সন্তানধারণে অক্ষম, অন্য নারীর গর্ভের সাহায্য নিতে যে নিয়মগুলি মানতেই হবে

সারোগেসির বাণিজ্যিকীকরণের ফলে সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনেক মহিলাই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতেন। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত গুজরাতে অনেক গরিব মহিলাই সারোগেসির মাধ্যমে রোজগার করতেন।

দক্ষিণ কেরলের সাবু থমাস এবং জিন জর্জ কিছুদিন আগেই হারিয়েছেন তাঁদের কুড়ি বছর বয়সি কন্যাসন্তান নোভা সাবুকে। প্রথমে কোভিডে আক্রান্ত হয় নোভা, পরে মস্তিষ্কে রক্ত জমে যাওয়াই কাল হয়েছিল। এই দম্পতির জীবন বিধ্বস্ত হয়ে যায় তাঁদের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর। বর্তমানে সাবু থমাসের বয়স বাহান্ন এবং তাঁর স্ত্রী জিন জর্জের বয়স সাতচল্লিশ বছর। মেয়ের মৃত্যুশোক ভুলতে তাঁরা এখন সন্তান চান একটি। এদিকে মেনোপজে়র দরুন জিন জর্জের পক্ষেও সন্তান-ধারণ সম্ভব নয়। এবং সেজন্য তাঁরা একজন মহিলাকে খুঁজছেন, যিনি সারোগেসির মাধ্যমে তাঁদের সন্তানের জন্ম দেবেন।

কিন্তু দক্ষিণ কেরলের এই দম্পতির ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে ভারতের নতুন সারোগেসি আইন।

আর এক দম্পতি দুই সন্তানকেই হারিয়েছেন, সেই শূন‍্যতা কাটাতে তাঁদেরও সারোগেসির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ সেই মহিলার শারীরিক কারণের জন্যেই সন্তানধারণ আর সম্ভব নয়। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে তাঁরা সারোগেসির জন্য চেষ্টা করেন। তাই সেই দম্পতি নিজেদের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু দান করেন, যাতে কৃত্রিমভাবে দেহের বাইরে রেখে সেই ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, ভ্রূণ তৈরি করা যায়। ভ্রূণ তৈরিও করা হয় চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে, এবার শুধু একজন মহিলার দরকার, যিনি তাঁর জরায়ুতে ভ্রুণটি ধারণ করে সারোগেট মায়ের ভূমিকা পালন করবেন।

আরও পড়ুন: ত্রাসের নাম ডিজিটাল রেপ! নতুন ভারতে কতটা নিরাপদ নারীরা?

এখানেও বাধ সাধছে নতুন সারোগেসি রেগুলেশন ও অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজিস অ্যাক্ট।

প্রথমেই আসা যাক, সারোগেসি কী, সেই আলোচনায়। সারোগেসির একটি রীতি, যেখানে কোনও দম্পতির সন্তানকে অন্য কোনও মহিলা গর্ভে ধারণ করেন। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর, সেই দম্পতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সদ্যোজাতকে।

সারোগেসি দু'টি পদ্ধতিতে করা হয়। প্রথম পদ্ধতিতে সারোগেট মা, অর্থাৎ যিনি সন্তান ধারণ করেন, তাঁর ডিম্বাণুকে কৃত্রিমভাবে নিষিক্ত করা হয় অন্য পুরুষের শুক্রাণু দিয়ে। সেই মহিলার ডিম্বাণু নিষিক্ত হলে, তিনি তাঁর জঠরে সন্তান ধারণ করেন। সন্তানের জন্মর পর সেই সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যে দম্পতি সন্তান চেয়েছিলেন তাঁদের কাছে।

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে নারীর শরীর থেকে ডিম্বাণু ও পুরুষের শরীর থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে, শরীরের বাইরে কৃত্রিমভাবে ডিম্বাণু নিষিক্ত করে, শরীরের বাইরে তৈরি হওয়া ভ্রূণটিকে সারোগেট মা হতে ইচ্ছুক এমন মহিলার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।

দুই ক্ষেত্রেই শুক্রাণু নেওয়া হয় সেই পুরুষের থেকেই, যিনি ও যাঁর স্ত্রী বা সঙ্গী সন্তান পেতে ইচ্ছুক। পাশাপাশি সন্তান পেতে ইচ্ছুক সিঙ্গল ফাদার বা সমকামী পুরুষ দম্পতির মধ্যে থেকে কেউ একজন শুক্রাণু দান করতে পারেন সন্তান গ্রহণ করার জন্য।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ডিম্বাণু দান করেন, সারোগেট মাদার বাদে অন্য কোনও মহিলা। সেই ডিম্বাণু সন্তানলাভে ইচ্ছুক হবু মা-ও হতে পারেন বা পরোপকারী কোনও মহিলা, যিনি সন্তান চান না, কেবল ডিম্বাণু দান করতে চান।

কিন্তু এখানে বাধা কোথায়? কী বলছে নতুন সারোগেসি রেগুলেশন? দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমত, নতুন সারোগেসি রেগুলেশন অনুযায়ী, বিয়ের অন্তত পাঁচ বছরের আগে সারোগেসির সুবিধে পাবেন না কোনও দম্পতি। এখানে স্ত্রীর বয়স পঁচিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে এবং স্বামীর বয়স ছাব্বিশ থেকে পঞ্চান্ন বছরের মধ্যে হতে হবে। এখানেই শেষ নয়, সারোগেসির জন্য উপযুক্ত হতে গেলে, সেই দম্পতির কোনও সন্তান (জৈবিক, দত্তক এমনকী, সারোগেট সন্তানও না) থাকা চলবে না। তবে কোনও দম্পতির সন্তানের যদি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকে, বা কোনও জটিল রোগে আক্রান্ত হয় সন্তান, সেক্ষেত্রে তাঁরা সারোগেসির সুবিধে পাবেন।

লিভ-ইন করছেন এমন দম্পতি, বা সিঙ্গল ফাদার যিনি হতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটবে না। সমলিঙ্গে যৌনতা বর্তমানে আইনসিদ্ধ হলেও, সমলিঙ্গে বিয়ে আইনসিদ্ধ এখনও নয় এই দেশে। তাই সমকামী দম্পতিরাও সারোগেসির সুযোগ পাবেন না।

শুধু এখানেই শেষ নয়। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে কে সারোগেট মা হতে পারবেন, তার ওপরেও। আগে যে কেউ হতে পারতেন সারোগেট মা, এখন ওই দম্পতির নিকট আত্মীয় ছাড়া কোনও মহিলা সারোগেট মাদার হতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, মহিলা যেন বিবাহিত হন এবং তাঁর নিজের একটি সন্তান থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি সেই মহিলার বয়স অবশ্যই পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হতে হবে। তিনি জীবনে মাত্র একবারই সারোগেট হতে পারবেন। সারোগেট হওয়ার যোগ্য হতে গেলে তাঁর মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার প্রমাণস্বরূপ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সেই দম্পতির মধ্যে একজনকে প্রজননে অক্ষম হতে হবে এবং অবশ্যই জেলার মেডিক্যাল বোর্ড থেকে যৌন অক্ষমতা প্রমাণকারী সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি, যিনি সারোগেট মা হতে চলেছেন, তাঁর জন্য স্বাস্থ্যবিমা করাতে হবে। এই বিমা যেন তাঁর গর্ভবতী থাকা ও সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে যদি কোনও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, সেই সময়ের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত হয়।

অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজিস বা অ্যাক্ট কী বলছে, সেই বিষয়ে নজর রাখা যাক।

অ্যাক্ট অনুযায়ী সমস্ত ক্লিনিক যেন ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ক্লিনিকস অফ ইন্ডিয়া-র অধীনে নথিভুক্ত হয়। পাশাপাশি সেই ক্লিনিকগুলিকে আবশ্যিকভাবে সারোগেটের সুবিধাভোগী দম্পতি ও সারোগেট মায়েদের সম্পর্কিত একটি তথ্যভান্ডার বানাতে হবে। এই ক্লিনিকগুলির রেজিস্ট্রি অফ ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ক্লিনিকস অফ ইন্ডিয়া-র অধীনে নথিভুক্ত থাকার মেয়াদ পাঁচ বছর। মেয়াদ ফুরোলে আবার নতুন করে নথিভুক্ত করাতে হবে।

এই ক্লিনিকগুলি একুশ থেকে পঞ্চান্ন বছরের পুরুষদের শুক্রাণু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারবে। অন্যদিকে তেইশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি মহিলাদের ডিম্বাণু সংগ্রহ করতে পারবেন। সেই মহিলাদের আবশ্যিকভাবে বিবাহিত হতে হবে এবং অন্তত এক সন্তানের মা হতে হবে। আর সেই সন্তানের বয়স যেন অন্তত তিন বছর হয়। কোনও মহিলা সারা জীবনে একবারই ডিম্বাণু দান করতে পারবেন ও একসঙ্গে সাতটির বেশি ডিম্বাণু তিনি দান করতে পারবেন না। পুরুষেরা একের বেশি দম্পতিকে শুক্রাণু দান করতে পারবেন না।

এই অ্যাক্টগুলির মূল উদ্দেশ্য হল সারোগেসির বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা। সারোগেসির বাণিজ্যিকীকরণের ফলে সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনেক মহিলাই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতেন। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত গুজরাতে অনেক গরিব মহিলাই সারোগেসির মাধ্যমে রোজগার করতেন। সমাজকর্মীদের মতে, নতুন এই অ্যাক্ট নিষেধাজ্ঞা বাড়ালেও, মহিলাদের ওপর নির্যাতন আটকাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে মহিলা ও পুরুষ, উভয়েরই অভিভাবক হওয়ার স্বাধীনতা খর্ব হল অনেকাংশে।

 

More Articles