এ লড়াই নিজের বিরুদ্ধে নিজের
Rape Culture and Masculinity: প্রায় নব্বইটি ধর্ষণ প্রত্যহ ঘটে ভারতে। কোনও নির্দিষ্ট ধর্ষণের ঘটনার বেশ কিছুদিন প্রচারের আলো জুটলে, তবেই এসব আলোচনা শুরু হয়।
১
এক মফসসলি স্কুলের কথা বলি। বয়েজ স্কুলে ক্লাস সিক্সে মহা শোরগোল। এক ছেলে কোনও এক শিক্ষিকার নামে মন্দ, অশ্লীল কথা লিখেছে দেওয়ালে বা বেঞ্চে। তাকে টিসি দেওয়ার বন্দোবস্ত পাকা। এই সুযোগে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে সে ক্লাসের আরও অনেক ছাত্র। কেন? সেই কারণগুলি অবশ্য গ্রাফিতির থেকেও ভয়াবহ।
দোষী বছর বারোর ছাত্রটি, শিক্ষিকাকে নিয়ে অশালীন লেখালেখি করার আগেই, তার দ্বারা আক্রান্ত হয় তারই শ্রেণির অনেক ছেলে। সে হাত দিত তাদের যৌন অঙ্গে। এ বয়সে কৌতূহলহেতু নিজের বা অন্যের যৌন অঙ্গে হাত দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। সেরকম কিছু? শোনা গেল, সেখানেই থেমে নেই বিষয়। আক্রান্ত যে ছেলেরা, তারা প্রতিবাদ করলে দোষী নাকি বলত, ‘আমি তোদের ছুঁয়ে দিয়েছি। এবার তোরা নষ্ট হয়ে গেছিস। তোরাও খারাপ। শাস্তি তোরাও পাবি।’ আশ্চর্য ব্যাপার, ছেলেরা বিশ্বাস করেছিল, তারাও খারাপ হয়ে গেছে। তাদেরও ‘হেডস্যার’ শাস্তি দেবেন। তাই তারা এতদিন বলেনি।
ভুক্তভোগীদের কথাগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যৌন অঙ্গ নিয়ে লজ্জা, ব্যক্তির যৌন অঙ্গ কেউ তার অনিচ্ছায় ছুঁয়ে দিলে ব্যক্তির নিজেকে দোষী ভাবার এই প্রবণতা বয়ঃসন্ধির ছেলেদের মধ্যেও বর্তমান। অথচ অনেকে ভাবেন, ভিক্টিম-ব্লেমিং-এর সার শুধু মেয়েরাই আত্মস্থ করে। তারা জানে না, সম্মতির মানে এবং গুরুত্ব। জানলে সহজেই বুঝতো, তাদের শরীরের সীমারেখায় অনুমতিহীন প্রবেশ করেছে যে, দোষী একমাত্র সে-ই।
অথচ, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে, এই ছেলেদের চরিত্রে এক ব্যাপক, উথাল-পাথাল পরিবর্তন আসবে৷ তখন তারা ‘ভিক্টিম’ থেকে ‘পারপিট্রেটর’ হয়ে ওঠার পথে পা বাড়াতে পারে। যে ছেলেরা এখন পুরুষাঙ্গ নিয়ে লজ্জায় ভুগছে, তারাই তখন এমন নানা অপশব্দ ব্যবহার করবে, যা পুংযৌন অঙ্গের সমার্থক। সেসব শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমেই, তারা ভাববে, তাদের অভিষেক ঘটছে ‘পৌরুষে’। লজ্জা-সঙ্কোচ ঘুচবে বটে, কিন্তু যৌনতা নিয়ে কোনও সুস্থ বোধেও তাদের পৌঁছনো হবে না। তার বদলে অতিযৌন বাচনভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বাড়বে নারীবিদ্বেষী ভাষার মাত্রা। পুরুষ পাঠকেরা নিজেদের অষ্টম-নবম শ্রেণিকালীন কৈশোর মনে করলে, হয়ত অনেকেই নিজেদের সেই অবতারে খুঁজে পাবেন।
আরও পড়ুন: আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে কি পিতৃতন্ত্রকেই বাঁচাতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট?
এবার আসি,দোষীর প্রসঙ্গে। তার আচরণে অতিযৌনতার সম্ভাব্য কারণ কী কী? এক, অন্যদের তুলনায় বয়ঃসন্ধির দ্রুত আগমন এর কারণ হতে পারে। দুই, জিনগতভাবে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির চেয়ে বেশি যৌনক্ষুধাসম্পন্ন হতে পারে। দুঃখের বিষয়, বাবা-মা বা সমাজ পেটুক খোকাদের চুরি করে বা কেড়ে খেতে যেমন করে মানা করেন, যৌনতা পেলেই হামলে পড়তে মানা করেন না তেমন করে। যৌনতা নিয়ে শিক্ষা দিতে তাঁদেরও আছে সঙ্কোচ। তাঁরাও সেভাবে কখনও যৌনশিক্ষা পাননি। তিন, পর্ন দেখা, পর্ন বই পড়া ছেলেদের বেড়ে ওঠার অঙ্গ ছিল চিরকালই। কিন্তু লকডাউন কালে অনলাইন ক্লাস করার প্রয়োজনে অপরিণত ছেলেদের (এবং মেয়েদেরও) হাতে এসেছে মোবাইল। ফলে, এমন যৌন কন্টেন্ট তারা পাচ্ছে, যা হজম হওয়া এ বয়সে মুশকিল৷ ছেলেটি তার বন্ধুদের ইউটিউবের এমন কিছু চ্যানেলের নাম বলেছিল, যেখানে যৌন সুড়সুড়িমূলক ছবি দেখা যায়। উল্লেখ্য, পর্ন দেখাও কিন্তু পুং শিশুর ‘পৌরুষে’ অভিষিক্ত হওয়ার অন্যতম শর্ত। অথচ, তাতে যৌনতায় উভয়পক্ষের সম্মতি যে প্রয়োজন, সে ধারণা যায় ঘেঁটে। যদিও প্রো-পর্ন ও নো-পর্ন, দুই গোষ্ঠীর নারীবাদী আছেন, এবং যদিও ফেমিনিস্ট পর্নের ধারণাও বর্তমানে বিবেচনাধীন, তবু এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাজার-চলতি পর্নে আসক্তি থাকলে নারীদের যৌনতায় অংশগ্রহণ, যৌনতায় বলপ্রয়োগের সীমা, যৌনতায় সম্মতির গুরুত্ব ইত্যাদি অনেক কিছু সম্পর্কে ভুল ধারণাই গড়ে ওঠে।
প্রশ্ন হল, দোষী ছেলেটি, যে কিনা কখনও সঠিক যৌনশিক্ষা পায়নি, কিংবা শেখেনি ‘কনসেন্ট’-এর ধারণা, তাকে কি টিসি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যায়? এসব শেখানোর দায় ছিল বাবা-মা ও শিক্ষকের। পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের স্কুলে কোনো স্কুল-কাউন্সেলর নেই, নাহলে কিছু দায় তাঁর উপরেও বর্তাতো। শিক্ষক এবং বাবা-মায়ের যে প্রজন্ম, নিজেদের শৈশব-কৈশোরে তাঁরা দেখেছেন— যৌন বিষয়ে ঠোঁটসেলাই থাকতে হয়। তাঁরাই বা এ বিষয়ে কোন আলো দেখাতে পারেন?
ধরা যাক, কোনও মেয়ের ‘না’ শুনে কোনও ছেলে আহত। ক'জন ছেলে বাবা-মাকে সে কথা বলে কাঁধে মাথাটি রাখতে পারবে, বিশেষত খানিক-সচেতন শহরবৃত্ত ছাড়িয়ে, মফসসলে বা গ্রামে? শহরবৃত্তেই বা কজন বাবা-মা এই সুযোগে শেখাবেন, ‘না-কে সম্মান জানানো কর্তব্য?’ আবার, ছাত্রবৎসল পুরুষ শিক্ষককেও দেখেছি, এরকম এক ক্ষেত্রে, ছাত্রকে বলতে, ‘পড়াশোনা করলে, ভাল চাকরি করলে, এরকম মেয়ে অনেক পাবি।’ এখানেও, মেয়ের ‘না’ বলার অধিকারকে মর্যাদা দেওয়ার বদলে, ‘মেয়ে'-কে এমন এক ‘বস্তু’ রূপে দেখানো হল, যা বড় বড় সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া যায়— যেন ট্রফি। ছেলে তবে সঠিক ভাবনা শিখবে কোথায়?
যে দুটি ঘটনার কথা বলা হল, সেসব ঘটেছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মফসসলি ছেলেদের স্কুলে। কখনও শিক্ষক, কখনও বা জেন্ডার-ওয়ার্কশপের রিসোর্স পারসন হিসেবে ছেলেদের বেড়ে ওঠার সেই সময়টির সাক্ষী থাকতে হয়েছে, যে সময় থেকে তাদের জীবনে তথাকথিত ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’-র প্রকোপ বাড়ে। অথচ তার আগে পর্যন্ত তারা সকলেই থাকে কোমল ও সুকুমারমতি।
এবার শহরের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কথায় আসি। শহরের বাড়ন্ত বয়সের ছেলেদের (এবং মেয়েদের) জন্যও দুশ্চিন্তা কম নয়। তাদের রয়েছে আশৈশব গুড-টাচ/ ব্যাড-টাচ শিক্ষা, আছে স্কুল-কাউন্সেলর, আছে বার্ষিক জেন্ডার ওয়ার্কশপ। তা-ও যেন এসব যথেষ্ট নয়, কিংবা প্রচেষ্টা গতানুগতিক।
একটি ছেলে, বয়স দশ, তার দাবি- 'আই হ্যাভ বলস্ অফ স্টিল।' স্বরভঙ্গের আগেই মিহি স্বরে এমন নানা ভাবে সে ‘পৌরুষ’ প্রকাশ করে। দশ বছরের বাচ্চাও ভাবে, ‘লৌহকঠিন পৌরুষ’ তার 'লৌহকঠিন' পুরুষ-অঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয় (আশ্চর্যভাবে, আসলে যে অঙ্গ দুর্বলতম ও সবচেয়ে সংবেদনশীল)। প্রায় সব ইংরেজিমাধ্যম স্কুলেই 'ফাক্' কথাটি মোটামুটি আট-নয় বছর বয়স থেকে বলা শুরু হয়, গোপনে। বাংলা চার-অক্ষর/পাঁচ অক্ষর এগারো-বারো থেকে তারা অর্থসহ জেনে যায়, কিন্তু তার ব্যবহার স্কুলে করে না। (কোনও কারণে বাংলাটা কি তাদের বেশি অশ্লীল মনে হয়?) স্কুলের গাড়িতে অবশ্য বাংলা গালাগালিও চলে। পুরুষাঙ্গ বোধক গালাগালি এবং সরাসরি রেপ-রেটোরিক ব্যবহার করে গালি মোটামুটি চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স থেকে তারা শেখে। তাদের ভাষা দিন-দিন হয়ে ওঠে সেক্সিস্ট, ‘লকার-রুম টক।’ এছাড়া, 'ফেমিনিস্ট' ও 'ফেমিনিজম' তাদের সকলের কাছে বেশ ঘৃণিত শব্দ৷
শহর-মফসসল-গ্রাম নির্বিশেষে, এদের জীবনে ‘প্রেমের’ উদ্গম হয় মোটামুটি দশ-এগারো থেকে। এক্ষেত্রে ছেলেদেরই মূলত দায় থাকে 'প্রোপোজ' করার ও 'মেয়ে পটানোর'। মেয়েরা 'প্রোপোজিত' হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়। কোনও কোনও বাচ্চা ছেলে এতই চৌখশ যে তারা বিধিসম্মত ফ্লার্টিং-এর ভাষাতেই কথা বলে৷ সেখানেও নারী অভীষ্ট বস্তু— যা হাসিল করতে হবে। পারস্পরিক সম্মানের ধারণা পিছু হটে যায়।
একশটির মধ্যে নব্বইটি ছেলেই যেহেতু এমন আচরণ করে, তাই বুঝতে হয়,বাতাসেই বিষ ছিল৷ তাছাড়া আছে 'পিয়ার প্রেশার'৷ বাকি দশটি ছেলের, তথাকথিত 'সপ্রতিভ' হওয়ার 'পিয়ার প্রেশার'-এ, ওই একই দিকে হাঁটা সময়ের অপেক্ষা৷ এমনকী, ‘পিয়ার প্রেশারে’ মেয়েদেরও এইসব ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে, বিশেষত কো-এড স্কুলে। বাতাসের সেই বিষকে আমরা চিরাচরিত ভাবে 'পেট্রিয়ার্কি' আর অধুনা ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ নামে ডাকি, তাই না?
এই ছেলেদের সাহায্য করার কেউ নেই, অথচ এদের গভীরভাবে সাহায্যের দরকার৷ নাহলে এরা হেটেরোসেক্সুয়াল সম্পর্কে শান্তি দিতে পারবে না শুধু নয় (কারণ অন্যদিকে মেয়েরা অধিকার-সচেতন হয়ে উঠছে, ‘মেইল ইগো’ কেউ সহ্য করবে না); এরা নিজেরাও শান্তি পাবে না। পদে পদে এদের 'পৌরুষ' আহত হতে বাধ্য৷
বাচ্চাদের চরিত্রগঠন একবার হয়ে গেলে (যা চোদ্দোর মধ্যেই হয়ে যায়), আমূল পরিবর্তনের আশা খুব কম। এরা কলেজে গিয়ে হয়ত কিছু ফেমিনিস্ট লব্জ শিখবে। জানবে, স্কুলে যেমন খিস্তি দেওয়া 'কুল', কলেজেও ওইসব তত্ত্ব আওড়ানো 'কুল।' কিন্তু অন্তরের পরিবর্তন প্রায় দুঃসাধ্য।
এমনিতেই, বয়ঃসন্ধি এগিয়ে এসেছে দশ-এগারোয়, ইন্টারনেটের দৌলতে। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে বয়ঃসন্ধি সামলাতেও যে বাবা-মা-শিক্ষকেরা খুব প্রস্তুত থাকতেন, তা নয়। দশ-এগারোতে তাঁরা আরওই প্রস্তুত নয়। যাবতীয় যৌন-শারীরিক, যৌন-সামাজিক বিষয়ে বাচ্চারা বন্ধুবৃত্তের আলোচনার মাধ্যমে ভুলপথে ভুল শিখত আগেও, এখনও শেখে। সে যৌন-অঙ্গ হোক বা যে কোনও শারীরিক যৌন প্রকাশ, নিজের শরীরকে বুঝতে বাচ্চা যদি কেবল বাচ্চারই সাহায্য পায়, তাহলে পথ কীভাবেই বা সঠিক হবে? একইভাবে, অন্য লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক, অন্য লিঙ্গ ও অন্য যৌন-পছন্দের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব— এসব ব্যাপারেও বাচ্চা অন্য বাচ্চাকে পথ দেখাবে কীভাবে? এ বড়দেরই দায়িত্ব ছিল। বড়দেরও কি এ ব্যাপারে আলো দরকার?
এত কথা হয়, এত উদ্যোগ— অথচ ছেলেদের, মূলত বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে সর্বাত্মক ভাবে লিঙ্গসচেতনতার কাজ অপ্রতুল৷ আমরা সবাই চরম কিছুর অপেক্ষা করি, যেমন ধর্ষণ।
আজও এক নির্মম ধর্ষণ ঘটেছে বলেই এ সম্পর্কে আলোচনার অবতারণা হয়েছে। আসলে, শুধু ধর্ষণ ঘটলেও যে এ আলোচনার অবতারণা ঘটে, তা নয়। প্রায় নব্বইটি ধর্ষণ প্রত্যহ ঘটে ভারতে। কোনও নির্দিষ্ট ধর্ষণের ঘটনার বেশ কিছুদিন প্রচারের আলো জুটলে, তবেই এসব আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু অবতারণা যখন হয়েছেই, তখন উপরে বর্ণিত স্কুলের ঘটনাগুলির সঙ্গে, বা ধর্ষণ সংস্কৃতির সঙ্গে, প্রকৃত ধর্ষণের ঘটনার সম্পর্ক কী— তা আবার বোঝানোর প্রয়াস নেওয়া যাক৷
২
ধর্ষণ সংস্কৃতি কী? তা কি নারীবাদীদের কল্পনা-পোষিত মিথ ও মিথ্যা? অনেকেই মনে করেন, ‘রেপ কালচারের’ অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টার মধ্যে, বা ‘বিষাক্ত পৌরুষ’ (টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি) কথাটির মধ্যে একরকম পুরুষ-বিদ্বেষ আছে। যেন পুরুষমানুষ মাত্রকেই ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে। তাই কি? দোষারোপ পিতৃতন্ত্রকে যদিও বা করা হয়, পুরুষকে করা হচ্ছে কি? ধর্ষণ সংস্কৃতি বলে যদি কিছু থাকে, তা কি শুধু পুরুষ বহন করে নাকি বহন করতে পারে মহিলারাও?
প্রথমেই মনে রাখা ভাল, যখন আমরা বলি, সবাই ধর্ষণ সংস্কৃতিতে বাস করছি/ করছো / করছেন, তখন তা আবশ্যিকভাবে আমার-আপনার দ্বারা কৃত কোনও অপরাধকে সূচিত করা হয় না। 'ধর্ষণ সংস্কৃতি' পরিভাষাটি অপরাধকে নয়, অপরাধের উৎসস্থলকে নির্দেশ করে। তাই ধর্ষণ সংস্কৃতির নাম শুনলেই ‘ডিফেন্সিভ’ হয়ে পড়ার দরকার নেই। 'রেপ কালচার'-এর ধারক ও বাহক একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শুধু পুরুষেরা নয়, মেয়েরা বা প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতা গোষ্ঠীর মানুষরাও হতে পারেন, অজ্ঞাতেই।
'রেপ কালচার' শব্দবন্ধটি ইউনাইটেড স্টেটসের নারীবাদীরা বিংশ শতকের সত্তরের দশকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। 'রেপ: দ্য ফার্স্ট সোর্সবুক ফর উইমেন' বইতে প্রথমে এই পরিভাষা ব্যবহৃত হয় বলে মনে করা হয় (১৯৭৪)। ১৯৭৫ নাগাদ ও তার পরবর্তী সময়ে পরিভাষাটি নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিস্তার ঘটে।
সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ভাবে 'সংস্কৃতি' বা 'কালচার' বলতে আমরা বুঝি, এমন কিছু কাজ বা আচরণের সমষ্টি যা সমাজের প্রায় সবাই পালন করেন। এই ধারণার সঙ্গে 'ধর্ষণ' শব্দটিকে মেলানো আপাত ভাবে কঠিন৷ তাই অনেকের মতে, ‘টার্ম’টি প্রায় ‘অক্সিমোরোনিক’, স্ববিরোধী। সত্যি কি তাই?
প্রাথমিক ভাবে এমন এক সংস্কৃতিকে সূচিত করতে পরিভাষাটি এসেছিল, যেখানে ভিক্টিমকেই তাঁর উপর ঘটা যৌন নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়৷ যেখানে যৌন নির্যাতন নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা, শুধু নির্যাতিতার মৃত্যু ঘটে গেলেই তা 'বিশেষ' হয়ে ওঠে। কিন্তু, তা কতটা ব্যাপক ও কতটা নিত্যনৈমিত্তিক, সে ব্যাপারেও সঠিক তথ্য পেতে বাধা দেয় এই ধর্ষণ সংস্কৃতি। সেখানে প্রাত্যহিক ভাষায়, ঠাট্টায়, মজাকিতে ধর্ষণ বা তার রূপক ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধটি সংঘটিত হলে 'ধর্ষণ' শব্দটিও আদৌ উচ্চারণ করা হবে, নাকি কোনো ইউফিমিজমের আড়ালে সেই শব্দকে ঢাকা হবে, তা নিয়ে দোলাচল থাকে৷ 'গরিমা যাত্রা'-য় (ধর্ষিতাদের পদযাত্রা) অংশগ্রহণকারী মধ্যপ্রদেশের এক ধর্ষিতা তরুণী বলেছিলেন, এক সভায় 'ধর্ষণ' কথাটি উচ্চারণ করায় সেই গাঁয়ের হেডমাস্টারমশাই বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। 'ওঁরা শব্দটা শুনেই এত নাক সিঁটকোচ্ছেন! অথচ আমরা তো সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি', বলেছিলেন তিনি।
অনেক নারীবাদীই নিজের নিজের মতো করে সংজ্ঞা দিয়েছেন ধর্ষণ সংস্কৃতির। Emilie Buchwald, যিনি Transforming a Rape Culture বইটির লেখক, তিনি ধর্ষণ সংস্কৃতিকে দেখেছেন এভাবে:
“a complex set of beliefs that encourages male sexual aggression and supports violence against women. It is a society where violence is seen as sexy and sexuality as violent.”
বাকওয়াল্ড অবশ্য ট্রান্স বা নন-বাইনারিদের কথা বলেননি। কিন্তু মূল কথাটি ফেলনা নয়৷ তিনি বলছেন, ভায়োলেন্স বিষয়টাই বেশ আবেদনপূর্ণ বা সেক্সি আমাদের সংস্কৃতিতে৷ তা আমাদের চোখে পুরুষালি, তা ক্ষমতা ও শক্তির পরিচায়ক। আর অন্যদিকে যৌনতা বলতেও আমরা হিংস্র কিছুই বুঝি৷ পারস্পরিক সহমতির ভিত্তিতে যৌনতা অনেকের কাছেই ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ নেকুপুষু ব্যাপার৷ তাই আমাদের যৌন ফ্যান্টাসিতে তার জায়গা নেই৷
এ হেন সংস্কৃতিতে রোজ বাচিক ভাবে যৌন আক্রমণ হতে পারে নারীর উপর, তার অমতে তাকে নিত্য ছোঁয়া হতে পারে,আবার চরম পরিণতি হিসেবে ধর্ষণও ঘটতে পারে৷
একটু ভাবলেই বোঝা যায়, আমাদের কথ্য ভাষায়, রূপকে, ঠাট্টা-তামাশায়, আইনে, টিভিতে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে এমনকী শিশুপাঠ্য বইতেও ধর্ষণ-সংস্কৃতির প্রভাব সর্বাত্মক।
যেমন ধরা যাক, ভারতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে 'ধর্ষণ' করে না, খেলায় হারায় মাত্র। 'ধর্ষণ' শব্দের এরকম আলটপকা ব্যবহার ধর্ষণ সম্পর্কে সামগ্রিক অসংবেদনার পরিচায়ক৷ দু'জন পুরুষ পারস্পরিক ঝগড়া-ঝাঁটিতে প্রায়শই ব্যবহার করে এমন খিস্তি, যার মধ্যে প্রতিপক্ষর মা-বোনকে ধর্ষণ করার ইঙ্গিত থাকে। ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভেও অনেকে তার মা-বোনকে ধর্ষণ করার নিদান দেয়। ছেলেরা গর্ব করে বহুগামিতা নিয়ে। মেয়েদের সম্পদ সতীত্ব। নারীর বিবাহপূর্ব স্বেচ্ছা-যৌনতাকে মেনে নিতে সমাজের অসুবিধে, অথচ নারী ধর্ষিত হলে সে আদৌ ধর্ষিত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা সকলের অধিকার। ধর্ষণকে 'শ্লীলতাহানি' ধরনের অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, যৌন হেনস্থাকে বলা হয় 'ইভ টিজিং।’ এইসব ভাষার আড়ালে তার গুরুত্ব হ্রাস করার মধ্যেও নিহিত থাকে ধর্ষণ সংস্কৃতি।
ধর্ষণ হলে ধর্ষিতার নাম ও পরিচয় জানার জন্য যত আগ্রহ, ধর্ষকের পরিচয় নিয়ে মানুষের তত উৎসাহ থাকে কি? শিশুপাঠ্য বই-এ থাকে প্রসেরপাইনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার রোমান গল্প। কিংবা বিস্ট-এর বিউটিকে জোর করে আটকে রাখার গল্প অবলীলায় শিশু মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
নারী যে কোনও সীমারেখা লঙ্ঘন করলে, সে রাজনীতিতে অংশ নিলে বা ঠোঁটে সিগারেট ঝোলালে বা তার জামার ঝুল ছোট হলে বা তর্কে হার স্বীকার না করলে বা স্রেফ বিরুদ্ধমত পোষণ করলেই তার যৌনাঙ্গ আলোচিত হয়। নায়িকার পিছনে তার অসম্মতি অগ্রাহ্য করে ধাওয়া করা হল এক বলিউডি রোমান্টিকতার ধরন। নারীকে 'চিজ', 'মাল', 'চিকনি চামেলি', 'তন্দুরি মুর্গী' ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হতে দেখতে দেখতে নারী ও পুরুষ উভয়েই বড় হয়। সামাজিক মাধ্যমেও নারীর ছবি মর্ফ করে বা না করে, সেই ছবি চুরি করে, তা ছড়িয়ে দেওয়া যায় 'বেশ্যা' পরিচয় আরোপ করে। লোকাল ট্রেনের দেওয়ালে অচেনা মেয়ের নাম্বার লিখে দেওয়া হয় প্রতিশোধ স্পৃহায়। জেন্টস টয়লেটে থাকে নারীর স্তন বা নিতম্বের গ্রাফিতি। এইসব নিয়ে আমাদের ধর্ষণ সংস্কৃতি। এবং অবশ্যই ধর্ষণ সংস্কৃতি হল 'না' কে 'হ্যাঁ' বলে ধরে নেওয়া, যৌনতায় কনসেন্ট-এর ধারণাকে অস্বীকার করা।
ধর্ষণ নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া যদি দেখি, তাহলে দেখব যে তাদের নৃশংসতা নিয়ে মতবিরোধ নেই। অথচ ধর্ষণ সংস্কৃতি যে ভাষা, চুটকি, সামাজিক আদানপ্রদান, বিনোদনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা মানতে মানুষের অনাগ্রহ ভারী৷ তাঁরা ধর্ষককে এক জান্তব বহিরাগত হিসেবে দেখতে ভালবাসেন। ‘রেপ কালচার’ সমষ্টিগত ভাবে আমাদের ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধান করতে দেয় না। সেই কারণগুলির সঙ্গে সমষ্টিগতভাবে 'এনগেজ' করতে দেয় না। তাই সাংস্কৃতিকভাবে আমরা একথা মেনে নিতে আজও অপারগ যে ধর্ষক আমাদেরই মতো বন্ধু-স্বজন-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবৃত সাধারণ, এমনকী সুভদ্র মানুষও হতে পারেন।
এই আলোচনার পর আরেকবার ভেবে দেখা দরকার, তাহলে কি আমরা ধর্ষণ সংস্কৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি? কিংবা, প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত ছেলেগুলি কি ধীরে ধীরে ধর্ষণ সংস্কৃতি বা বিষাক্ত পৌরুষের শিকার হয়ে পড়ছে না? ধর্ষণ সংস্কৃতির অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা হয়, তবেই কিন্তু সকলের, বিশেষত ছেলেদের নবতর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা আসে।
৩
লিঙ্গগত বৈষম্য বা লিঙ্গগত হিংসার কথা শুরু হলেই অনেক পুরুষমানুষ ‘ডিফেন্সিভ’ হয়ে পড়েন। বোঝাতে চান যে তাঁরা অপরাধী নন। তাঁরা রেপ করেননি, মলেস্ট করেননি, কন্যাভ্রূণ হত্যা করেননি, বৌ পেটাননি। বলেন #নটঅলমেন। নারীবাদীরাও অন্যদিকে #নটঅলমেন-কে একটি বিশ্বজনীন খিল্লিতে পরিণত করেন। তাঁরা যে প্রশ্নগুলো করেন, তা হল: বেশ তো, রেপ-মলেস্ট-ভ্রূণহত্যা করোনি, কিন্তু রেপ জোক শেয়ার করোনি? কাউকে সেক্সিস্ট গালি দাওনি? ছোট জামা পরা মেয়ে দেখলে মনে মনে 'বেশ্যা' বলোনি আর চোখ দিয়ে জরিপ করোনি? বন্ধুমহলে কাউকে 'মাল' বলোনি? ছেলে কেঁদে ফেললে তাকে 'মেয়েলি' বলোনি? বউকে সিরিয়ালখোর নন-ইন্টেলেকচুয়াল ভাবোনি? তার মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে আপত্তি করোনি?
এই সকল অপরাধের মাত্রা কি সমান? না। কিন্তু নারীবাদীরা অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন, ধর্ষণ সংস্কৃতিতে সব পুরুষই কি ‘পোটেনশিয়াল রেপিস্ট’ নয়? এক্ষেত্রে‘রেপিস্ট’ কথাটায় আপত্তি থাকলে ‘পোটেনশিয়াল’ কথাটা আণ্ডারলাইন দিয়ে দায় সেরে ফেললে মনে হয় চলে না। ‘রেপিস্ট’ আর ‘পোটেনশিয়াল রেপিস্ট’-এর মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময় পথ ছিল, সে পথগুলো খুঁজে দেখাও কর্তব্য।
নারীবাদী দর্শন নিয়ে চর্চা প্রায় দু'শো বছর ধরে চলছে। এ রাজনীতি প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। সুতরাং বলা বাহুল্য, বিপক্ষ কেউ ছিলই। বিমূর্ততায় তার নাম পিতৃতন্ত্র। কিন্তু আসলে বিপক্ষ ভেবে লড়া হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের ধারকদের সঙ্গে, মূলত পুরুষদের সঙ্গে। সেই লড়াই প্রয়োজনীয়। সেই লড়াই-এই ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার, বাকস্বাধীনতা, জীবনযাত্রার স্বাধীনতা এসেছে, আরও আসবে ক্রমশ। কিন্তু আন্দোলন যেন লক্ষ্য-অভিমুখী হয়। বিরোধিতা-অভিমুখী নয়। লক্ষ্য হল সমানতা। সেক্ষেত্রে পুরুষদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব তাদের সহ-মানুষ ভেবেই নিতে হয়।
আলাপচারিতায় দেখেছি, লিঙ্গ রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত নন, এমন বহু পুরুষই 'ছেলেরা এরকম...', 'পুরুষেরা ওরকম...', কথাগুলো শুনলে সিঁটিয়ে যান বা ক্ষিপ্ত হন। তাঁদের শরীরভাষায় ‘আমি কিছু করিনি’ ‘আমি নির্দোষ’ ফুটে ওঠে। এদের নিয়েই আমাদের পরিপার্শ্ব যখন, তখন এদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে বৈকি!
এই কাজ, প্রথমত, ‘ক্যাচ দেম ইয়াং’ পদ্ধতিতে, গোড়া থেকেই করা ভাল, যেমন আগেই বলেছি। ধর্ষণের বহু-আলোচিত কোনো ঘটনার পর, নারীপুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই বলেন, 'আমার মেয়েটার জন্য খুব ভয় পাচ্ছি।' 'ভয় পাচ্ছি, ছেলেটা ধর্ষক না হয়ে যায়! খুব ভয় পাচ্ছি…',— ছেলের বাবা-মায়েরা এরকম বলেছেন কি? ভাবছেন কি? অথচ ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে তাঁদেরও কিন্তু ভয় পাওয়ারই কথা৷
মনে রাখতে হবে একথাও যে, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে।’ তাই হতে হবে সমব্যথী। এমন এক পরিসর গড়ে তুলতে হবে যেখানে পুরুষ, বিশেষত পুরুষ শিশু, তার সেই যন্ত্রণার কথা, অসহায়তার কথা বলতে পারবে, ‘প্রকৃত পুরুষ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে যে পা ভেঙে যাওয়ার বা প্রেম ভেঙে যাওয়ার বা ধর্ষিত হওয়ার যন্ত্রণা বলা হয়ে ওঠেনি। প্রাথমিক ভাবে দেখা যাবে, বলার মতো মানসিক প্রস্তুতি নেই, শোনার মতো কান যদি বা থাকে। বাধ সাধবে ভাষাও৷ পুরুষ জানে না কোন ভাষায় যন্ত্রণা ব্যক্ত করলে তার পুরুষসত্তাটি ক্ষুণ্ণ হবে না, কিন্তু ব্যথাও প্রকাশ করা হবে। পৌরুষহীন হয়ে পড়ার অলীক ভয় পুরুষকে আজীবন নিয়ন্ত্রণ করে; নিয়ন্ত্রিত হয় তার চরিত্রের বিকাশ বা বিকাশের অভাব৷ প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত উদাহরণগুলির প্রতি ছাত্র সমাজ, পারিপার্শ্বিক, শিক্ষক, বাবা-মা, আত্মীয়, পাড়াতুতো-স্কুলতুতো দাদাদের থেকে নিশ্চয় ভালো কিছু নৈতিক শিক্ষা লাভ করছে। কিন্তু সেই সঙ্গে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিও বাসা বাঁধছে প্রতিজনের মনে, আস্তে আস্তে— একই উৎস থেকে।
ভয় থেকে তাদের মুক্ত করতে পারলে, কথোপকথনের পরিসর তৈরি হলে, তারপর ক্রমে ১) জৈবিক লিঙ্গ( sex), সামাজিক লিঙ্গ (gender), লিঙ্গপরিচয়(gender identity), লিঙ্গ-নির্ধারিত আচরণ ( gendered behaviour) ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনা করতে হবে সেই শিশু-কিশোরদের সঙ্গে। এটাই সেসব আলোচনা শুরু করার উপযুক্ত বয়স। অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমরা বৌদ্ধিক চর্চার পরিসরের বাইরে এসব আলোচনাকে বেরোতে দিইনি! লিঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে তাত্ত্বিক চর্চাকে ইংরেজি ভাষা, নেম-ড্রপিং আর জার্গনের বাইরে বেরোতে দেওয়া হয়নি! এই দুই কারণের সঙ্গে আরও নানাবিধ রাজনৈতিক-সামাজিক কারণের মিশেলে আমরা জেন্ডার স্টাডিজকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে এনে ফেলতে পারিনি। অথচ আনতে হবে— শুধু যৌনশিক্ষা নয়, লিঙ্গসাম্যশিক্ষা।
আমার ওয়ার্কশপে আমি প্রায়শই ছেলেদের একটি খেলা খেলাই। কথোপকথনটি এরকম হয়:
আচ্ছা, ধরো একজন লোক মারা গেছেন৷ শ্রাদ্ধে গেছো। সবাই বলছে,'বড় ভালোমানুষ ছিলেন!’ এই শুনে কী মনে হবে তোমার? ধরো তুমি তেমন চিনতে না তাঁকে। এই ধরণের কথা শুনে তাঁর সম্পর্কে কী ধারণা হবে?
মনে হয় দয়ালু ছিলেন।
মানুষের উপকার করতেন।
সবাইকে ভালবাসতেন।
মনে হয় নেশা টেশা করতেন না।
শান্ত স্বভাবের মনে হয়, সবার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন।
পরিবারের লোকজনকে আর বন্ধুবান্ধবকে নিশ্চয় ভালোবাসতেন।
সৎ ছিলেন।
এইসব প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর আসে দ্বিতীয় প্রশ্ন।
আচ্ছা ধরো। আরেকজন লোকের বাড়ি গেছ। সে তখন উপস্থিত নেই৷ শুনলে সে একেবারে যাকে বলে, পুরুষের মতো পুরুষ৷ পুরুষসিংহ। যাকে বলে, মর্দ। এবার বলো সেই শুনে তার সম্পর্কে কী ধারণা হবে?
খুব রাগী।
কাউকে ছেড়ে কথা বলে না।
দুমদাম মারে।
খুব সাহসী। কাউকে ভয় পায়না৷
কখনও কাঁদেনা৷
কখনও হারে না, সব সময় জেতে।
সবাই তার কথায় ওঠে-বসে৷
দু'টি সেট পাওয়া যায় গুণাবলীর, এভাবে। দেখা যায় প্রথম সেটের কিছু গুণ দ্বিতীয় সেটের ঠিক বিপরীত৷ তবে কি একজন ‘ভালো মানুষ’ একজন ‘প্রকৃত পুরুষ’ হতে পারে না? এই প্রশ্নগুলো মাথায় চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যেতে হয়। আর জানতে চাইতে হয়, কাঁদলে খারাপ কী? কম বীরত্ব মন্দ কেন? ছোট ভাইয়ের প্রতি নরম-সরম মায়া, মায়ের জন্য প্রাণ-উজাড় করা আকুলি, খারাপ বুঝি? শক্ত থাকতে কারও ভালো লাগে কি সব সময়?
ভালোমানুষ আর আদর্শ পুরুষের যে তফাত, তার সূত্র ধরে তাদের বিস্তারে বোঝাতে হয় আরও কয়েকটি জিনিস। যেমন—
১) র্যাগিং বা বুলিং-এর মাধ্যমে আসলে প্রকাশ পায় ক্ষমতার আস্ফালন। এগুলি পৌরুষের আদর্শ হতে পারে। কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে নিকৃষ্ট। রেপ-এর ক্ষেত্রেও একই ক্ষমতার আস্ফালন ক্রিয়াশীল।
২) পর্ন নিয়ে, তার ভাল ও মন্দ দুই দিক নিয়েই তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা দরকার। পর্ন-এ প্রদর্শিত শরীরই আদর্শ শরীর, এমন নয়। পর্নে প্রদর্শিত প্রক্রিয়াই আদর্শ প্রক্রিয়া, এমন নয়।
৩) তাদের এও বোঝাতে হবে যে, এ বয়সে নেশাদ্রব্য অনেকেই ব্যবহার করে ‘পুরুষালি’ হয়ে উঠতে। অথচ তা আসলে নারী-পুরুষ যে কোনও জনের পক্ষেই ক্ষতিকর।
৪) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের জানাতে হবে, যৌনতায় শুধু না, প্রেমে ও সম্পর্কেও ‘কনসেন্ট’ বা সম্মতির ভূমিকা অপরিসীম। সম্মতি কোনও অন্ধ চুক্তি নয়। একবার ‘হ্যাঁ’ বললে, বা একটি যৌন ক্রিয়ার ‘হ্যাঁ’ বললে, পরের কোনো ধাপে বা পরের কোনো ক্রিয়ায় ‘না’ বলা যাবে না, এমনও নয়। প্রতিটি ধাপে একমাত্র সুস্পষ্ট ‘হ্যাঁ’ অপরপক্ষের থেকে শুনেই এগোনো যেতে পারে। কনসেন্টের বিষয়টি, ছোট ছেলেদের সাধারণত বুঝিয়ে থাকি এভাবে:
বন্ধুর টিফিন পছন্দ হলে তুমি বুঝি কেড়ে খাও?
কারও হাতঘড়ি পছন্দ হলে তুমি কি ছিনিয়ে নাও?
ইত্যাদি।
সব উত্তর স্বাভাবিক ভাবে ‘না’ হলে, তারপর আসে সম্পর্ক ও যৌনতায় ‘না’-কে গুরুত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গ।
৫) লিঙ্গ হঠাৎ উত্থিত হওয়া, রাত্রিকালীন বীর্যপাত — এসব যে স্বাভাবিক, এ ধারণাও ছেলেদের নেই। তারা এসব নিয়ে ঠিক ততটাই ভয়ে থাকে, যতটা প্রথম ঋতুস্রাব নিয়ে মেয়েরা। এই বিষয়গুলিও খোলসা করা, তাদের স্বাভাবিকতা বোঝানো দরকার।
৭) তাদেরও ‘পকসো’ আইন সম্পর্কে পাঠ দেওয়া দরকার। শুধু গায়ে বা যৌনাঙ্গে হাত দেওয়া নয়, জামা খুলতে বাধ্য করা, পর্ন দেখতে বাধ্য করা, বাচ্চাকে দেখিয়ে বড় ব্যক্তির স্বমেহনও ‘পকসো’- র আওতাভুক্ত।
৮) তাদের প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষদের সমান চোখে দেখতে শেখাতে হবে।
ছেলে শিশুর এসব জানা দরকার মেয়েশিশুর মতোই। কারণ—প্রথমত, পুরুষ শিশুরাও বহুল পরিমাণে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। দ্বিতীয়ত, এসব জানা থাকলে সে ভবিষ্যতে নিজে নির্যাতক হয়ে উঠবে না হয়তো।
৪
আর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে কী শিখতে হবে? এঁদের শেখানো কঠিন। খুব কঠিন। তবু চেষ্টা করতে হবে। প্রথমেই এদের জানাতে হবে আইন।
১) নির্ভয়া কাণ্ডের জেরে ২০১৩ সালের 'ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট' একটা বড় প্রাপ্তি, যা ভার্মা কমিটির সুপারিশকে বহুলাংশে মেনেছিল। ফেব্রুয়ারিতে অর্ডিন্যান্স পাশ, অতঃপর রাষ্ট্রপতি, লোকসভা ও রাজ্যসভার সম্মতিক্রমে নতুন আইন। এই আইন নিখুঁত নয়, তবে উন্নততর। এখানে বলা আছে, শুধু ‘vagina, anus, mouth’-এ penis এর insertion-ই ধর্ষণ নয়, তা হতে পারে আরও নানাভাবে। এখানে sexual harassment-এর সীমা বাড়ানো হয়েছে বাচিক যৌন হয়রানি, অশালীন ছবি তোলা বা জোর করে পর্ন দেখানো পর্যন্তও। এখানে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, passion নয়, power অর্থাৎ ক্ষমতা প্রদর্শনই ধর্ষণের কারণ। এখানে চূড়ান্ত গুরুত্ব পেয়েছে consent বা সম্মতির ধারণা। Consent-কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে:
‘unequivocal agreement to engage in a particular sexual act’.
এগুলি ছেলেদেরও, মেয়েদের মতো, জানিয়ে দেওয়া উচিত প্রথমেই, যাতে তারা নিজেদের কৃত নির্যাতনকে ‘নির্যাতন’ বলে চিহ্নিত করতে পারে। লিঙ্গ নির্যাতন সম্পর্কিত অন্যান্য আইনের পাঠও জরুরি।
২) কিছু মিথ আশু ভাঙতে হবে। ধর্ষণ সংস্কৃতির বিপ্রতীপ সংস্কৃতি গড়ে তোলা ছাড়া উপায় কী?
মিথ ১: ধর্ষণের অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা।
প্রকৃত ঘটনা: পরিসংখ্যান তা বলছে না৷ ২% মতো ঘটনা সাজানো। মিথ্যা অভিযোগের হার অন্য কেসের থেকে বেশি নয়।
মিথ ২: পুরুষের ধর্ষণ হয় না।
প্রকৃত ঘটনা: অবশ্যই হয়। পুরুষের দ্বারাই পুরুষের ধর্ষণ হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।কখনও কখনও নারীর দ্বারাও হয়, বিশেষত পুরুষ যদি নারীর থেকে বয়সে ছোট হন বা কম ক্ষমতাবান হন৷ পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে নারী কর্তৃক ধর্ষণ কম হয়, কিন্তু হয়। বরং ধর্ষণের পরে লজ্জা যেমন নারীকে তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে বাধা দেয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও বাধা দেয় তার পৌরুষের ফাঁপা ধারণা। ধর্ষিত হওয়াকে সে তার পৌরুষের বিচ্যুতি ভাবে। আবার দ্বিধা কাটিয়ে সে বলে উঠতে পারলেও অনেক সময় তা বিশ্বাস করা হয় না৷
মিথ ৩: অচেনা পুরুষ রেপ করে।
প্রকৃত ঘটনা: ৯০% ধর্ষণ চেনা পুরুষের দ্বারা ঘটে।
মিথ ৪: ধ্বস্তাধ্বস্তি বা প্রতিরোধের চিহ্ন নেই মানেই ধর্ষণ নয়।
প্রকৃত ঘটনা: আত্মসমপর্ণ মানেই সম্মতি নয়৷ ভয় ও ভয়জনিত অসাড়তার কারণে কেউ প্রতিরোধ করল না মানেই সে ধর্ষণ উপভোগ করছে, এমন নয়৷
মিথ ৫: ভিক্টিম ফ্লার্ট করে, ছোট জামাকাপড় পরে বা নেশাসক্ত হয়ে নিজেই ধর্ষণকে আমন্ত্রণ করেছে।
প্রকৃত ঘটনা: আসলে ধরেই নেওয়া হচ্ছে পুরুষ একজন যৌনক্ষুধাসর্বস্ব ব্যক্তি যার নিজেকে সামলানোর দায় নেই৷ তাই ধর্ষিতাকেই বলা হচ্ছে নিজেকে সংশোধন করতে।
মিথ ৬: যৌনতায় কোনও একবার সম্মতি দিয়ে থাকলে তা একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
প্রকৃত ঘটনা: কনসেন্ট বারবার নিতে হয়। প্রতিবার নিতে হয়, এমনকী স্ত্রী বা প্রেমিকার থেকেও। প্রতিটি আলাদা আলাদা যৌনকার্যের জন্য নিতে হয়। পুরুষকে কনসেন্টকে মান্য করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাকে 'না' বলতে ও শুনতে শিখতে হবে। 'হ্যাঁ'-র জন্য অপেক্ষা করা শিখতে হবে। শিখতে হবে জড়তাযুক্ত কনসেন্টও কনসেন্ট নয়, একমাত্র স্বচ্ছন্দ ও উৎসাহী সম্মতিই হল সম্মতি।
৩) পৌরুষের ধারণার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। হিংস্রতা আর আধিপত্য দিয়ে পৌরুষ মাপলে চলবে না৷ পুরুষ হয়ে উঠতে গেলে দু-চার বার ইভটিজিং করতেই হবে, বাসে-ট্রামে মেয়েদের গায়ে হাত দিতেই হবে, বহুসংখ্যক মেয়েকে 'তুলতে'-ই হবে, তেমন যে নয়, তা ছোটবেলায় শিখিয়ে দেওয়া ভাল। না শিখে থাকলে, পরিণত পুরুষের ক্ষেত্রেও চেষ্টা করতে হবে। পৌরুষের নতুন সদর্থক সংজ্ঞা তৈরি করতে হবে। সহানুভূতি, আত্মসংবরণ, মমতা ইত্যাদিকেও পুরুষালি গুণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পুরুষকেও শেখাতে হবে, যেখানেই ‘শি ওয়াজ আস্কিং ফর ইট’ লজিক দেখা যাবে, অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে৷
পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলেই পিতৃতান্ত্রিক অন্ধকার পেয়েছে পুরুষানুক্রমে৷ সে অন্ধকার থেকে তাদের বের করতে হলে ধৈর্যশীল হতে হবে৷ গভীরতর শোধনের এই পথ লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব৷
৪) বিষমকামী পুরুষ নারীকে যৌনক্রীড়ার সময় যৌনবস্তু হিসেবে দেখতেই পারেন। মুশকিল হল, শুধু সেইটুকু দেখাতেই আটকে থাকেন না তিনি। বিছানায় নারীকে যৌনসঙ্গী হিসেবে কামনা করা আর সাংস্কৃতিকভাবে তাকে যৌনসামগ্রী মাত্র ভাবার মধ্যে তফাত আছে। প্রথমটি সুস্থ যৌনতার ধাপ। দ্বিতীয়টি করতে পারলে তবেই অপরিচিত মেয়েকে টেনে নিয়ে গিয়ে, সমবেত ধর্ষণ করে, তার উচ্ছিষ্ট শরীরকে হত্যা করা যায়।
৫) যৌন নির্যাতনের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি যে নিতে হবে পড়াশুনো, কাজের জায়গায়, রাস্তা ঘাটে— তা নারী-পুরুষ সকলকেই শিখতে হবে। জীবিত ধর্ষিতার প্রতি কিন্তু এমপ্যাথির যথেষ্ট অভাব দেখা যায় সমাজের, এমনকী আইনেরও।
তাদের বাইস্ট্যান্ডার হিসেবে দায়িত্বশীল হতে শিখতে হবে৷ ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থা আকছার ঘটে৷ দেখেও না দেখার ভান না করে প্রতিবাদ করতে হবে৷ লিঞ্চিং-এর এই দেশে ভিড় বাসে যৌন হেনস্থা করার সময় তো কেউ গণপিটুনির ভয়ে ভীত হয় না! সকলেই জানে, কেউ প্রতিবাদ করবে না৷ তাই ধর্ষণ ঘটার উপক্রম হলে বা ধর্ষণ ঘটে গেলে, ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: “মিমিকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলে…”, ধর্ষণের হুমকি থেকে রেহাই নেই মিমিরও!
৬) ধর্ষণের বিষয়ে ইন্টারসেকশনাল মনোভাব নিতে শেখাতে হবে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ, অর্থনৈতিক অবস্থা বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে, সব মেয়েদেরই ধর্ষণ হয়৷ আর ধর্ষকও আসেন সবরকম স্থানাঙ্ক থেকেই৷ যৌন অভিরুচি ভিন্ন যাদের, যেমন সমপ্রেমী বা দ্বিপ্রেমী, তাঁদেরও ধর্ষণ হয়। 'কারেকটিভ রেপ' হল এমন ধর্ষণ যার মাধ্যমে ধর্ষক নাকি সমকামী ধর্ষিতকে বিষমকামী স্বাভাবিকত্বে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন৷ অথবা যারা প্রতিবন্ধী বা আদিবাসী বা দরিদ্র বা ফুটপাথবাসী, তাঁদের সকলেরই ধর্ষণই একই রকম ভয়ানক৷
৭) সার্ভাইভারকে বিশ্বাস করতে হবে। এ-ও ধর্ষণ সংস্কৃতিকে রোখার এক প্রথামিক শর্ত। 'মিটু' নামক আন্দোলনে যখন শত শত ধর্ষিতা সোচ্চার হন, তখন প্রাথমিকভাবে তাঁদের অবিশ্বাস করা হয়, তাঁদের সমালোচনা হয় ৷ ভিক্টিমের প্রতি এই সমবেত অবিশ্বাসও ধর্ষণ সংস্কৃতি। ধর্ষিতা যদি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অবিশ্বাস আর সন্দেহই পান, তাহলে দু'টি বিষয় ঘটে। প্রথমত, ধর্ষিতার ভিক্টিমহুড তাতে দীর্ঘায়িত হয়। দ্বিতীয়ত, আরও অনেক ধর্ষিতা মুখ খোলা থেকে পিছিয়ে আসেন।
৮) তাদের শিখতে হবে, ধর্ষণ নিয়ে মজার পাঞ্চলাইন হয় না৷ যে রসবোধ যৌন হেনস্থাকে স্বাভাবিকত্ব দেয় তা বর্জন করাই ভাল।
৯) কিশোর পুরুষ বা পুং শিশুর মতো, দরকার হলে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকেও হাতে ধরে শেখাতে হবে প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান।
‘লার্নিং’-এর চেয়ে কঠিন হল ‘আনলার্নিং।’ যে ধরনের পাঠের কথা আমরা আলোচনা করলাম, তার এক বৃহৎ অংশ জুড়ে পড়া-লেখা-আঁকা নয়, আছে পুরনো শ্লেটের লেখা মুছে ফেলা, আঁকা ছবি ছিঁড়ে ফেলা, রচিত কাব্য মুছে ফেলা। তারপর নতুন করে গড়া।
ব্যক্তি ধর্ষক এক নারীবিদ্বেষী, প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতাবিদ্বেষী সমাজের মুখপাত্র মাত্র। লড়াইটা সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু নয়। তেমনটা হলে,সে লড়াই হত অনেক সহজ। লড়াইটা সোজা নয়, কারণ এ লড়াই নিজের বিরুদ্ধে, নিজের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।