পদ্মবিদায়! কোন অঙ্কে জঙ্গলমহল পুনরুদ্ধার করল তৃণমূল?
Jangal Mahal Lok Sabha Election 2024: পরিবর্তনের পরে প্রথম ৭-৮ বছর জঙ্গলমহলে ঘাসফুল বাড়তেই থাকে। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, ঘাটাল, মেদিনীপুর প্রত্যেকটি আসনে তৃণমূল বিপুল জয় পায়।
একটা সময় এই জনপদে সকাল সকাল পড়ে থাকত টাটকা লাশ। বেলপাহাড়ি-লালগড় তখন রোজ সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। রোজই মাওবাদীদের গুলিতে খুন হচ্ছেন কোনও না কোনও সিপিএমের পঞ্চায়েতের নেতা। কখনও আবার উল্টোটাও। পুলিশের গুলিতে খতম হয়েছেন শীর্ষ মাওবাদী নেতা। ২০০৭ থেকে ২০১১ বারবার রক্ত ঝরেছে জঙ্গলমহলে।
কাট টু ২০২৩-২৪। শীতের মরসুম। সেই জঙ্গলমহলেরই সব ক'টা রিসর্ট'-হোম স্টে দোল অবধি 'বুকড' ছিল। ভ্রমণ প্রিয় বাঙালির নতুন আকর্ষণ এখন জঙ্গলমহল! স্থানীয় হিসেব, শুধু ঝাড়গ্রাম জেলাতেই পর্যটনে গত অর্থবর্ষে ১০-১২ কোটির ব্যবসা হয়েছে।গোটা জঙ্গলমহল যোগ করলে সেই অঙ্কটা কমপক্ষে ২৫ কোটিতে পৌঁছবে। যে জঙ্গলমহল একটা সময় ছিল আতঙ্কের উৎসস্থল, যে এলাকার উপর দিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন গেলে, ইষ্টদেবতার নাম জপতে জপতে যেতে হতো যাত্রীদের, সেই জঙ্গলমহলের পরিকাঠামোটাই বদলে গেছে।
আর এই বদলের মধ্যেই জঙ্গলমহলের রাজনীতির সমীকরণও যুক্ত। জঙ্গলমহল একটা সময় ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি। তারপরে মাওবাদী প্রবণ এলাকা। মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয় শাল সেগুনের জঙ্গলগুলি। তারপর রাজ্যে পরিবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া এবং জঙ্গলমহলের জন্য দেদার উন্নয়নের অর্থ বরাদ্দ। ছোট ছোট মাওবাদী নেতাদের আত্মসমর্পণ করিয়ে তাদের হাতে সরকারি চাকরি (বেশিরভাগকেই হোম গার্ড বা সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি) তুলে দেওয়া। আধবেলা খেয়ে প্রকৃতি আর খিদের সঙ্গে লড়াই করা মানুষগুলোর জন্য সেটাও অনেক বড় পাওনা। রেশনে 'জঙ্গলমহল' প্যাকেজ চালু করে আরও বেশি করে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া সহ কন্যাশ্রী-রূপশ্রীসহ রাজ্য সরকারের নানাবিধ সামাজিক সুরক্ষা যোজনা পেতে শুরু করেন জঙ্গলমহলের মানুষজন। পরিবর্তনের পরে প্রথম ৭-৮ বছর জঙ্গলমহলে ঘাসফুল বাড়তেই থাকে। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, ঘাটাল, মেদিনীপুর প্রত্যেকটি আসনে তৃণমূল বিপুল জয় পায়। প্রাক্তন মাওবাদী হোক বা সিপিএম থেকে আসা লোকজন রাতারাতি তৃণমূল হয়ে যান। কিন্তু তৃণমূল এই অঞ্চলে প্রথম ধাক্কা খায় ২০১৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে৷ এমনিতেই ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক তৃণমূল যে 'বাড়াবাড়ি' করে ফেলেছিল সেটা ২০২৩-এর 'নবজোয়ার' অনুষ্ঠানেও প্রকারান্তরে বারবার স্বীকার করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত দেখাও যায়, ২০১৮-র তুলনায় ২০২৩-র পঞ্চায়েতে অনেক কম আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে তৃণমূল।
আরও পড়ুন- অযোধ্যা কেন বিজেপিকে তাড়াল? কী বলছেন রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত?
তবে ২০১৮-র প্রেক্ষিত ছিল আলাদা। সদ্য ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেসের জোটকে পর্যুদস্ত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফেরা তৃণমূল নেতারা বিজেপিকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেননি। প্রবল আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছিল সেই সময়ের তৃণমূল। ২০১৮-র সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই যেখানে যতটুকু ভোটদান হয়েছিল, তারমধ্যেও জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়ায় বেশ কিছু গ্রামসভা-পঞ্চায়েত সমিতির আসন জিতে নেয় বিজেপি। তৃণমূল তখনও সেসব জয়কে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। বরং 'চড়াম চড়াম'- বিরোধীদের 'গুড়-বাতাসা' খাওয়ানোতে মশগুল তৃণমূল নেতারা বুঝতেই পারেননি কীভাবে জঙ্গলমহল জুড়ে পদ্মের চাষ হয়ে গেছে। শুধু জঙ্গলমহল না গোটা বাংলারই বিভিন্ন এলাকাতেই হয়েছিল কিন্তু জঙ্গলমহলে পদ্মের এই চাষে সক্রিয় ভূমিকা ছিল আরএসএসের। তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের বেশিরভাগই তখন ব্যস্ত মাটি আর বালির ব্যবসা নিয়ে। আর সেই সুযোগে আরএসএস গ্রামে গ্রামে নিজেদের ক্যম্প করেছে। সঙ্ঘের শাখা বিস্তার হয়েছে। পাশেই প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড৷ উগ্র হিন্দুত্বের হাওয়া খুব সহজেই ঢুকে পড়ে জঙ্গলমহলের জেলাগুলোতে। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৯-এর লোকসভায় একমাত্র সুপারস্টার দেব ঘাটাল লোকসভাটি নিজের ক্যারিশমায় বের করতে পারলেও বাকি লোকসভাগুলিতে মুখ থুবড়ে পড়ে তৃণমূল। তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই ফল ছিল অপ্রত্যাশিত। জঙ্গলমহলকে এত ঢেলে সাজিয়ে, উন্নয়ন করেও কীভাবে জঙ্গলমহল তৃণমূলের থেকে মুখ ফেরালো তা নিয়ে বারবার প্রকাশ্য সভাতেও নিজের ক্ষোভ-হতাশা গোপন রাখেননি তৃণমূল সুপ্রিমো। এরপর থেকে কার্যত জঙ্গলমহল হয়ে যায় বিজেপির শক্ত ঘাঁটি৷ ২০২১-এর নির্বাচনে এই অঞ্চলের আসনগুলির মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে তৃণমূল ফের নিজেদের জমি ফেরত আনে কিন্তু পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় আধিপত্য বজায় রাখে বিজেপি৷
এবারের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি গোটা বাংলার যে দু'টি অঞ্চল নিয়ে সবচেয়ে বেশি আত্মপ্রত্যয়ী ছিল তা হলো উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহল। উত্তরবঙ্গ বিজেপির মান রাখলেও, জঙ্গলমহলের এই ফল সবচেয়ে হতাশ করেছে বিজেপিকে। পুরুলিয়া ছাড়া জঙ্গলমহলের কোনও লোকসভায় আর বিজেপি নেই! বিষ্ণুপুরের কথা উঠতেই পারে কিন্তু বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া জেলার মধ্যে পড়লেও, প্রকৃত জঙ্গলমহলের মধ্যে পড়ে না। সেক্ষেত্রে একমাত্র পুরুলিয়াই বিজেপির হাতে। পুরুলিয়াতেও বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোর ২০১৯-এর ২ লক্ষের উপরের জয়ের ব্যবধান নেমে এসেছে মাত্র ১৭ হাজারে! বলরামপুর, কাশীপুর, মানবাজার, জয়পুর বিধানসভায় লিড পেয়েছে তৃণমূল। কিন্তু পুরুলিয়া পৌরসভা এলাকার ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টি ওয়ার্ডেই ২৯ হাজারের লিড তুলে নিয়েছে বিজেপি। ঝালদা পুরসভায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজারে এবং বাঘমুন্ডি পৌরসভায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজারে পিছিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস! এই পৌর এলাকাগুলোতে যদি নিজেদের হারের ব্যবধান কমত, তাহলে নিশ্চিতভাবে পুরুলিয়াও যেতো তৃণমূলের দিকেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলার ৯ টির মধ্যে মাত্র ৩টিতে জয় পায় তৃণমূল। ৬টি পায় বিজেপি। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ফলাফল পুরো উলটো গেছে! এই মুহূর্তে ৩টিতে এগিয়ে বিজেপি। ৬ টিতে তৃণমূল। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এই ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পুরুলিয়ায় কুর্মি ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। শহরাঞ্চলে কুর্মিদের আন্দোলন কোনও প্রভাব না ফেললেও গ্রামাঞ্চলে বিশেষত জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় কুর্মিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কুর্মি নেতা অজিত মাহাতো এই আসনে লড়ে প্রায় ১ লক্ষ ভোট পেয়েছেন। কুর্মিদের এই আন্দোলনকে প্রকারান্তরে সমর্থন জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে ডেকে বৈঠকও করেন কুর্মি নেতাদের সঙ্গে। কুর্মিদের দাবি দাওয়ার জন্য তাঁর দল যে দিল্লিতে আওয়াজ তুলবে, সেই প্রতিশ্রুতিও দেন। ফলাফলেই স্পষ্ট, কুর্মিদের একটা অংশ ফের তৃণমূলমুখী।
বিজেপির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সংকেত হলো তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতি ভোট। যে এসসি এবং এসটি ভোট গত কয়েকটা নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজেপির ঘরে গেছে, সেই ভোট এবার বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়েছে। বাঁকুড়া লোকসভার অন্তর্গত রঘুনাথপুর বিধানসভা তপশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসন। এই আসনে ৪৫৫ ভোটে লিড পেয়েছে তৃণমূল। বাঁকুড়া লোকসভারই অন্তর্গত রানিবাঁধ এবং রায়পুর তপশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। দু'টি আসনেই যথাক্রমে ৫৭৫২ এবং ১৭,৪৯৪ ভোটে এগিয়ে তৃণমূল প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তী।
এই নির্বাচন কিন্তু রাজ্যের নির্বাচন ছিল না। এই নির্বাচনের মুখ ছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি নিজেকে দলিত আদিবাসীদের প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল হিসেবে দেখাতে কোনও কসুর করেননি। তারপরেও আদিবাসীরা মুখ ফিরিয়েছেন মোদির থেকে (ঝাড়খণ্ডেও আদিবাসী অধ্যুষিত সব ক'টি আসনে হেরেছে বিজেপি)। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিজেপির প্রতি একটা ক্ষোভ আদিবাসীদের মধ্যে ছিলই, তার সঙ্গে বাংলার শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের বকেয়া আটকে দেওয়া জঙ্গলমহলের খেটে খাওয়া শ্রমিক মজদুরদের মধ্যে প্রবল বিজেপি বিরোধিতাকে আরও দৃঢ় করেছে৷
একশো দিনের বকেয়া বন্ধ, আবাস যোজনার টাকা বন্ধ- এই দু'টি ইস্যুকে নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতারা। এই ইস্যুকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একদম মানুষের মনের মধ্যে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছেন। একদিকে দিল্লি-কলকাতায় বৃহত্তর আন্দোলন আরেকদিকে ছোট ছোট গ্রামসভায় তৃণমূল নেতারা বারবার বোঝাতে থাকেন যে, দিল্লির সরকার বাংলার টাকা আটকে রেখেছে এবং এই স্ট্রাটেজিতে যে তাঁরা সফল তা বলাই যায়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু স্থানীয় ইস্যু। যেমন, বাঁকুড়াতে বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারকে প্রথম থেকেই মানতে চাননি বিজেপিরই একাংশ। বিজেপি বিধায়ক নীলাদ্রি শেখর দানা প্রকাশ্যে সুভাষ সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন৷ সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি জেলা থেকে মণ্ডল হয়ে বুথ অবধি সর্বত্র নিজের লোকদের বসিয়েছিলেন!
আবার ঝাড়গ্রামে ভোটের একেবারে আগে, বিজেপিতে টিকিট না পেয়ে বিজেপির সাংসদ কুনার হেমব্রম তৃণমূলে যোগ দিয়ে দিলেন। ফলে ২০১৮ থেকে যে পদ্মবাগান সেজে উঠছিল, খানিকটা অন্তর্কলহের কারণেও সেই বাগান তছনছ হয়ে গেছে। বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্যের কথা প্রায়ই শোনা যায় জঙ্গলমহলের বাতাসে কান পাতলেই। কুর্মি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে দিলীপ ঘোষের 'জামা প্যান্ট খুলে নেওয়া'র হুমকি যে কুর্মিরা ভালোভাবে নেননি তা ভোটবাক্সেই তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে যেমন তোলাবাজির অভিযোগ এসেছে তেমনই অভিযোগ এসেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের। বিজেপিতে কুনার হেমব্রম শুভেন্দু অধিকারীর চেয়ে পুরনো নেতা। অথচ, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাত্রই কুনারের ঘনিষ্ঠদের সরিয়ে শুভেন্দু ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন পদে আসীন হতে থাকেন। ফলে ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ একটা ছিলই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল জনজাতি ভিত্তিক রাজনীতির জটিল অঙ্ক।
অনেকেই বলতে পারেন, বাংলার রাজনীতিতে বিহারের মতো অত জনজাতি ভিত্তিক নয়। কিন্তু যারা জঙ্গলমহলের রাজনীতিকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা জানেন জনজাতি ভিত্তিক রাজনীতি কি প্রবল অভিঘাত ফেলে এই অঞ্চলে। যেমন বাউরি জনজাতি। বাঁকুড়া জেলায় বাউরি জনজাতির প্রবল প্রভাব। বাউরি জনজাতির একাধিক নেতার সঙ্গে তৃণমূল আলাদা সমীকরণ গড়ে তোলে। যে সমীকরণের ফল জঙ্গলমহলে ঘাসফুলের এই পুনরুত্থান। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ সারি এবং সারনা ধর্মালম্বীরা। সাঁওতালদের নিজস্ব এই ধর্মের স্বীকৃতির জন্য তাঁরা বহুদিন ধরেই সরব। তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা সংসদে এই বিষয়টি উত্থাপন করবে। জঙ্গলমহলে বিজেপির এতজন সাংসদ থাকার পরেও, কেউ একবারও সংসদের ভিতরে বাইরে আওয়াজ তোলেননি। অথচ রাজ্য বিধানসভায় ইতিমধ্যেই সারি ও সারনাকে আলাদা ধর্মীয় জনজাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জঙ্গলমহলের ৯-১০% ভোটে সরাসরি প্রভাব পড়েছে সারি-সারনা ধর্মালম্বীদের এই আবেগের ফলে।
এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি সরকারের দু'টি আইন সাঁওতাল আদিবাসী ভূমিপুত্রদের সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে আরও উৎসাহিত করেছে। প্রথমটি, 'বন সংরক্ষণ আইন ২০২৩’ এবং দ্বিতীয়টি 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' বা 'ইউনিফর্ম সিভিল কোড'। 'বন সংরক্ষণ আইন' পাশ হওয়ার পর থেকেই জঙ্গলের আদিবাসীদের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়, যে জল জঙ্গলের উপর সর্বপ্রথম অধিকার থাকা আদিবাসী-মূলবাসীদের আর সেই অধিকার রইল না। এবার থেকে কর্পোরেট বহুজাতিক সংস্থা চাইলেই জঙ্গল দখল করে নিজেদের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ফেলবে! এমন একটা প্রচার খুব নীনিচু স্বরে জঙ্গলমহলে চলেছে৷ আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। আসলে, সাঁওতালি আদিবাসী সমাজের আজও নিজস্ব কিছু লোকাচার আছে। নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি আছে। 'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি' সামনে এনে নরেন্দ্র মোদি মুসলিম সমাজকে 'শিক্ষা' দিতে চাইলেও এর প্রভাব সাঁওতাল আদিবাসী সমাজেও পড়তে বাধ্য। পড়েওছে। অন্তত ইভিএমের ফল তাই-ই বলছে।
আরও পড়ুন- মণিপুরের দুর্দশার জন্য দায়ি মোদিই? যা বলছেন আরএসএসের মোহন ভাগবত…
পুরুলিয়ার মতো ঝাড়গ্রামেও শহরাঞ্চলে তৃণমূল পিছিয়ে থেকেছে কিন্তু জঙ্গল সংলগ্ন ব্লকগুলোতে মানুষ ঢেলে ভোট দিয়েছে তৃণমূলকে। আসলে রাজনীতি এমন একটি জায়গা যেখানে জেতার জন্য সবরকম পদ্ধতি অবলম্বন করাটাই দস্তুর। সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকেও শাসকদল ব্যবহার করেছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যেমন জঙ্গলমহল সহ গোটা বাংলার মহিলাদের মধ্যেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, তেমনই প্রশাসনকে অন্যভাবেও ব্যবহার করেছে শাসকদল। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিজের দলের ক্যাডারদের থেকে সরাসরি প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ২০২০ থেকেই। 'দুয়ারে সরকার' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কিন্তু ঝাড়গ্রামের ক্ষেত্রে সেটাই আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছিল। নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে থেকে জেলাশাসক নিজে বেরোতেন পাড়ায় পাড়ায় ক্যম্প করতে। তাঁর সঙ্গে থাকত গোটা জেলা প্রশাসন। ৩ জন এডিএম, স্থানীয় বিডিও সহ আরও ৫-১০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চটজলদি সমস্যার সমাধান করেছেন। কারও বার্ধক্য ভাতা, কারও বিধবা ভাতা, কারও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড সংক্রান্ত সমস্যায় মুশকিল আসান হয়ে পৌঁছে গেছেন স্বয়ং জেলা শাসক সুনীল আগরওয়াল। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে বিজেপির অভিযোগে সুনীল আগরওয়ালকে ঝাড়গ্রামের জেলা শাসকের পদ থেকে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। দায়িত্বে আসেন মৌমিতা গোদারা বসু কিন্তু দায়িত্ব থেকে অব্যহতির আগেই যা কাজ করার করে দিয়ে ছিলেন সুনীল। যে কাজের লাভ ভোটবাক্সে পেয়েছে শাসক তৃণমূল। ঠিক যেভাবে বাঁকুড়াতে প্রায় ৭০% ঘরে পানীয় জল পৌঁছে দিয়েছে প্রশাসন। পরিশুদ্ধ জল এখনও এই অঞ্চলে নির্বাচনের বড় ইস্যু। এই জল পৌঁছনোর কৃতিত্ব কার? রাজ্যের না কেন্দ্রের? তা নিয়েও দড়ি টানাটানি চলেছে কিন্তু শেষমেশ বাঁকুড়ার মানুষ দিদিতেই আস্থা রেখেছেন।
বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম পুনরুদ্ধার। আর পুরুলিয়ায় জোর টক্কর যেমন তৃণমূলকে স্বস্তি দিয়েছে, তেমনই প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি। একসময়ের শক্ত ঘাঁটিতেই সিপিএম প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। জঙ্গলমহল জানে, কখন কাকে বেছে নিতে হয়। আমলাশোলের সেই ভয়ানক দিন পেরিয়ে এসেছে জঙ্গলমহল। একসময়ের রক্তাক্ত মাটিতে এখন রক্ত পলাশ দেখতে ভিড় জমায় কলকাতার পর্যটকরা। নতুন গজিয়ে ওঠা রিসর্টে সান্ধ্যকালীন 'বনফায়ার'-এ নাচ গানে সাঁওতালি সুরে নেচে নিজেকে 'আরণ্যক' প্রমাণ করবে কিছু শহুরে লোকজন। চিলকা সোরেন, বাবুরানি ওঁরাওরা এসব দেখে আগে খুব হাসত, এখন আর হাসে না। ওরা জানে, ঠিক কখন হাসতে হয়। জঙ্গলমহল এখন বোঝে ঠিক কখন হাসতে হয় আর ঠিক কখন কাউকে কাঁদাতে হয়। রাজনীতির সময় জ্ঞান জঙ্গলমহল শিখে গেছে।