দেশের বিচারপতিরা এখন সরাসরি সঙ্ঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে?

Akhil Bharatiya Adhivakta Parishad: দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যে ৩৩ জন বিচারপতি আছেন, তাঁদের অন্তত ৯ জন কোনও না কোনও সময়ে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের নানা অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছেন।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি অবসর নিলেন। সেই অবসরের কিছুকাল আগে একটি অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, রামমন্দিরের রায় দেওয়ার সময়ে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। একটি দেশের প্রধান বিচারপতি কেন সংবিধানের পরিবর্তে ঈশ্বরের সাহায্য চেয়েছিলেন? তিনি যত সহজে বিষয়টি বলে ফেলেছেন, গোটা বিষয়টি কি এতটাই সরল? না কি তাঁর এই বক্তব্যের পিছনে আছে গভীর শিকড়? কথা উঠেছিল, তিনিও কি আরএসএসের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, না কি অবসরের পরে অন্য কোনও নিশ্চিত পুরস্কারের আশায় রামমন্দিরের ওই রায় দিয়েছিলেন ডিওয়াই চন্দ্রচূড়? গণেশ পুজোয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর পর থেকে শুধু রামমন্দির সংক্রান্ত রায় নয়, তাঁর দেওয়া আরও বেশ কিছু রায় নিয়েই তাই প্রশ্ন উঠেছে এখন। প্রশ্ন উঠছে, ভারতীয় সংবিধানের ঐতিহ্যকে লঙ্ঘন করলেন নাকি চন্দ্রচূড়? আরএসএস কি তবে বিচারপতি চন্দ্রচূড়কেও তাঁদের মতো করে ব্যবহার করে নিল?

১৯২৫ থেকে একশো বছর কেটে গেছে। ভারতীয় সমাজে আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে। আরএসএস শুধুমাত্র একল বিদ্যালয় চালিয়ে বা পড়াশোনার সিলেবাসে বদল এনে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। সঙ্ঘ আইনজীবী এবং বিচারপতিদের নির্বাচনেও বড় ভূমিকা রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেছে। এবিভিপি শুধু ছাত্রদের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করেনি, আইনজীবীদের জন্যও আছে নির্দিষ্ট সংগঠন, অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ। আরএসএস এবং বিজেপি যা যা আইন আনবে, সেই আইনগুলোকে দেশের আদালতগুলিতে, বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতে আড়াল করা এবং তার সপক্ষে আইনানুগ যুক্তি সরবরাহ করাটাই তাদের কাজ। মজার বিষয় হলো, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যে ৩৩ জন বিচারপতি আছেন, তাঁদের অন্তত ৯ জন কোনও না কোনও সময়ে ওই সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছেন।

আরও পড়ুন- রাম মন্দিরের রায় দিতে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়?

২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ একটি যুগান্তকারী রায় দেয়। ওই রায়ের ক্ষেত্রে কোনও মতানৈক্য ছিল বলে জানা নেই। সেই সাংবিধানিক বেঞ্চের অন্যতম একজন ছিলেন চন্দ্রচূড়। ঐতিহাসিক সেই রায়ে বলা হয়েছিল, সরকারের পক্ষ থেকে যেন একটি ‘ট্রাস্ট’ গঠন করা হয়, যাদের দায়িত্বে ও তত্ত্বাবধানে অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে
রামমন্দির নির্মাণ হবে। তার কিছুদিন পরেই, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যখন ওই রায়ের পুনর্বিবেচনার জন্য আবার ১৮টি আবেদন করা হয় তখন তারা সেই আবেদন তৎক্ষণাৎ খারিজ করে দেন। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অর্থাৎ সিবিআই জানায় বিজেপি নেতা
লালকৃষ্ণ আদবানি সহ যে ৩২ জনের বিরুদ্ধে বাবরি মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ছিল, তাঁরা নির্দোষ। তারা এও জানায়, আদবানি সহ অন্যান্যদের নাকি বাবরি মসজিদ ভাঙার কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাত্র
কয়েকমাস আগে, ২২ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদি রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার অনুষ্ঠানে ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন, এই রায়ের মধ্যে দিয়েই বিচারব্যবস্থা তার সত্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ভুলে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি সেদিন বলেছিলেন, "প্রভু রাম হচ্ছেন ভারতের বিশ্বাস, ভিত্তি, ধারণা, আইন, সচেতনতা, ভাবনা, মর্যাদা এবং গৌরব।"

যে বছর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়, সেই ১৯৯২ সালেই আরএসএসের এই আইনজীবীদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। এই মুহূর্তে সারা ভারতের আইনজীবীদের এটিই সর্ববৃহৎ সংগঠন। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে বিজেপির এতটাই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে যে, আইনজীবীদের এই সংগঠনটি আরও সক্রিয় হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে আরএসএসের নিজস্ব বেশ কিছু পুরনো ধ্যানধারণার সফল রূপায়ণ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, জনসঙ্ঘ স্থাপন এবং পরবর্তী সময়ে বিজেপির আত্মপ্রকাশের সময় থেকেই তাদের স্লোগানে বাবরি ধ্বংস এবং রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এসেছে। শুধু তাই নয়, বাবরি ধ্বংসের পরে তারা কাশী এবং মথুরা নিয়েও নামতে চায়।

কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং দেশজুড়ে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোও তাদের মাথায় ছিল। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি থেকে শুরু করে নতুন অপরাধ আইন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইনি সহায়তা এবং পরামর্শ দিয়ে গেছে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ।
বিচারব্যবস্থাকে করায়ত্ত করতে তারা এমন বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে যাদের বেশিরভাগই আরএসএসের মতাদর্শে বিশ্বাসী। নিচুতলার প্রায় সমস্ত জেলা ও ট্রায়াল কোর্টের বিচারপতিদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে শুরু করে, বিভিন্ন মামলায় তাঁদেরকে সরকারের এবং আরএসএসের পক্ষে রায় দেওয়ানো- এই সমস্ত কিছুই করে চলেছে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ। তাঁদের পত্রিকা, ‘ন্যায়প্রবাহ’-তে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে, বিভিন্ন বিচারপতি এবং বিশিষ্ট আইনজীবীদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং নতুন নতুন আইনজীবীরা সেই পত্রিকার গ্রাহক হয়ে, সেই প্রবন্ধ পড়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত গড়ে তোলেন।

আইনজীবীদের এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা দত্তোপন্থ থেঙ্গাডীর দীর্ঘ আরএসএস-ইতিহাস আছে। তাঁর বাবা ছিলেন স্বনামধন্য আইনজীবী। তিনি নিজে আইন পাশ করলেও, মূলত তাঁর মায়ের অনুপ্রেরণাতেই ছোট বয়স থেকে আরএসএসের শাখার সদস্য হন। নাগপুরে গুরু গোলওয়ালকরের সঙ্গে দেখা করেন তারপরে তাঁর প্রচারক হন ১৯৪২ সালে। ৯০ দশকের প্রথম থেকেই তিনি ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এবং আরএসএস প্রভাবিত কৃষক সংগঠনের হয়ে কাজ করা শুরু করেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে যখন আদবানি তাঁর রথযাত্রা বের করেছিলেন, তখন সেখান থেকেই কিছু করসেবক গিয়ে বাবরির মিনারে আঘাত করেন। সেই সময়ে পুলিশ গুলি চালায়। ততদিনে দত্তোপন্থ থেঙ্গাডী বেশ কিছু আইনজীবী এবং প্রাক্তন বিচারপতিদের নিয়ে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ গঠন করে ফেলেছেন। সেই বিচারপতিদের তালিকায় ছিলেন উমেশ ললিত, যিনি ছিলেন আমাদের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের বাবা। তিনিই প্রথম বাবরি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। দত্তোপন্থ থেঙ্গাডীর বহুদিনের বক্তব্য, সংবিধানকে নতুন করে লেখা প্রয়োজন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে সংবিধানে যে ২৯ এবং ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদ আছে, তাতে সংখ্যলঘুরা আরও বিচ্ছিন্ন বোধ করে, তাই ওই অনুচ্ছেদগুলো সংবিধান থেকে সরানোর প্রয়োজন।

আরও পড়ুন- আরএসএসের তৈরি জমিতে ব্যাট করে এখন সঙ্ঘকেই লাথি! BJP-RSS সম্পর্কে ইতি?

এই মুহূর্তে বাংলার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের যে কমিটি তৈরি হয়েছে, সেই কমিটির প্রধান উদয় উমেশ ললিত, যিনি নিজে একসময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন, কিছুদিন আগে দিল্লিতে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের একটি বড় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেই একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী রাম জেঠমালানির পুত্র মহেশ জেঠমালানি এবং এই মুহূর্তে বিজেপির দিল্লির সাংসদ বাঁশুরি স্বরাজ, যিনি আবার সুষমা স্বরাজের কন্যা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে সাম্প্রতিক সময়ে যে ৩৯ জন আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছেন, তার মধ্যে ৩০ জন ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মহেশ জেঠমালানি নিজে সেখানে বক্তব্য রাখার সময়ে বলেন, নতুন অপরাধ আইনের খসড়া তাঁর হাতেই তৈরি। যদিও স্বরাষ্ট্রদপ্তর তাতে কিছু রদবদল করেছে পরে, কিন্তু আমাদের বিচারব্যবস্থা কতটা আরএসএস প্রভাবিত, তা বুঝতে এই তথ্যটাই কি যথেষ্ট নয়? প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ললিত বলেন নতুন অপরাধ আইন পুরনো আইনগুলোর খামতি পূরণে সক্ষম। টেলিফোনে আড়িপাতা বা পুলিশি স্বীকারক্তিগুলিকে এই আইন মান্যতা দেবে, যা অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। 

সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, আগামীতে যাঁরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হতে চলেছেন তাঁদের অনেকেই নানা সময়ে অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের নানা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ এখন আর কোনও চরমপন্থী সংগঠনের আইনজীবী সরবরাহের কাজে লাগানো হয় না, এখন নিম্ন আদালতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এই সংগঠন। প্রায় প্রতিটি বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এখন অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের পছন্দের মানুষ। এই সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রধান, কৈলাশ তামোলি বলেছেন, "আমাদের সংগঠনের অনেকেই পরবর্তী সময়ে বিচারপতি হয়েছেন।" তাহলে কি আমাদের বিচারব্যবস্থা আদৌ নিরপেক্ষ? আগামীতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও কি তাহলে আরএসএসের সংগঠন অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের মনোনীত বিচারপতিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবেন? বিচারব্যবস্থা থেকে শিক্ষা সবক্ষেত্রেই গত একশো বছরে আরএসএস তাদের প্রভাব বাড়িয়ে  খণ্ডিত ভারতবর্ষের দিকেই কি এগিয়ে দিচ্ছে না আমাদের?

More Articles