন বার্মা এবং ভারতের দোরগোড়ায়, তখন প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সমুদ্র উপকূল কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাহাড়, উপত্যকা, সমতল, সৈকত ও বিভিন্ন দ্বীপে আশ্রয়গ্রহণ করে। ২০১২ সালে মায়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এক লাখ বিশ হাজার মানুষ গৃহচ্যুত হয়, যারা অধিকাংশই রোহিঙ্গা। দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব হারায়। ২০১৫ সালে মায়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের আগে আন সান সু চি-র কাছ থেকে আশার আলো প্রতিফলিত হলেও নির্বাচনের পরে তা নিভে যায়। অতঃপর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের সীমান্ত নিকটবর্তী মায়ানমার সীমান্তে সশস্ত্র হামলায় ৯জন সীমান্ত রক্ষী নিহত হলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মায়ানমার সেনাবাহিনী নির্মম প্রতিশোধ নেয়। মংডু শহরে দেড় হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা-লুঠ-ধর্ষণ অমানবিক নির্যাতন চলে। ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা ভেসে চলে আসে বাংলাদেশে। মায়ানমার রাষ্ট্রপ্রধান সব অভিযোগকে অস্বীকার করে। এরপর থেকে প্রতিদিন আসছে উদ্বাস্তু, প্রতিদিন ভাসছে।
তাহলে স্বভূমি থেকে উৎপাটিত মানুষের ঈশ্বর কে? এই যে, ১০-১১ লক্ষ বা তার বেশি মুসলিম মানুষ এবং ৫০০ বা তার বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাদের আল্লাহ বা ভগবান কে? ইদ চলে গেল, পুজো আসছে। জোড়া শালিখেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কাশবন জুড়ে। ঝলমলে পোশাক দোকানির আলমারির ভাঁজে প্রহর গুনছে মহালয়ার। খেটে খাওয়া মজুরের মনে ঝিঙেফুল, রোদ্দুর। মোহনবাঁশি বেজে চলেছে শরৎের আকাশে। মা আসছেন। তবু কাদের যেন হঠাৎ করে আঙুলের নখ পিশাচের মতো হয়ে গেছে। সুললিত জিহ্বাসর্পের ন্যায়, কিশোরীর ঝুঁটির মতো মাথায় শিং গজিয়েছে মানবের। সম্মুখ পাটির দুটো দাঁত শজারুর কাঁটার মতো বেরিয়ে এসেছে। ওদের সর্বশরীর ক্রমশ লোমসর্বস্ব হয়ে উঠছে। অদ্ভুত দোলাচলে পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে অসুরবিনাশিনীর সামনে। আবির্ভাব হব নব প্রজন্মের। সে প্রজন্ম যুদ্ধ নয়, ভালোবাসবে মাটি। মাঠ-মাঠ সরষে খেতে আবাদ করবে। সর্ষে ফুলের হলদে রঙ মুছিয়ে দেবে সকল ভাসানের ব্যথা। তবু উদ্বাস্তুরা কি ঈশ্বর খুঁজে পাবে?